খুব প্রাচীনকালে যখন মাতৃশাসিত সমাজব্যবস্থা ছিল সেই সময় সমাজে ছিল কন্যারই কদর৷ একজন নারীই হত সমাজের গোষ্ঠীমাতা৷ মানুষ তার নাম ধরে গোত্র–পরিচয় দিত৷ পুরুষেরা সেই গোত্রমাতার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেত৷
সে যুগ চলে গেল৷ পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা থেকে নারীর প্রাধান্য চলে গেল, এল পুরুষের শাসন.......সমাজ হ’ল পিতৃশাসিত৷ মানুষ পিতার পরিচয়ে নিজের পরিচয় দিত৷ সমাজ ব্যবস্থায় প্রবর্ত্তন হ’ল পিতৃগোত্রের ও প্রবরের৷
নারী পরিণত হ’ল পণ্যে৷ নারীর জীবন হয়ে উঠল সম্পূর্ণভাবে পুরুষ নির্ভর৷ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ভাবে এই পুরুষ–শাসন প্রবর্ত্তিত হ’ল৷ আর সেই পুরুষ–শাসনের সমর্থনে নানান ধরণের যুক্তিজাল বিস্তার করা হতে থাকল৷ এক নারীর একাধিক পতি থাকা হয়ে দাঁড়াল হাস্যকর ব্যাপার কিন্তু এক পুরুষের একাধিক নারী থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গণ্য হতে থাকল, কারণ নারী তো তার পণ্য৷
সামাজিক অসমতা চরমে গিয়ে পৌঁছল যখন বিবাহকালে নারীর স্বাধীন সত্তা অস্বীকৃত হ’ল, নারীর পিতা অথবা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অথবা অন্য অভিভাবক যখন বিবাহকালে কন্যাকে দান করতে শুরু করলে৷ বিবাহে পাত্র ও পাত্রীর ভূমিকা হয়ে পড়ল দু’রকম৷ পাত্র মন্ত্রপাঠ করছে বিবাহকালে আর পাত্রী স্থাণুর মত বসে রয়েছে চাল–ডাল–নুন–তেল ইত্যাদি পণ্যের মত....তাকে মন্ত্রপাঠ করতে হচ্ছে না৷ বিবাহকালে তার অভিভাবক তাকে সম্প্রদান করছে যেমনভাবে ভিখারিকে মানুষ চাল–ডাল দান করে থাকে৷ এই যুগের শোষক–মানসিকতার অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন মনু৷ মনুর ধ্যান–ধারণার সব কিছুই যে খারাপ ছিল তা বলছি না৷ তবে এই কন্যাদান প্রথা যে খারাপ তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ কারণ, এতে কন্যার বৈয়ষ্টিক সত্তাটাই অস্বীকৃত থেকে যায়৷ যেহেতু নারী একটি পণ্য বিশেষ তাই পণ্যের কোন দায়াধিকারও ছিল না৷
নারী কোন সম্পত্তির মালিক বলে গণ্য হতেন না৷ বিধবা নারীকে হয় পিতৃগৃহে ভ্রাতা ও ভ্রাতৃজায়ার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হত অথবা শ্বশুরকুলে ভাশুর–দেবরের বোঝা হয়ে থাকতে হত৷ তবে মনু মন্দের ভাল একটা কাজ করে গেছেন–কন্যাদানকালে তিনি সালঙ্কারা কন্যাকে দান করার কথা বলেছিলেন৷ এই অলংকার নারীর কাছেই থাকত ও তা স্ত্রীধন বলেই গণ্য হত৷ এটা নারীর বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি বলে মনে করা হত৷
যেখানে সমাজ অর্ধেকভাবে নারী শাসিত সেখানে কন্যা তার মাতার স্ত্রীধনের অধিকারিণী বলে গণ্য হতেন৷ নর্ত্তকী সমাজেও নারী মাতৃ সম্পত্তির অধিকারিণী হতেন৷ সেই থেকে বিবাহকালে নারী যে বস্ত্র, অলঙ্কার ও অন্যান্য বস্তু লাভ করতেন তাকে সংসৃক্তে বলা হত ঔদ্ধাহিক৷ উৎ–বহ্ ঘঞ্ ঠক্ ঞ্চ ঔদ্ধাহিক৷
ণ্ণ ণ্ণ ণ্ণ
প্রাচীন পৃথিবীতে মানুষ যখন সমাজ সংরচনার প্রথম ধাপে এসে পৌঁছায় তখন তারা ছিল মাতৃশাসিত জনগোষ্ঠী৷ মাতৃগত কুলব্যবস্থা (maternal lineage) তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল মাতৃগত দায়াধিকার (maternal heritage) বিধিও৷ অর্থাৎ তাদের বংশধারার হিসেব রাখা হত মায়ের হিসেবে৷ লোকে কারও নাম জিজ্ঞেস করার পর জিজ্ঞেস করত মাতার নাম কী, মাতামহীর নাম কী, তস্যা মাতার নাম কী.....এইভাবে৷ পুরুষ ও নারী উভয়ের পক্ষেই ছিল এই বিধি৷
