প্রভাতী

পবিত্রতা অর্জন

লেখক
কেয়া সরকার

মন থেকে মুছে ফেল যত অবিশ্বাস

তোমাকে যেন বিশ্বাস করি৷

মন থেকে মুছে ফেল যত সংশয়

তোমাকেই যেন বিশ্বাস করি৷৷

মনের কোণে জমে থাকা আবিলতা

সব কিছু মুছে দিয়ে শুদ্ধ করে দাও,

তোমার প্রতি ঐকান্তিক প্রেম

একবার শুধু হৃদয়েতে ধরে দাও৷

আর কিছু চাই না শুধু

তোমাকেই যেন অর্জন করি৷

আমি প্রকৃতির সন্তান

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

মাথার উপর মুক্ত আকাশ

 উদারতার প্রতীক,

সকল সৃষ্টি নিকট আত্মীয়

 প্রিয়জন প্রাণাধিক৷

সূর্য কিরণে উজ্জীবিত হই

 রত থাকি কাজ-কর্মে,

স্নিগ্দ সুষমা মাধুরী ছড়ায়

 তারও কথা জাগে মর্মে৷

বিনিদ্র তারা অলক্ষে দেয়

 সঠিক পথের নির্দেশ,

ভূমিষ্ঠ হয়েছি ধরার ধূলায়

 তাই ভূবন আমার দেশ৷

ঋতুগুলি আসে মোরে ভালবেসে

 ভিন্ন তাদের মাহাত্ম,

বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতু গুলি

 পুলকিত করে চিত্ত!

সাগর আমায় হাতছানি দেয়

 চির উচ্ছ্বল তরঙ্গে,

উদ্দীপনায় ঊর্মিমালায়

 নৃত্যের নানা বিভঙ্গে৷

পাহাড় আমায় পরামর্শ দেয়

 উচ্চ রাখিতে শির,

শত ঝঞ্ঝায় অটল থাকিতে

 মৌন ও ধীরস্থির৷

আমার তরে শ্রাবণ ঝরে

 করি পূর্ণ অবগাহন,

 শিস দিয়ে বলে দখিনা পবন

 চির সুন্দর মহাজীবন!

বজ্রপাতে, তুষার ঝড়ে

 যবে মুখোমুখি হই বিপদে,

পরমা প্রকৃতি অতি কৃপা করে

 রাখে মোরে নিরাপদে৷

আঁকাবাঁকা নদী উচ্ছ্বল গতি

 জীবনে লক্ষ্য সিন্ধু,

আমি অনুমন অসীমের মাঝে

 হারানো একটি বিন্দু৷

আমি প্রকৃতির স্নেহের পুত্র

 মানব ধর্ম, শিব গোত্র,

ধর্ম প্রচারে যত্রতত্র

 কীত্তনে মজে অহ-রাত্র৷

‘প্রকৃতি’ যে তাঁর প্রেমের রচনা,

 রচিয়াছে এক অবিচ্ছিন্ন বাঁধন,

এ ভূবন তাঁর লীলার ভবন

 ব্রহ্মান্ডের অমৃতসদন৷

অগস্ত্যপত্নী–কৌশিতকী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কৌশিতকী ছিলেন মহর্ষি অগসেত্যর পত্নী৷ মহর্ষি অগস্ত্য তাঁর জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন আদর্শের প্রচারে, মানবিকতার সম্প্রসারণে৷ তাঁকে এই কাজে প্রতি পলে বিপলে সাহায্য করে থাকতেন তাঁর স্ত্রী কৌশিতকী৷ কৌশিতকী ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী মহিলা ও ব্যাপক মানব হূদয়ের অধিকারিণী৷ কখনও অগস্ত্য তাঁকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ করাতেন, কখনও বা তিনিও নব নব ভাব–তত্ত্ব উদ্ভাবনের দ্বারা মহর্ষি অগস্ত্যকে নির্দেশনা দিতেন৷ এই ভাবে উভয়ে মিলেমিশে কাজ করে গেছলেন মানব জীবনে দেবত্ব ভাবের উত্তরণের জন্যে৷

