আরেকটা উদাহরণ হ’ল – গান্ধারীর চরিত্র৷ গান্ধারী ছিলেন আফগান মহিলা৷ কান্দাহার
(সংস্কৃতে ‘গান্ধার’) নামে এক দেশ ছিল ও গান্ধারী ছিলেন সেই দেশের কন্যা৷ তৎকালীন ভারতীয়রা কান্দাহারকে বলতেন ‘প্রত্যন্ত দেশ’ – সুদূর সীমান্তবর্তী দেশ৷ খাঁটি ভারতবর্র্ষ বলতে যা’ বোঝায় তা’ নয়৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিরাট চরিত্র–মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গান্ধারী সবিশেষ অবগত ছিলেন৷ কান্দাহারের জনগণ বিশাল ভারতের জনসমাজেরই অন্তর্ভূক্ত ছিলেন৷ বিবাহের প্রাক্কালে যখন গান্ধারী জানতে পারলেন যে তাঁর ভাবী স্বামী অন্ধ, তিনি নিজেই চোখে পটি বেঁধে অন্ধ হলেন৷ যুক্তি দেখালেন, ‘‘যদি আমার স্বামী এই পৃথিবীটাকে দেখতে অসমর্থ হন, তবে আমিই বা সমর্থ হব কেন’’? তাই জন্মের মত তিনিও চোখে কাপড় বেঁধে দৃষ্টিহীন হলেন৷ কতখানি কঠোর নৈতিক বলের অধিকারিণী ছিলেন তিনি সারা জীবনে মাত্র দুবার তিনি চোখের পটি সরিয়েছিলেন – একবার, তাঁর স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে ও আরেকবার, কৃষ্ণকে দেখবার জন্যে৷
ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন ও তার ভাইদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন মাতা গান্ধারীর কাছে গিয়ে যুদ্ধ জয়ের আশীর্বাদ চায়৷ তিনি পুত্রদের আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন জননী গান্ধারীকে অনুরোধ জানায় যেন তিনি পুত্রদের উপর সস্নেহ দৃষ্টিপাত করেন যাতে তাঁর মানস শক্তিসম্পাতের ফলে পুত্রদের শরীরগুলো লৌহের মত সুদৃৃ হয়ে ওঠে৷ গান্ধারী প্রথম দিকে এই সব করতে অনিচ্ছুক ছিলেন৷ কিন্তু যখন ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং গান্ধারীকে সেই মর্মে নির্দেশ দিলেন, তখন গান্ধারী সেটা মেনে নিলেন ও কয়েক মুহূর্ত্তের জন্যে চোখের ওপর পর্দা সরিয়ে ফেললেন৷
ধৃতরাষ্ট্র আগে থেকেই পুত্রদের এই বলে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা যেন জননী গান্ধারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সম্পূর্ণ নগ্ণ অবস্থায় থাকে, কারণ পুণ্যবতী গান্ধারী যখন পুত্রদের দেহের যে যে অংশের উপর স্নেহদৃষ্টি রাখবেন সেই অংশ সুদৃৃ হয়ে উঠবে যা’ শত্রুর সুকঠিন আঘাতেও অক্ষত থাকবে৷ যেহেতু পুত্ররা সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক্ ছিল, তাই তারা মায়ের কাছে যাবার সময় সকলেই কৌপীন পরে গিয়েছিল, একেবারে নগ্ণ হয়ে নয়৷ ফলতঃ দেহের যে অংশ কৌপীনাবৃত ছিল, সেই অংশটা কোমল রয়েই গেল আর বাকী অংশটা লৌহকঠিন হয়ে উঠল৷
পাণ্ডবরা এই বৃত্তান্ত সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত ছিলেন৷ তাই গদাযুদ্ধের সময় ভীম কৌরবদের নাভির নিম্নাংশেই আঘাত করতেন, কারণ নাভির উপরের অংশে আঘাত হেনে কৌরবদের মেরে ফেলা সম্ভব ছিল না৷ অবশ্য নাভির নিম্নাংশে আঘাত হানা সে যুগের প্রচলিত নিয়মবিরোধী ছিল৷ সে যুগে যুদ্ধকে একটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতই মনে করা হ’ত৷ হত্যার জন্যে যুদ্ধযাত্রা মানা হ’ত না৷ তাই যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মগুলোকে মেনে চলতে হ’ত৷ গদাযুদ্ধের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বিপক্ষের নাভির নীচে আঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল৷ কৌরবদের হত্যা করতে গিয়ে ভীমকে প্রচলিত নিয়ম লঙঘন করতে হয়েছিল৷
দ্বিতীয়বার গান্ধারী চোখের পটি খুলেছিলেন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের পর৷ যুদ্ধান্তে সমগ্র কুরুক্ষেত্র একটা মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছিল৷ গান্ধারীর বিধবা পুত্রবধূরা সকলেই তাঁদের নিজ নিজ স্বামীর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করছিলেন, গান্ধারীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷ মাতা কুন্তী সহ পঞ্চপাণ্ডব আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেখানে ঘটনাক্রমে উপস্থিত হন, কারণ পাণ্ডব পক্ষেরও অনেকেই সেখানে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের সাত্ব্ন্না দেওয়া প্রয়োজন ছিল৷ কৃষ্ণ গান্ধারীকে সাত্ব্ন্না দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘আপনি কাঁদছেন কেন? পৃথিবীর এটাই নিয়ম, আপনিও একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন৷ কাজেই কাঁদবেন কেন?