বিবাহান্তে পুরুষ শ্বশুরকুলে গোত্রান্তরিত হত অর্থাৎ পত্নী যে পাহাড়ের বসবাসকারিণী অথবা যে গোষ্ঠীমাতার শাসনাধীনা বিবাহকারী স্বামীকেও তাই হতে হত (এখনও বিশ্বের অল্প কয়েকটি জনগোষ্ঠীতে এই বিধি প্রচলিত রয়েছে)৷ দায়াধিকার ব্যবস্থাও ছিল মাতৃগত অর্থাৎ মাতার সম্পত্তি পু––কন্যারা পেত৷ এই অবস্থা পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল৷ এতে একটাই বড় অসুবিধা ছিল, আর তা হচ্ছে এই ব্যবস্থায় সন্তানের মাতৃ–নির্ধারণ হলেও পিতৃ–নির্ধারণ হত না আর পিতৃ–নির্ধারণ না হওয়ায় কারও গুণগত উৎকর্ষ যাচাই করা যেত না৷
মাতৃগত কুলব্যবস্থা ও পিতৃগত কুলব্যবস্থা দু’য়েরই আলোর দিক ও ছায়ার দিক রয়েছে৷ তবে শারীরিক শক্তিতে বলবান হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পুরুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়৷ পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থায়, একটু আগেই বললুম, দোষ–ত্রুটি অনেক থাকলেও লাভ হয়েছিল দুটো৷ প্রথমতঃ মাতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থায় সর্বপ্রকার দায়দায়িত্ব নারীকেই বহন করতে হত যার ফলে তার জীবন হয়ে দাঁড়াত দুর্বিষহ৷
পিতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থায় কিন্তু পুরুষকে অর্থাৎ পিতাকেও দায়দায়িত্বের একটা বড় অংশ বহন করতে বাধ্য হতে হ’ল৷ দ্বিতীয়তঃ দায়িত্ব বণ্ঢনের জন্যে ও পিতৃ–নির্ধারণের জন্যে বিবাহ–ব্যবস্থা প্রচলন করতে হ’ল৷ পিতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থা প্রচলিত হবার পরেও বিবাহ–প্রথার বশীভূত হতে সেকালের মানুষ সহজে চায়নি, অর্থাৎ তারা প্রভুত্বের অধিকারী হতে চেয়েছিল কিন্তু দায়িত্ব স্বীকার করতে চায়নি৷ এই গুরুদায়িত্ব শিবই প্রথম বহন করেছিলেন ও অবিবেকী পুরুষকে বিবাহ–ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হতে বাধ্য করেছিলেন৷
ভারতের বাঙ্গালীদের মধ্যে পিতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে অল্প পরিমাণে মাতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থার প্রভাব আজও রয়ে গেছে৷ এখানে ভাগিনেয় অপু–ক মাতুলের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে গণ্য হয়৷ মাতুলের সন্তান না থাকলে ভাগিনেয় শ্রাদ্ধাধিকারী হয় ও তাকে ত্রিরাত্রি অশৌচ পালন করতে হয়৷ পিতার মৃত্যুতে গোত্রান্তরিতা কন্যাকেও ত্রিরাত্রি অশৌচ প্রতিপালন করতে হয় ও চতুর্থ দিনে একটি চতুর্থী শ্রাদ্ধ করতে হয়৷
কেরলে মাতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থার প্রভাব বাঙলার চেয়ে আরেকটু বেশী৷ এখানে ভাগিনেয় নিজের পিতার পদবী ব্যবহার না করে বাঙলার মত মাতুলের অর্থাৎ মাতার পদবী ব্যবহার করে৷ বাঙলার মত মাতুলের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো হয়ই, তাছাড়া অন্তর্বর্ণীয় বিবাহের সন্তান মাতারাই বর্ণাধিকারী হয়৷ ষোল আনা মাতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থা চলছে এখন কেরল–মেঘালয়ের কোন কোন জনগোষ্ঠীতে৷ যে সময়ে মাতৃপ্রধান সমাজ–ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল সেই সময় মানুষ মাতা, তস্যা মাতা, তস্যা মাতার সন্তান হিসেবে গোত্রাধিগত নাম পেত, মাতাও সেই গোষ্ঠীর প্রবরা রূপে গণ্য হতেন৷ আর সর্বপ্রবরার যে মৌলিকী প্রবরা বা মৌলিকী মাতৃকা তা–ই আদি মাতৃকা........ causal matrix রূপে গণ্য হত৷