বৈয়ষ্টিক জীবনে মৌলিক অধিকার সমূহের সুরক্ষা তথা সামূহিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানুষ অনাদিকাল থেকে শৃঙ্খলাসমন্বিত শাসন–ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করে চলেছে৷ এই সকল আইন শাসকশ্রেণীই সময়ে সময়ে তৈরী করেছে ও প্রতিটি আইন থেকে এ ভাবই প্রকট হয় যে শাসক শ্রেণী আইন প্রণয়নকালে তাদের নিজেদের স্বার্থের দিকেই সব থেকে বেশী নজর রেখেছে৷ দৃষ্টান্ততঃ, মনুস্মৃতিতে মনু বিধান দিয়েছেন যে কোন ব্রাহ্মণ শূদ্রকন্যার পাণিগ্রহণ করলে তাকে মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে বসিয়ে শহর পরিক্রমণ করানো হবে, আর শূদ্র যদি কোন ব্রাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করে তবে সেক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে প্রাণদণ্ড৷ এই ধরণের আইন ব্যবস্থা সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব থাকাকালেই গৃহীত হয়েছিল৷ ব্রাহ্মণ–প্রভুত্ব খর্ব হবার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে বাদানুবাদ শুরু হ’ল৷ ব্রাহ্মণ প্রভুত্বের পরেও আরও অনেকে নিজ নিজ স্বার্থের সুযোগ অব্যাহত রেখে বিবিধ আইন রচনা করেছিলেন৷
(‘আনন্দমার্গ এক বিপ্লব’, ‘কনিকায় আনন্দমার্গ দর্শন’, ৩য় খণ্ড)
অনেকে বলে থাকেন যে স্ত্রী ও শূদ্র বেদপাঠের ও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়৷ এও তো ভেদবুদ্ধি৷ ভারতবর্ষের বেদমন্ত্রের রচয়িত্রী নারীরাও ছিলেন৷ অতএব এরূপ উক্তি অযৌক্তিক৷
(‘‘সাধনার রূপ’’, ‘সুভাষিত–সংগ্রহ’, ১ম খণ্ড)
প্রাচীন সমাজে নারী–পুরুষের সমান অধিকার ছিল৷ পরবর্ত্তীকালে যখন গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি কিছু সংখ্যক নারী প্রজ্ঞায়, বৈদুষ্যে, মানবিকতায় তথা মানসিকতায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে গেছলেন তখন একদল ষড়যন্ত্রকারী নারীর মনে হীনম্মন্যতা সৃষ্টির জন্যে একের পর এক তাঁদের অধিকার খর্ব করতে শুরু করল৷ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় নারী ও শূদ্রকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়৷ মানব ইতিহাসে সে ছিল এক মহা দুর্দিন৷ তখন মানুষ মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হ’ল৷ বলতে পারি, শোষণের সাম্রাজ্যবাদিতার ও উপনিবেশবাদের সেটাই ছিল বীজাত্মক প্রাথমিক অধ্যায়৷
অতি প্রাচীন কালে বস্ত্রবয়নের কাজ সাধারণতঃ নারীরাই করতেন কারণ বস্ত্র বয়নকালে যে ভাবে খুঁটিয়ে দেখে কাজ চালাতে হয়, সে গুণ পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যেই ছিল বেশী৷ আজও পৃথিবীর অনেক মানবগোষ্ঠীতে বস্ত্রবয়নের কাজ নারীরাই করে থাকেন আর তা করে থাকেন স্বাভাবিক ভাবেই৷ নারীকে যখন সমাজে অপাংক্তেয় করে দেওয়া হ’ল তখন বস্ত্রবয়ন কাজে রত থাকাটাও ছোট কাজ বলে গণ্য হতে থাকল৷ কিছুসংখ্যক মানুষের কারসাজিতেই এটা হয়েছিল৷ মানুষ গায়ের ঝাল মেটাবার জন্যেই অনেক সময় এই ধরণের কাজ করে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল বাঙলার সুবর্ণবণিকদের প্রতি রাজা বল্লালসেনের ঝাল মেটানোর ইতিকথা৷
বাঙলার রাজকোষ তখন নিয়ন্ত্রণ করতেন কিছু সংখ্যক সুবর্ণবণিক প্রধান৷ তাঁদের মূল কেন্দ্র ছিল সুবর্ণগ্রাম৷ বল্লাসসেন ছিলেন বিলাসী ও অসংযত স্বভাবের মানুষ৷ এজন্যে তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেন অতি মাত্রায় দুঃখিত থাকতেন৷ বল্লালসেন প্রায়ই রাজকোষ থেকে অর্থ চেয়ে পাঠাতেন৷ রাজার আদেশ–তাই রাজকোষ–পরিচালক সুবর্ণবণিকেরা গোড়ার দিকে কোন আপত্তি করতেন না৷ কিন্তু পরে তাঁরা যখন দেখলেন রাজা প্রত্যর্পণের কথা দিয়েও অর্থ প্রত্যর্পণ করেন না, এতে বাঙলার আর্থিক সংরচনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন রাজকুমার লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে কথা কয়ে নিয়ে তাঁরা একবার বল্লালসেনকে বললেন–‘‘মহারাজ, এভাবে টাকা তুলে নিলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে’’৷ বল্লালসেন তখন তাঁদের বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শে ক্রুদ্ধ হয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিমান ধীশক্তিসম্পন্ন এই সুবর্ণবণিক জনগোষ্ঠীকে ‘জল–চল’ বলে ঘোষণা করলেন অর্থাৎ এইভাবে তিনি তাঁর গায়ের ঝাল মেটালেন৷
প্রাচীনকালে ঠিক তেমনি কিছুসংখ্যক স্বার্থপর পুরুষ নারীদের অধিকার খর্ব করে স্ত্রী ও শূদ্রকে অনন্তকাল ধরে পায়ের তলায় পিষে মারার ষড়যন্ত্র সেরে রাখলেন৷ (‘‘ঊত’’, ‘শব্দচয়নিকা’, ২য় পর্ব)