তোমরা জান, প্রাকৃতিক বিচারে ভারতের দক্ষিণাংশ দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্য নামে পরিচিত ও উত্তরাংশ উত্তরাপথ বা আর্যাবর্ত নামে পরিচিত৷ দক্ষিণাপথের মধ্যমাংশ সুপ্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ আর্যাবর্তের দক্ষিণ দিকের কিছুটা অংশও প্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ বাকী অংশ হিমালয় বা তার পাললিক উপাদানে গঠিত ছিল৷ দক্ষিণাপথের মূল স্রোত এসেছিল দ্রাবিড়ী সাংস্কৃতিক অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা হয়েছিল ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত৷ উত্তর ভারতীয় সভ্যতা এসেছিল ককেশীয় অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা ছিল প্রতি অনুপলে অভিস্পন্দিত৷ উত্তরাপথের নিম্নাংশ ছিল সম্পূর্ণভাবে রাঢ়ীয় সভ্যতার উৎসারণ৷ আমরা আজকাল যাকে বাঙালী সভ্যতা বলি তা–ই রাঢ়ীয় সভ্যতার সঙ্গে গাঙ্গেয় তথা ব্রহ্মপুত্র সভ্যতার ত্রিবেণীসঙ্গম৷ বাঙালীর সভ্যতা অনেক দিনের পল্লবিনী রূপ, তা এতটা মাধুর্যময় হয়ে উঠেছিল এই কারণে যে তাতে ঘটেছিল নানান ধরণের বৈপরীত্যের মাধ্বী সংস্থিতি৷

হ্যাঁ, আসল কথায় ফিরে আসা যাক৷ মহর্ষি অগস্ত্য ঠিক করলেন তিনি বিন্ধ্য পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়ে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটাবেন, দক্ষিণাপথকে উত্তরের কাছে টেনে আনবেন৷ তিনি নাকি কৌশিতকীকে বলেছিলেন–‘‘চলো, আমরা দুজনেই যাই’’৷ কৌশিতকী নাকি বলেছিলেন–‘‘না, সেটা ঠিক হবে না৷ দু’জনে এক প্রত্যন্তে গেলে অন্য প্রত্যন্ত খালি থেকে যাবে৷ দক্ষিণাপথে যাবার প্রয়োজন রয়েছে৷ তাই তুমি দক্ষিণাপথে নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকার সঙ্গে ভাব বিনিময় করো৷ আর আমি উত্তরাপথে থেকে সকলের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে যাই’’৷ তাই কৌশিতকী অগস্ত্যের সঙ্গে দক্ষিণাপথে গেলেন না৷ তিনি আর্যাবর্তেই থেকে গেলেন৷

তোমরা জান যে সঙ্গীতের (নৃত্য, বাদ্য ও গীত তিনে মিলে সঙ্গীত) স্রষ্টা শিব আর এ ব্যাপারে তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন মহর্ষি ভরত৷ এই ভারতীয় সঙ্গীত বা শিবদত্ত সঙ্গীত উত্তর ভারতে একটি ধারায় ও দক্ষিণ ভারতে আরেকটি ধারায় প্রবাহিত৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান, গাছ–ফুল–ফল–বীজ সবই দীর্ঘকাল ধরে এক পরিবেশে থাকলে তার মধ্যে একটি পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য জেগে যায়৷ একই ল্যাংড়া আম কাশীতে, বারুইপুরে ও মালদায় দেখবে, ১০০০ বছর পরে তাদের পাতায় বর্ণে স্বাদে গন্ধে অনেক পরিবর্তন এসে যাবে৷ এই পরিবর্তনকে বলি পরিবেশগত পরিবর্তন (environmental change) শিবদত্ত সঙ্গীতও তাই উত্তর ভারতে এক খাতে ও দক্ষিণ ভারতে আরেক খাতে বইছিল৷ উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতকে আর্যাবর্ত সঙ্গীত বা হিন্দুস্তানী সঙ্গীত ও দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতকে দাক্ষিণাত্য সঙ্গীত বা কর্ণাটক সঙ্গীত বলা হয়৷ তেমনি চাল–চলনে, আচার–ব্যবহারে দুয়েতেই কিছুটা environmental change বা পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছিল...যা আসা খুবই স্বাভাবিক৷