কৃষ্ণকে সম্বোধন করে গান্ধারী প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘‘কৃষ্ণ, তুমি আমাকে বৃথা সাত্ব্ন্না দিতে চেষ্টা করছো৷ এটা তোমায় মানায় না৷’’
কৃষ্ণ জানতে চাইলেন, ‘‘কেন?’’ গান্ধারীর জবাব, ‘‘তুমি যদি এমনটি পরিকল্পনা না করতে, আমার পুত্ররা তাহলে প্রাণ হারাত না৷’’
কৃষ্ণ বললেন, ‘‘ধর্মের রক্ষা আর পাপের বিনাশের জন্যে এমনটি করা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল৷ আমি কিই বা করতে পারতুম আমি তো যন্ত্রমাত্র৷’’
গান্ধারীর বক্তব্য ‘‘কৃষ্ণ, তুমি তো তারকব্রহ্ম৷ তুমি চাইলে অবশ্যই বিনা যুদ্ধে আমার পুত্রদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে পারতে৷’’
সত্যই তা’ হতেও পারত কিন্তু কৃষ্ণকে জগতের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়েছিল – পাপের পতন অবশ্যম্ভাবী৷ তিনি চেয়েছিলেন, যুদ্ধ হোক আর পৃথিবীর মানুষ তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক৷ বিনা যুদ্ধেই যদি তা’ সম্পন্ন হ’ত তাহলে লোকশিক্ষা হ’ত না৷ কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন যদিও তাঁর স্বপক্ষে বলার অনেক কিছুই ছিল৷
মানুষের জীবনে প্রায়ই এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে, যখন তার মনের ভাব ও মুখের ভাষা ঠিকই থাকে কিন্তু তবুও তাকে চুপ করে থাকতে হয়৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই রকম অবস্থা হয়েছিল৷ শ্রীকৃষ্ণ যেমন ভীষ্মের মত কঠোর নীতিবাদীকে সম্মান করতেন, সশ্রদ্ধ সম্ভাষণ করতেন তেমনি গান্ধারীকেও তিনি গুরুত্ব দিতেন৷ তখন গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, ‘‘আমার পরিবারের সদস্যেরা যেমন আমার চোখের সামনে ধ্বংস হ’ল তেমনই তোমার চোখের সামনেই যেন তোমার বংশও ধ্বংস হয়৷’’৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘‘বেশ, তাই হোক’’ আর তা–ই ঘটেছিল৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই অভিশাপকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই তেমনটি ঘটেছিল৷ যদি তিনি স্বীকার না করতেন তাহলে অবস্থাটা অন্য রকম দাঁড়াত৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সেই অভিশাপ স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনোগত ইচ্ছাটা ছিল এই যে নৈতিক শক্তি জনজীবনে গুরুত্ব পাক ও স্বীকৃত হোক৷ অন্যথা যদুবংশ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হ’ত না৷ গান্ধারীর মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যেই শ্রীকৃষ্ণের এই ধরণের আচরণ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ন্যায়–ধর্মের বিজয়কে সুগম করার জন্যেই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন ও তদুদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সব কিছুই করেছিলেন৷
জীবনে চলার পথে যেখানেই তিনি নীতিবাদীর সম্মুখীন হয়েছেন সেখানেই তিনি স্বেচ্ছায় নিজের পরাভব স্বীকার করে নিয়েছেন৷ যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এই পরাজয় স্বীকারটা সঙ্গত হয়নি৷ তোমাদেরও শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে এই শিক্ষাটা মনে রাখা উচিত৷ কোন মানুষ অন্যায়–বিচার করলে তোমরা কোন মতেই মাথা পেতে তা’ মেনে নেবে না৷ শ্রীকৃষ্ণ যেমনটি করেছিলেন, তোমারাও তেমনি দুর্নীতিপরায়ণদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, কিন্তু যদি দেখ কোন মানুষ যথার্থ নীতিবাদী, ধার্মিক, তংক্ষণাৎ নতিস্বীকার করবে৷ তাতে তোমাদের সম্মানই বৃদ্ধি পাবে৷