যক্ষের প্রশ্ণ

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

মহাভারত একটা ইতিহাস৷ ইতিবৃত্তের যে অংশ শিক্ষাপ্রদ, যার দ্বারা ধর্ম–র্থ–কাম–মোক্ষ্ প্রাপ্তি হয় আর যার মধ্যে নীতিবাক্য থাকে, সেটাই ইতিহাস৷

মহাভারতে আছে যে যুধিষ্ঠিরকে যক্ষ চারটি প্রশ্ণ করেছিল৷ যুধিষ্ঠির মানে যুদ্ধে ভিতরে তথা বাইরে চলতে থাকা সংঘর্ষের মধ্যে যে স্থির থাকে–যুধি স্থির ইত্যর্থে যুধিষ্ঠির৷

প্রশ্ণগুলি ছিল–‘কস্য মোদতে’, সুখী কে ‘কা বার্তা’ সবচেয়ে বড় কথা কী ‘কীম্ আশ্চর্যম্’, সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বস্তু কী ‘ক পন্থা’ সবচেয়ে সত্য পথ কী প্রথম প্রশ্ণের উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন–

          ‘‘দিবস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো গৃহে৷

          অঋণী অপ্রবাসী চ স বারিচর মোদতে৷’’

আট প্রহরের মধ্যে এক প্রহরেও যাদের শাকান্ন জুটে যায়, যে ঋণী নয়, অর্থের জন্যে যাকে ছুটে অন্ধের মত বেড়াতে হয় না, সেই সুখী৷ মানুষের জন্যে শাকান্নই সর্বোচিত৷ অধিক গুরুপাক খাদ্য মানুষের পক্ষে উচিত নয়৷ শরীররক্ষার জন্যে প্রোটিন ইত্যাদির প্রয়োজন আছে কিন্তু মানুষ হাতী হবে না, তাকে মানুষই থাকতে হবে৷ অতএব শাকান্ন বা হালকা ভোজনই করা উচিত৷ ঋণ থাকলে ভয়বৃত্তি কাজ করে৷ টাকার পিছনে দৌড়তে থাকলে মানুষের মন হীন ও স্থূল হয়ে যায়৷ সেইজন্যে এইসব দুর্বলতা যার মধ্যে নেই সেই সুখী৷ যে বস্তু বা চিন্তার ফলে ‘আমিত্ব’ ভাবের বিকাশ কম হয়, তার ওপরেই জীবনধারাকে রাখবে, সেটাই আহারে প্রয়োগ করবে৷ মানুষের ‘আমিত্ব’ বিকশিত, যত প্রশ্ণ তাকে অবলম্বন করেই৷ নিঃসহায় পশুকে নিজের স্বার্থে হত্যা করা অন্যায় নয় যে চিৎকার করছে আর তুমি নিজের স্বার্থে তাকে হত্যা করছ৷ ‘কা বার্তা’র উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন–

          ‘‘অস্মিন মহামোহময়ে কটাহে সূর্যাগ্ণিনা রাত্রিদিবেন্ধনেন৷

          মাসর্তুদর্বীপরিঘট ভূতানি কালঃ পচ্যীতি বার্তা৷৷’’

এই দুনিয়াটা একটা বিরাট কড়াই, এর নীচে অগ্ণিস্বরূপ সূর্য দিন–রাতের ইন্ধন, ঋতু–মাস হচ্ছে কড়াই, কালপুরুষ এই কড়াইতে সমস্ত জীবকে পাক করে চলেছেন৷ সকল জীবের কাছে এটা অজানা৷ এটাই সবচেয়ে বড় খবর৷

কিন্তু ধর্মের তত্ত্ব মানুষের ‘আমিত্বে’র মধ্যে লুকিয়ে আছে৷ তাঁকে পেতে হলে গভীরে প্রবেশ করতে হবে৷ তবেই তাঁকে পাওয়া যাবে৷ পথ পেতে হলে তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ শিক্ষা লাভ করতে হবে যিনি সাধক, আর সাধনার দ্বারা নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পেরেছেন৷ তাঁদের প্রদর্শিত পথেই চলতে হবে৷

‘‘কীম্ আশ্চর্যম্’’৷ এর উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন–

‘‘অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরম্৷’’

উপরি স্থাতুমিচ্ছন্তি আশ্চর্য কীমতঃপরম৷৷’’

প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যমালয়ে যায়৷ যারা তাকে শ্মশানভূমিতে পৌঁছে দেয় তারাও ভাবে যে আমরা অনন্তকাল থাকব৷ শ্মশানভূমিতে কেবল ‘শ্মশান বৈরাগ্য’ বিরাজ করে৷

‘কঃ পন্থা’র উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন–

‘‘বেদাঃ বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্নাঃ

নৈকো মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্৷

ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্৷

মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ৷৷’’

বিভিন্ন বেদের মত বিভিন্ন৷ ঋক্, যজুঃ, অথর্ব–এর কথনের মধ্যেই ভেদ আছে৷ ঋক্ আর যজুর্বেদের পণ্ডিতেরা বলতেন অথর্ববেদী ৰ্রাহ্মণের বাড়ীতে ভোজন করা উচিত নয়৷ স্মৃতি, সমাজনীতিও পৃথক পৃথক কথা বলে৷ সাধারণ মানুষের লক্ষ্যে এটা অত্যন্ত দূরূহ৷ মুনিদের মধ্যেও মতভেদ আছে৷ কিন্তু ধর্মের তত্ত্ব মানুষের ‘আমিত্বে’র মধ্যে লুকিয়ে আছে৷ তাঁকে পেতে হলে গভীরে প্রবেশ করতে হবে৷ তবেই তাঁকে পাওয়া যাবে৷ পথ পেতে হলে তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ শিক্ষা লাভ করতে হবে যিনি সাধক, আর সাধনার দ্বারা নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পেরেছেন৷ তাঁদের প্রদর্শিত পথেই চলতে হবে৷ এই ধরনের প্রশ্ণ আর উত্তরের জন্যেই মহাভারত ইতিহাস৷