উত্তর ভারতেও পশ্চিমে ও পূর্বে এই পরিবেশগত পার্থক্য খুবই প্রকট৷ আর এই প্রকটতা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছিল বাঙলায় যেখানে সভ্যতায় ঘটেছিল ত্রিবেণীসঙ্গম৷ জাত হিসেবে বাঙালী মুখ্যতঃ অষ্ট্রিকো–মংগলো–নিগ্র্৷ যত দূর জানা যায় মহর্ষি অগস্ত্য বাঙলায় আসেননি৷ এলে উত্তর ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাঙলার ভাব–বিনিময় অনেকটা বেশী হয়ে যেত৷

যাই হোক, এবার একটু গল্পকথায় আসা যাক৷ গল্পে আছে যে এই বিন্ধ্য পর্বতের শির ছিল উত্তুঙ্গ৷ এ কথা ঠিকই যে প্রাচীন গণ্ডোয়ানাভূমির পাহাড়গুলি ছিল খুবই উঁচু–চির তুহিনাবৃত৷ জলে ঝড়ে উপলসংঘাতে তারা ক্ষয়প্রাপ্ত eroded হতে থাকে৷ তাই আজকের যে বিন্ধ্য তা’ এককালে যে খুবই উঁচু ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ যাই হোক, গল্পকথা অনুযায়ী বিন্ধ্য পর্বত খুবই উঁচু ছিল৷ তাই উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া সহজসাধ্য ছিল না৷ মহর্ষি অগস্ত্য যখন বিন্ধ্যের কাছে এলেন, বিন্ধ্য তাঁকে সম্মান জানাবার জন্যে আভূমি প্রণত হ’ল৷ অগস্ত্য চেয়েছিলেন উত্তর–দক্ষিণের ভাব বিনিময়৷ তিনি বিন্ধ্যকে বললেন–জীতে রহো বেটা৷ কিন্তু যতদিন না আমি ফিরছি ততদিন তুমি মাথা নীচু করে থাক৷ আমি দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে এলে এই প্রণামটিতেই তোমার সেই সময়কার প্রণাম সেরে নেওয়া হবে৷

অগস্ত্য দক্ষিণে গেলেন, আর ফিরলেন না৷ বিন্ধ্য মাথা নীচু করে রয়ে গেল, আর উঁচিয়ে উঠল না৷ উত্তরে–দক্ষিণে ভাব বিনিময় অব্যাহত গতিতে চলতে লাগল৷ অগস্ত্য ফিরে এলেন না৷ তাই সেই থেকে কেউ যদি কোথাও গিয়ে আর না ফেরে আমরা তাকে বলি অগস্ত্য–যাত্রা৷

 

যা ভাবছ তা নয়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘মৃগী’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে একটি স্নায়ু–সংক্রান্ত মানসিক ব্যাধি, ইংরেজীতে (epilepsy)৷ যদি কোনো কম বয়সের ছেলে বা মেয়ে হঠাৎ কোনো অভাবনীয় কিছু দেখে বা শোনে তাহলে অনেক সময় তার স্নায়ুর ওপর বা মনের ওপর হঠাৎ একটা ৰড় রকমের চাপ এসে পড়ে৷ সেই চাপ সে যদি সহ্য করতে না পারে তখন তার এই মৃগী রোগ দেখা দেয়৷ যেমন ধরো, একটি ১২/১৪ বছরের ছেলের ধারণা ছিল, অমুক লোকটি কোনো নেশার ধারেকাছে যান না৷ হঠাৎ সে দেখলে সেই সংশ্লিষ্ট লোকটি বোতলের পর বোতল মদ খাচ্ছে৷ ফলে তার আগেকার ধারণার ওপর বিরাট একটা হাতুড়ির আঘাত লাগল৷ এর ফলে তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ কোনো একটি ছেলের ধারণা ছিল যে সে সদ্বংশজাত কিন্তু হঠাৎ সে শুনতে পেলে তার বংশ পরিচয় নেই৷ এই অবস্থায় তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ মৃগী রোগীর জীবনে স্নায়ুতন্তুর ওপর হঠাৎ কোনো আরামদায়ক পরিস্থিতি এলেই রোগ ফুটে ওঠে৷ কোনো মৃগী রোগীর অনেকক্ষণ ধরে মূত্র ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে৷ কিন্তু উপযুক্ত স্থান না পাওয়ায় মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায়নি৷ এখন সে যখন মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায় তখন তার স্নায়ুতে একটা আরামের অবস্থা আসে৷ এমন সময় মৃগী রোগী মূত্র ত্যাগ করতে করতে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে যায়৷ কোনো মৃগী রোগী হয়তো দারুণ গরমে কষ্ট পাচ্ছে, এমন সময়ে সেই কষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে সে পুকুরে বা নদীতে স্নান করতে গেল৷ জলের সংস্পর্শে এসে তার আরাম ৰোধ হল৷ এমন অবস্থায় রোগগ্রস্ত হয়ে সে জলে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে৷ এই কারণে কোনো মৃগী রোগীকে একলা কখনই কোনো জলাশয়ে স্নান করতে যেতে দিতে নেই৷

