নববর্ষের নোতুন ভাবনা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আরও একটা বছর চলে গেল৷ পুরাতন বৎসরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি শেষে নতুন প্রভাত বরণ করে নিল ২০২৫-এর প্রথম সূর্র্যেদয়কে নানা আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে৷ কিন্তু মাত্র একটা দিন৷ হাতে এখনও ৩৬৪টা দিন পুরাতন বছরের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো নিয়ে আর কোন আক্ষেপ নয়৷ এখন আমাদের ভাবতে হবে সামনের দিনগুলো নিয়ে৷ নোতুন বছরে আমাদের কী করতে হবে তার পরিকল্পনাও করে নেওয়া প্রয়োজন৷ আর সেই পরিকল্পনা করে এগিয়ে চলতে হবে৷ থমকে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না৷ জীবনের মন্ত্র চরৈবেতি, চরৈবেতি৷

দেশজুড়ে অর্থনৈতিক দুরবস্থা৷ নৈতিকতাও প্রায় তলানিতে ঠেকেছে৷ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে,সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিবেশ তৈরী করেছে৷ একই ভাষা কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক বন্ধন থাকায় এপারেও তার ঢেউ আসছে৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে দুর্নীতি বিরোধী বলে প্রতিষ্ঠা চাইলেও কালো টাকার বিরুদ্ধে তাঁর হুঙ্কার, আর পাঁচশ’, হাজার টাকার নোট বাতিল, মধ্যরাতে জি.এস.টি প্রচলন, কোনটাতেই প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো মানুষ সুফল পায়নি৷ মোদিজীর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের আশ্বাস দুরাশায় পরিণত করে দেশজুড়ে দুর্নীতির কাল সর্প চারিদিকে কিলবিল করছে৷

দুর্নীতির কালসর্পের ছোবল থেকে এরাজ্যেও রেহাই পায়নি৷ আর.জি.করের ভয়াবহ ঘটনা বছরে শেষ কটা মাস রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে গোটা দেশকে উত্তাল করেছে৷ প্রতিবাদী আন্দোলনও দুর্নীতির কালিমা থেকে মুক্ত থাকেনি৷ চিন্তার বিষয় এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত সম্মানীয় ব্যষ্টি৷

তাহলে কি শিক্ষার কোন মূল্য নেই! শিক্ষা তো কেবল অর্থ রোজগারের জন্যে নয়, চরিত্র নির্মাণের জন্যে৷ মনুষত্ব বিকাশের শিক্ষাই তো আসল শিক্ষা৷ একটা পশু, জন্তু-জানোয়ার সে তো জন্ম থেকেই পশু৷ পশুত্ব তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না৷ আহার, নিদ্রা, ভয়, সংখ্যাবৃদ্ধি---এসব শিখিয়ে দিতে হয় না৷ একটা মানব শিশু কিন্তু জন্ম থেকেই মানুষ হয় না, মানুষ হয়ে জন্মায় না৷ আকৃতিতে মানুষ হলেও প্রকৃতিতে মানুষ হয় না৷ শিক্ষার মাধ্যমে তার মনুষত্বের বিকাশ হয়৷ কেবল স্কুল-কলেজের শিক্ষায় নয়৷ শিশুকাল থেকে নানাভাবে শিশু শিক্ষা লাভ করে৷ তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে, পরিবেশ থেকে৷ পত্র-পত্রিকা, বই, দূরদর্শন---এমনিভাবে শিক্ষার নানান মাধ্যম রয়েছে৷ স্কুল-কলেজ সহ এই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মানুষ শিক্ষালাভ করে৷ আমাদের পরিবেশ এতই দূষিত যে এই নানান মাধ্যম থেকে আজকের মানুষ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করছে---সেই দক্ষতাকে পুঁজি করে অর্থ রোজগার করছে, কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জনে ভাটা পড়ে যাচ্ছে৷ ঠিকমত মানুষ তৈরী হচ্ছে না৷ মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষাটাই হারিয়ে গেছে৷

