হ্যাঁ, সেই চার ভাই ছিল পণ্ডিত পিতার মূর্খ সন্তান* (*‘সন্তান’ শব্দটি পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহূত হয়৷ সম্–তন্ ঘঞ্ প্রত্যয় করে ‘সন্তান’ শব্দ ৰ্যুৎপত্তিগত ভাবে অবশ্যই পুংলিঙ্গ৷ কিন্তু ব্যবহারে উভয়লিঙ্গ৷ ‘সন্তান’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ দিতে গিয়ে অনেকে ‘সন্ততি’ শব্দটিকেও টেনে আনেন যার কোন প্রয়োজন নেই৷)
ৰড় ভাইটি মূর্খ ও বোকা৷ মেজটি তথৈবচ৷ সেজটিও তথৈবচ৷ কিন্তু ছোটটি মূর্খ হলে কী হবে, ৰুদ্ধিমান–তার ওপর আবার বিদুষক৷ অর্থকৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে চার ভাইয়ের দিন কাটছিল৷ হঠাৎ তারা খবর পেল, এক দেশের রাজা ঘোষণা করেছেন কেউ যদি তাঁকে স্বরচিত কবিতা শোনায়, তাহলে তিনি তাকে উপযুক্ত উপঢ়ৌকন দেবেন৷ কিন্তু কবিতা লেখা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়৷ কারও ভাব আছে তো ভাষা নেই, কারও ভাষা আছে তো ভাব নেই৷ কারও আবার দুইয়ের একটাও নেই৷ যাঁর দুটোই আছে, সে–ই হয় কবি৷ তা না হলে ওই যে, –
‘‘পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির,
তাতে কী বা যায় আসে ভোঁদার পিসীর–’’
মত কবিতাই আসবে৷
রাজা যখন দেখলেন, জোড়া পঙ্ক্তির কবিতা লেখার মত কবি আর কেউই রাজসভায় আসছে না, তখন তিনি বললেন–‘‘এক লাইনের কবিতা হলেও চলবে৷ যেমন, কী যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কী বুঝি তার কিছু৷’’
চার ভাইয়ের মুস্কিল–আশান হ’ল৷ ঘাম দিয়ে ম্যালেরিয়ার জ্বর ছাড়ল৷
ৰড় ভাই বললে–‘‘আম্মো পারি৷’’
মেজ ভাই বললে–‘‘আম্মো লিখতে পারি’’৷
সেজ ভাই বললে–‘‘আম্মো কবিতা লিখতে পারি’’৷
ছোট ভাই বললে–‘‘আম্মো মিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখতে পারি’’৷
তারা ঠিক করলে পরের দিন সকাল সাতটার সময় মাহেন্দ্রযোগে রাজদরবারে কবিতা শোনাতে যাবে৷ শেষ রাত্তিরে কাব্যিক মেজাজ আনবার জন্যে ৰড় ভাই গাড়ু হাতে মাঠে গেল৷ ফুরফুরে হাওয়া বইছে...কবিতার আমেজ আসছে...চাঁদের কালো দাগগুলো দেখে মনে হচ্ছে, সেঁকবার সময় রুটিটা ৰোধ হয় একটু পুড়ে গেছে৷ এমন সময় ৰড় ভাই দেখলে, তার সামনে তিনটে গর্ত৷ গর্ত তিনটেতেই জল৷ তিনটে জলে তিনটে চাঁদ৷ আর আকাশে রয়েছে আর একটা চাঁদ৷ তাহলে পৃথিবীতে আছে মোট চারটে চাঁদ৷ ৰড় ভাইয়ের মনের গহনে কাব্যিক হাওয়া বয়ে গেল৷ সে এক লাইনের কবিতা তৈরী করে ফেললে–‘‘চন্দ্র চারু৷’’ ৰড় ভাই গাড়ু হস্তে দ্রুত পদ–বিক্ষেপে বাড়িতে ফিরে এল৷ আর ভাইয়েদের বললে–‘‘পেয়েছি, পেয়েছি...ইউরেকা ...ইউরেকা৷ এক লাইনের একটি উত্তম মানের কবিতা এখন আমার ঠোঁটস্থ’’৷