‘মৃগী’ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল৷ একবার কৃষ্ণনগরের এক পাঁড় মাতাল ৰেশী মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে রাত্তিরটা নালীতে শুয়ে কাটালে৷ শেষ রাতের মিষ্টি মিষ্টি ফুরফুরে হাওয়া ও ঠান্ডা নালীর জলের মধুর স্পর্শে তার নেশার ঘোর যখন কিছুটা কেটে গেল সে চোখ মেলে চেয়ে দেখলে তাকে ঘিরে লোকের ভীড় জমেছে৷ তার তখন একটু একটু লজ্জা করতে লাগল৷ সে আবার চোখ বুজে ফেললে৷ খানিক বাদে আবার সে চোখ খুলে চাইল৷ চেয়ে দেখলে ভীড়ের লোকেদের ভেতর তার বেয়াই মশায়ও (বৈবাহিক) রয়েছেন৷

এবার তার লজ্জার মাত্রা গেল আরও ৰেড়ে৷ বেয়াই তাহলে আসল ব্যাপারটা জেনেই ফেলেছে৷ এবার কী হবে! সে তখন বেয়াইয়ের দিকে চেয়ে বললে–বেয়াই, ও বেয়াই, বেয়াই গো, শুনছ, তুমি যা ভাবছ এটি তা নয়–এ আমার মৃগী রোগ৷

                                       (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘গল্প সঞ্চয়ন’ থেকে)

পরোপকারী

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কোলকাতার বউবাজারের পথে দাঁড়িয়ে এক সবজিওয়ালা চেঁচাতে লাগলো---বাবু, আমার ঝাঁকাটা একটু মাথায় তুলে দিন না..? ও বাবু, একবারটি ধরুন-না ঝাঁকাটা?...

সবজিওয়ালা যাচ্ছিল বাজারে৷ পথে এক ক্রেতার কথামতো ঝাঁকাটা নামিয়েছিল৷ ক্রেতা জিনিস কিনে চলে যাবার পর আর সে পারলো না ঝাঁকাটা তুলতে৷ ঝাঁকাটা বেশ ভারি ছিল কিনা৷

সামনে দিয়ে যেই যায় তাকেই সবজিওয়ালা অনুরোধ করে, বাবু, ঝাঁকাটা একটু তুলে দিন-না?

কিন্তু কেউই তার কথায় কান দিল না৷ সকলেই ব্যস্ত৷ বিশেষত একটা মুখ্যু গেঁয়ো চাষীর ঝাঁকা তুলে মান হারাতে এগিয়ে এলোনা কেউই, পরোপকারের চাইতে আত্মসম্মানটা এতোই বড়!

অগত্যা কি আর করা যায়৷ দেরি হলে বাজারে জায়গা মিলবে না আনাজও বিক্রি হবে না৷ সবজিওয়ালা তাই হতাশ মনে নিজেই ঝাঁকাটা তুলতে লাগলো৷ কিন্তু বারবারই সে বিফল হলো৷

এমন সময় চোগা চাপ কান-পরা এক ফিটফাট ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন বললেন, নাও তোলো আমি ধরছি৷

সবজিওয়ালা তো অবাক! এমন ঝকঝকে তকতকে বাবু কিনা তার ময়লা ঝুড়িতে হাত লাগালো৷

ঝাঁকাটা মাথায় তুলে সবজিওয়ালা বাবুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালো৷

