কোন অঞ্চলের সরকারী বা বেসরকারী সংস্থা ও অফিসগুলিতে স্থানীয় ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে৷
ভাষা মানুষের অন্তরের ভাব প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম৷ এই ভাষা মানুষের প্রাণীন সম্পদ–যা তার প্রাণধর্ম, অর্থাৎ সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ নিজস্ব মাতৃভাষায় একজন যেমন স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে নিজের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে, তেমনটি অন্য কোন ভাষায় পারে না৷ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে সে অসুবিধা বোধ করে৷ প্রতিনিয়তই যদি অন্য ভাষায় কথা বলিয়ে এরূপ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে তাকে বাধ্য করান হয়, তবে তার প্রাণশক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে–ক্রমশ প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে৷ এই রকম পরিস্থিতিতে সেই ব্যষ্টি বা ব্যষ্টিসমূহের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেবে৷ প্রথমেই তার মধ্যে দেখা দেবে এক ধরণের হীনম্মন্যতা বোধ, যা মানুষের মানসিক দুর্বলতার কারণ৷ যাদের ভাষা অবদমিত হবে তাদের নৈতিক সাহস, উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত তাদের একটা পরাজিতের মনোভাব জাগবে–যা কোন জনগোষ্ঠীর প্রাণ স্পন্দনকে অচিরেই স্তব্ধ করে’দেবে৷
সুতরাং ভাষার অবদমন মানুষের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ এই ধরণের ক্রমাগত অবদমনের ফলে জনগণ কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, ও তাদের অকালে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে৷ এ বিষয়ে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত এই জনগোষ্ঠী মানস–র্থনৈতিক শোষণের চাপে পড়ে’ সব সময় আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকবে৷ এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ভারতবর্ষ সমেত সমস্ত পৃথিবীতে এই ট্র্যাজেডীটাই ঘটে চলেছে৷ তাই প্রত্যেক প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় সমস্ত ভাষাকেই সমান স্বীকৃতি, সুযোগ ও অধিকার দিতে হবে৷ একথা মনে রাখতে হবে যে, এই স্বীকৃতি কেবল তত্ত্বগত ভাবে ও পঠন–পাঠনে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না৷ এ হতে হবে বৈবহারিক–অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনের সকল কর্মে এর স্বীকৃতি দিতে হবে৷ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে–অফিস, আদালত, রেলওয়ে, বিমানবন্দর, ব্যবসা–বাণিজ্য ও সরকারী–বেসরকারী সমস্ত কাজে প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা৷
মাতৃভাষাকে দাবিয়ে রাখলে তার পরিণতি হয় ভয়ানক৷* বাঙলাদেশের উদাহরণই ধরা যাক৷ পাকিস্তান হওয়ার পর উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল৷ কিন্তু (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে) অবিভক্ত পাকিস্তানে জনগণের ৬০ শতাংশ বাংলায় কথা বলতো, আর বাকী ৪০ শতাংশ লোক হিন্দী, বালুচী, পঞ্জাবী ও উর্দু ভাষায় কথা বলতো৷ এই ছিল প্রকৃত ভাষা পরিস্থিতি৷ কিন্তু উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা করায় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) বিদ্রোহ করলো৷ শেষপর্যন্ত পাকিস্তান ভেঙে গেল, ও বাঙলাদেশ স্বাধীন হ’ল৷ সেই সময়ের একটি বিখ্যাত গান–‘ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়’–জনগণের আবেগের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল, আর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবীকে ঘিরে সমস্ত দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ জনগণের আবেগকে বেশীদিন জোর করে’ দাবিয়ে রাখা যায় না৷ মানুষ মাতৃভাষাতেই সব থেকে ভালভাবে নিজেকে প্রকাশ করে’ থাকে, আর সেই মাতৃভাষাকে দাবিয়ে রাখার অর্থ প্রাণধর্মকে হত্যা করা৷
ভাষা–নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ধরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে মেনে না নিয়ে যদি কেউ জোর করে’ বিশেষ কোন ভাষাকে অন্য ভাষার ওপর চপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তবে তা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও উত্তাপকে বাড়িয়ে দেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দেবে৷ এই আত্মঘাতী নীতি উগ্র ভাষান্ধতাকে আরও উস্কে দেবে–যা সমাজের সুস্থ পরিবেশকে কলুষিত করে’ দেবে৷
ভারতে অ–হিন্দীভাষীদের ওপর হিন্দীভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে এক রাজ্যের সঙ্গে আর এক রাজ্যের, ও কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের বৈরী মনোভাব তৈরী হয়েছে৷ হিন্দী চাপিয়ে দেওয়ার ফলে হিন্দীসাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি হয়েছে, আর যারা হিন্দীতে কথা বলে না তারা অবদমিত বোধ করছে৷ উদাহরণস্বরূপ, বিহারে হিন্দী চাপিয়ে দেওয়ার ফলে ভোজপুরী, মৈথিলী, অঙ্গিকা, মগহী ও নাগপুরীর মত প্রধান প্রধান ভাষায় যারা কথা বলে তারা অবদমিত হচ্ছে৷ বিহারের লোকদের যেহেতু নিজস্ব উচ্চারণ শৈলী রয়েছে, সেহেতু তারা হিন্দী ঠিকভাবে উচ্চারণ করতেও পারে না৷ ঠিক এইভাবে কানাডায় ফ্রেঞ্চ, স্পেনে বাস্কে, ও সিসিলিতে সিসিলিয়ান ভাষা অবদমিত হচ্ছে৷
বহু–ভাষী ও বহু–ধর্মমতের দেশ ভারতে কোন একটি স্থানীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা দেশের সার্বিক কল্যাণের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক৷ বস্তুতঃ, ভারতের সমস্ত ভাষাকেই স্বীকৃতি দেওয়া ও উৎসাহিত করা উচিত৷ এ ব্যাপারে ভারতের উচিত অন্যান্য কয়েকটি দেশকে অনুসরণ করা৷ উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডের কথাই ধরা যাক৷ এখানে ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ ও রোমান্শ্ ভাষায় যতলোক কথা বলে, তার দ্বিগুণের বেশী লোক জার্মান ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও, চারটি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ এটাই সঠিক পন্থা–কারণ এই নীতি জনগণের সামূহিক মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায় না৷
সমাজের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে এটা মনে রাখা উচিত যে, সব ভাষাকে সমান সুযোগ প্রদান, ও প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে কোন স্থানীয়ভাষা ও বিশ্ব–ভাষা প্রসারের মধ্যে কোন বিরোধ থাকা উচিত নয়৷ দেখতে হবে যোগাযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসাবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তা যেন অন্য ভাষাকে অবদমন না করে৷