স্কুল-কলেজের উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আধুনিক উচ্চ শিক্ষার গর্বে বয়ফ্রেণ্ড, গার্লফ্রেণ্ড নিয়ে মাতামাতি করছে৷ রাজনৈতিক দাদাদের প্রেরণায় শিক্ষার অঙ্গনে ছাত্রদের পলিটিক্যাল ডল বানাবার ছাঁচ তৈরী হচ্ছে৷ শিক্ষার অঙ্গন এখন রাজনৈতিক সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে৷ অভিভাবকরা এসব পছন্দ না করলেও প্রতিবাদ করার মত সাহস নেই৷ রাজনৈতিক নেতাদের চোখ রাঙানির ভয়ে সব দেখে বুঝেও তারা নীরব থাকছে৷ তাহলে কোথাও কি একটা মস্ত বড় গলদ থেকে যাচ্ছে? পারিবারিক-সামাজিক অশান্তি দিন দিন তো বাড়ছে৷

জন্ম থেকে যাঁরা লালন-পালন করছেন, কত যত্ন, কত কষ্ট, কত ত্যাগ, ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের সন্তানদের বড় করে তুলছেন, সেই পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের শিক্ষিত সন্তানরা যত্ন নিচ্ছে না৷ অনেক সময় দু’মুঠো খেতেও দিচ্ছে না৷ ভিখারীর মত ব্যবহার করছে৷ অনেক ক্ষেত্রে টাকা বা সম্পত্তির জন্যে খুনও করছে৷ বর্তমানে পত্র-পত্রিকায়, দূরদর্শনে এই খবর তো আমরা প্রায় প্রত্যহই পাচ্ছি৷ তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আধুনিক শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নরকের দিকে? নরকের কল্পনা অবাস্তব হলেও আসলে এটাই তো নরক৷ যে শাস্ত্রকাররা নরকের কল্পনা করেছিলেন, বোধ হয়, এই দূষিত পরিবেশকেই তাঁরা নরক বলতে চেয়েছিলেন৷

না, আজ নববর্ষের প্রাক্কালে আমি কেবল হতাশার ছবি নয়, আত্মসমীক্ষার জন্যেই এই সব বাস্তব ঘটনার কথা বলা হলেও আমাদের হতাশ হয়ে মাথা কুটতে থাকলে চলবে না৷ এই পৃথিবীতে কোন কিছুই থেমে থাকে না৷ অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোথায় কি ভুল-ত্রুটি আছে তা শুধরে নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে৷ পুরাতনের গ্লানি মুছে ফেলে নোতুন বছরে নব প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের যথার্থ প্রগতির পথে চলবার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে৷

যথার্থ প্রগতি কী? অনেকে কেবল বাহ্যিক উন্নতিটাকেই যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের, প্রযুক্তির ক্ষেত্রের উন্নতিটাকেই প্রগতি বলতে চান---না, তা ঠিক নয়, মনের বিকাশ চাই, মনুষ্যত্বের বিকাশ চাই, মূল্যবোধের বিকাশ চাই৷ এটাই তো সভ্যতার পরাকাষ্ঠা৷ এটাই তো সভ্যতার উৎকর্ষ---উন্নতি৷ তাই কেবল বিজ্ঞানের উন্নতি করলেই চলবে না, সভ্যতারও উৎকর্ষ চাই৷ আজ বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে, সভ্যতা পিছিয়ে পড়ছে৷ এটাই আজকের যুগের সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ বাহ্যিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জগতের উন্নতি চাই৷

এটা ভুললে চলবে না, এই অন্তর্জগতের বিকাশের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার ভূমিকাই সর্বাধিক৷ এটাও মানি, এই সর্বাত্মক দূষণের যুগে---এই ভেজালের যুগে আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও দেদার ভেজাল চলছে৷ কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা বাহিত না হয়ে---চোখ-কাণ খোলা রেখে যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করে এগিয়ে চললে নকল সরিয়ে আসলকে চিনে নিয়ে এগিয়ে চলা মোটেই কষ্টকর নয়৷

নোতুন বৎসরে এভাবেই আমাদের এগোতে হবে৷ বিজ্ঞানশিক্ষার পাশাপাশি যথার্থ নৈতিক, আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অন্তরের দেউলিয়াপনা ঘোচাতে হবে৷ বাহ্যিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জগতের উন্নতি সাধনের জন্যে সনিষ্ঠ প্রয়াস চাই৷ ২০২৫ নববর্ষ সার্থক হোক, শুভ চিন্তায় ও শুভ প্রচেষ্টায়৷