তিনি একাই পারলে কলকাতাটাকে সবুজে মুড়ে ফেলতে পারতেন৷ পারেননি কারণ, গত ৩২ বছর ধরে তিনি যত গাছ লাগিয়েছেন অন্যরা তার থেকে কেটেছে অনেক বেশি৷ ফলে কলকাতা যেমন ধূসর ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছে৷ তবে সত্যরঞ্জন দোলুই অক্লান্ত৷ পরিশ্রমী৷ স্বপ্ণ দেখা ছাড়েন না৷ ফলে এখনও যেখানে ফাঁকা জমির খোঁজ পান সেখানে গিয়ে গাছ লাগিয়ে আসেন৷ কোথাও গাছ কাটা হচ্ছে খবর পেলে ছুটেও যান৷ সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেন৷ দেখতে দেখতে এভাবে কেটে গেল জীবনের ৫৪টা বর্ষা৷ বর্ষণকালে সত্যরঞ্জনের কাজ বাড়ে৷ তখন গাছ বসালে সেগুলি শুকিয়ে যায় না৷
ব্রেজিলের তথ্যচিত্র নির্মাতা সেবাস্টিয়াও সালগাদো ও তাঁর স্ত্রী মেলিয়া ডেলউইজ ওয়ানিক সালগাদো প্রায় কুড়ি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ৩২ কোটি একর জমিতে তৈরি করে ফেলেছেন আস্ত একটি অরণ্য৷ তাঁর কথা গোটা বিশ্ব এখন জানে৷ বা এ দেশের অসমের যাদব পায়েং৷ ভালোবেসে গড়ে ফেলেছেন ১৩৬০ একরজোড়া একটি বন৷ তাঁকে ‘ফরেস্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়৷ কিংবা উত্তর প্রদেশের রাম যাদব৷ তিনি একা হাতে ৪০ হাজার গাছ লাগিয়ে একটি জঙ্গল তৈরি করেছেন৷ তিনি গাছে দেবেন বলে দূর গ্রাম থেকে কাঁধে করে বয়ে জল আনতেন৷ সত্যরঞ্জন জায়গার অভাবে এঁদের মতো অরণ্য বানাতে পারেননি৷ পেলে বানিয়ে ফেলতেন৷ তবে তাঁকে যাঁরা চেনেন তাঁরা তাঁকে ‘গাছ কাকু’ নামে ডাকেন৷ শ্যামবাজার, বাগবাজার, হাতিবাগান, কুমোরটুলি ইত্যাদি এলাকায় তিনি এই নামেই বিখ্যাত৷
বাগবাজারের কাছে গ্যালিফ স্ট্রিটের হাট৷ সেখান থেকে প্রতি রবিবার নানা ধরনের গাছগাছালি, সার ইত্যাদি কেনেন সত্যরঞ্জনবাবু৷ বাড়িতে টবে বসান৷ একটু শক্তসমর্থ হলে সে গাছ পুরসভার কোনও পার্কে, বা রাস্তার ধারে ফাঁকা জায়গায় বা কোনও স্কুলের মাঠে বসিয়ে দিয়ে আসেন৷নিয়মিত তাতে জল দিতে যান৷ রক্ষণাবেক্ষণ করেন৷ একটি ছোটখাট কাজ করে পেট চালান৷ রোজগারের টাকার অধিকাংশ যায় গাছের পিছনে৷ ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠেন৷ তারপর ঘুরে ঘুরে গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে লেগে পড়েন৷
রাজা রাজবল্লভ স্ট্রিটের বাসিন্দা বুদ্ধদেব বক্সি জানালেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রজেক্টের কাজে রকমারি গাছের পাতার প্রয়োজন হয়৷ তখনই খোঁজ পড়ে সত্যবাবুর৷ তিনি সেই পাতা সংগহ করে আমাদের দেন৷ মদনমোহন তলা স্ট্রিটের বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা দাস জানান, উনি আমাদের মুশকিল আসান৷ ছেলের স্কুলের প্রকৃতি পাঠে গাছপালার ভূমিকা সংক্রান্ত কোনও বিষয় থাকলে ওঁর দ্বারস্থ হই৷ সহযোগিতাও পাই৷’ কুমোরটুলির কমলা চক্রবর্তী, কাকলি মিশ্ররা বলেন, ‘কোনও গাছের প্রয়োজন হলেই আসি৷ মাটি সমেত গাছ তিনি আমাদের দেন৷ যে কোনও গাছের পাতা দেখলেই উনি বলে দিতে পারেন সেটি কি গাছ৷’
সত্যবাবু দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার লক্ষ্মীপুর গ্রামে থাকতেন৷ মাধ্যমিক পাস করার দু’বছর পর পেটের টানে কলকাতা চলে আসেন৷ উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ার কাছে নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে একটি বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন৷ একদিন ঝড়বৃষ্টিতে গাছ ভেঙে পড়তে দেখেন৷ তারপর অক্টোপাসের মতো তাঁকে গ্রাস করে গাছের প্রতি ভালোবাসা৷ কোনও অনুষ্ঠান, রক্তদান বা স্বাস্থ্য শিবির অথবা বই বিতরণ অনুষ্ঠান কিংবা বিজ্ঞান মেলা থেকে ডাক পেলে পৌঁছে যান৷ চারাগাছ উপহার দেন৷ তিনি বলেন, ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবসেই শুধু গাছ লাগালে হবে না৷ এই উদ্যোগ থাকতে হবে গোটা বছর৷’