মেজভাই আর কালবিলম্ব না করে গাড়ু হাতে সেইদিকেই ছুটল,–বসল গিয়ে একটি ৰকফুলের গাছের নীচে৷ কবিতার মেজাজ আর আসে না৷ চাঁদ ডুবে গেছে...মহা ফ্যাসাদ৷ এমন সময় একটা ৰকফুল তার মাথায় এসে পড়ল৷ মগজে কবিতার ডাঙগুলি খেলে গেল৷ এক পঙ্ক্তির কবিতা সে তৈরী করে ফেললে–
‘মাথায় ফুল পড়ে–ৰকধারু৷’
সে পড়ি–কী–মরি করে গাড়ু নিয়ে ফিরে এল, কারণ খানিক বাদে রাজদরবারে যেতে হবে৷
সেজভাইয়ের আর তর্ সয় না৷ সে গাড়ু নিয়ে যখন মাঠে গিয়ে বসল, তখন সূর্য উঠছে৷...সূর্যের আলোয় তাঁৰার গাড়ু শুধু যে চক্চক করছে তা–ই নয়, গরম হয়েও উঠেছে৷ তার মাথায় কবিতার হা–ডু–ডু খেলে গেল৷ সে এক পঙ্ক্তির কবিতা তৈরী করে ফেললে–‘‘সুর্যের উত্তাপে তাম্র গাড়ু’’৷
সে গাড়ু হাতে দৌড়ুতে দৌড়ুতে বাড়ি ফিরল৷ এমনকি গাড়ুটা পুকুরে ডোবাতেও ভুলে গেল৷ খানিক বাদে তাকে রাজদরবারে যেতে হবে তো
তিনভাই সাজগোজ করে রওয়ানা* (*শব্দটি হিন্দুস্তানী–‘রবানা’৷ অনেকে ভুল করে ‘রওনা’ লেখেন৷) হ’ল৷ ছোট ভাইও ওদের সঙ্গ নিলে৷ দাদারা বললে–‘‘তুই আমাদের সঙ্গে কেন যাচ্ছিস? তুই কি আমাদের মত কবি?’’
সে বললে,–‘‘এতখানি পথ তোমাদের সঙ্গে যেতে যেতে আমার গায়েও কবিতার হাওয়া লাগবে৷ রাজসভায় গিয়ে আমিও কবিতার ট্রায়াল দোব৷’’
চার ভাই যথাসময়ে রাজসভায় এসে উপস্থিত৷ এক এক করে তাদের ডাক পড়ল৷ ৰড়ভাই গিয়ে এক পঙ্ক্তির কবিতা শোনালে–‘চন্দ্র চারু’৷
রাজামশায় খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘একে পঁচিশ টাকা বখ্শিস্ দাও৷’’
মেজভাই এসে শোনালে–‘‘মাথায় ফুল পড়ে ৰকধারু৷’’
রাজামশায় খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘একে পঁচিশ টাকা দক্ষিণা দাও৷’’
সেজভাই এসে এক পঙ্ক্তির কবিতা শোনালে–‘সূর্যের উত্তাপে তাম্র গাড়ু’৷
রাজামশায় খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘একে পঁচিশ টাকা বিদেয়ী দাও৷’’ তারপর ছোট ভাই এসে রাজাকে বললে,–‘‘রাজামশায়, আমি তো মিত্রাক্ষর কবিতা শোনাব৷’’ রাজামশায় বললেন–‘‘উত্তম উত্তম, শোনাও শোনাও৷’’ সে প্রথমে তিন ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে তারপরে নিজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললে–
‘এই যে আমরা চারটি ভাই–গোরু৷’
রাজামশায় সন্তুষ্ট হয়ে খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘এঁকে পঞ্চাশ টাকা প্রণামী দাও৷’’
এখানেই গল্পের শেষ নয়৷ রাজামশায় ছোটভাইটিকে রাজদরবারে বিদুষক হিসেবে চাকরিতে ৰহাল করলেন৷