জানো, কে এই বাবুটি? ইনিই হলেন রাজা রামমোহন রায়৷ মানুষের সেবা, মানুষের উপকারে তিনি কখনো পরাঙ্মুখ হতেন না৷ মানুষ যখন অসহায় তখন তাকে সাহায্য করাই তিনি পবিত্র কর্তব্য মনে করতেন---সেক্ষেত্রে ঠুনকো আত্মমর্যাদা বা বাবুয়ানাতে তিনি মোটেই প্রশ্রয় দিতেন না৷ এটাই যথার্থ শিক্ষা৷ আশা করি, এই শিক্ষাই রাজা রামমোহনের জীবন থেকে তোমরা গ্রহণ করবে৷

মধুময় প্রীতি

লেখক
সুকুমার রায়

রাতের কালোয় খুঁজি আলো

আর সহে না, প্রদীপ জ্বালো

মন মানে না চলব দুলে,

অনিত্য ধরার, দোয়ার খুলে

নবিন আশায়, নবিন দেশে

নন্দনলোকের ছন্দে মিশে৷

তুমি হে, প্রিয়তম মোর এসেছ ধরায়

প্রীতিতে বেঁধেছ সবারে স্নেহচ্ছায়,

জানিনা কত আনন্দ ওগো, তোমার তরে

দাও সে নয়ন জোরে দেখি প্রাণভরে,

সুখে-দুঃখে তুমি সবার চিরসাথী

যুগে যুগে এসেছ নিয়ে মধুময় প্রীতি৷

 

জাগাও মানবতা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তিরিশে এপ্রিল আসে--------

ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ বেলায় অশ্রুতে আঁখি ভাসে৷

অসহায় প্রাণ জর্জরিত হল

নির্মম আঘাতে,

মর্ত্যভূমির বীর পুঙ্গবেরা ছিল নাতো রাজপথে!

পরমাত্মা ও মহাত্মার মাঝে পাপাত্মা করে খেলা,

অহংকারের মিথ্যা দম্ভে অপকর্ম সারা বেলা৷

জড়বাদী মন থাকে সর্বক্ষণ

পাপাচারে আবদ্ধ,

কোনো বিরোধিতা মানিতে নারাজ

শুনিলেই হয় ক্ষুব্ধ!

পরের স্বার্থে দধীচির দান

দেবাত্মারই ধর্ম,

ধরনীতে তাঁরা আসা যাওয়া করেন

সারিতে আপন কর্ম৷

প্রাতঃস্মরণীয় চির বরনীয়

মহারণে জয়ী বীর,

মহাপ্রেরণায় তাঁহাদের ন্যায়

উন্নত হোক শির৷

তিরিশে এপ্রিল আসে বারেবারে --

ডাক দিয়ে যায় মানবতার দ্বারে

জাগ্রত হোক সুপ্ত মানবতার,

আসুরিক শক্তি বিলোপ সাধনে

জীবন উৎসর্গ হোক বারংবার৷

ব্যথিত হৃদয়ে মানুষের আজ শপথ নেওয়ার দিন,

সময় হয়েছে শুধিতে হবে অতীতের রক্ত ঋণ৷

গাওয়াও আমায় গান

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান--       

যেই গানেতে প্রাণে প্রাণে জাগবে মহাপ্রাণ--

যেই গানেতে ফুটবে আশা

মধুর হবে ভালবাসা---

যেই গানেতে আমার তো নয় তোমারি সম্মান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷

আড়াল হতে বাজিয়ে বাঁশী

জীবনে মোর দাঁড়াও আসি,

সংঘাতে সংঘাতে তোলো এগিয়ে চলার তান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷

প্রশ্ণ হানে মানবতা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

সেদিনও এসেছিল অন্ধ নিশা অবসানে শুভ্র প্রভাত

নব রবির আলোক নির্ঝর-স্নিগ্দ প্রকৃতিবক্ষে বিহগের কলগুঞ্জন

একে একে জেগেছে মানুষ, নবশক্তি সম্পাতে কেটেছে অবসাদ

নব চেতনায় সমৃদ্ধ সবে উন্মুখ, আরব্ধ করিতে সম্পাদন৷

মহাজীবনের আহ্বানে তাপস-তাপসী অগণিত দলে দলে

ত্যাগব্রতে বলীয়ান, সেবাব্রতে মহীয়ান, সঁপেছে অমূল্য জীবন

নিঃস্বহায় আর্তত্রাণে, বিশ্বমানবতার বেদীমূলে

সত্য-ধর্মের মহামন্ত্রে ধবনিত বিশ্বের মহাজাগরণ৷

প্রমাদ গণেছে নিকষ অন্ধকারের জীব, নররূপী হায়নার দল

পাশবিক শক্তি মদমত্ত, মানবতার শত্রু, পাতক, মিথ্যাচারী

অনাথ-আশ্রয়হীন শিশুকল্যাণে যারা বিছায়েছে মমতার কোল

দুরভিসন্ধি সাধনে কুচক্রী তাহাদের ‘ছেলেধরা’ অপবাদে বিষায়েছে নগরী৷

বিরাশির তিরিশে এপ্রিল, সুন্দর সকাল, তিলোত্তমা কলকাতা ক্রমশ কর্মব্যস্ত

সহসা ধাবমান ঘোর বন্য আঁধার, আদিম পৈশাচিক বর্বরতা

অসভ্যের হিংস্র হুঙ্কারে বিজন সেতু, বণ্ডেল গেটে নিরীহ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত

উন্মত্ত পাষণ্ডের নির্লজ্জ তাণ্ডবে কলঙ্কিত হ’ল মানব সভ্যতা৷

নিরস্ত্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী, পীড়িত সেবায় সদা তৎপর

ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত রাজপথে সপ্তদশ মানবদেহ ভূলুন্ঠিত

যন্ত্রণা কাতর দেহে পেট্রোল ঢালি, জ্বালিল অগ্ণি শয়তান-প্রবর

শ্বাপদকুলের জঘন্য উল্লাসে বিজন সেতু-বণ্ডেল গেট হ’ল প্রকম্পিত৷

সপ্তদশ দধীচির জ্বলন্ত দেহ, আকুল আর্তনাদ, অসহায় হাহাকার

প্রতি বৎসর তিরিশে এপ্রিল আসি মানুষের দরবারে মাগে বিচার

অজস্র ধিক্কারে প্রশ্ণ হানে মানবতা, সভ্যতার কি আজ সত্যিই দুঃসময়

নাকি ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠায় বিচারের অমোঘ নির্ঘোষ ধবনিবে নিশ্চয়ই?

ৰেফাঁস কথার ফ্যাসাদ 

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খরগ্রহ’ শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হল যেখানে  অনেক গাধা রয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে এক-একটি মানে হল গাধার আস্তাবল৷  দ্বিতীয় মানে হচ্ছে প্রাচীনকালে যখন দ্রুতগামী যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না তখন রাজপথ ধরে দূর দূরান্তে মানুষ চলত পদব্রজে৷ অবস্থাবান মানুষেরা ও নারীরা চলতেন শিবিকায় (দোলায়)৷ পাল্কী জিনিসটা তখনও আমাদের দেশে আসেনি৷ ওটি  এনেছিলেন ইয়ুরোপীয়রা৷ Palanquin’ শব্দ  থেকে ‘পাল্কী’ শব্দটি এসেছে৷ এই শিবিকা বা দোলার ব্যবহার  নারীদের জন্যে  তো করতে হতই, অবস্থাপন্ন মানুষেরাও বেশী দূর যেতে হলে শিবিকায় বা দোলায় যেতেন৷ ছোটখাট দোলা (দ্বিদোলা) দু’জন লোক কাঁধে বহন  করত৷ আর বড় দোলা বহন করত চারজন  লোকে (চতুর্র্দেলা)৷ দূর পাল্লার পথে গো-শকট, গর্দভ-শকট, ঘোটক শকটের ব্যবস্থা তো ছিলই৷ তবে  সাধারণতঃ মালবাহী শকটের জন্যে  গর্দভ শকট অধিক ব্যবহৃত হত৷  এই ‘শকট’ শব্দ থেকে ওড়িয়ায় ‘শগর’ শব্দটি  এসেছে৷

 যাইহোক, সরকারী ডাক ও কিছুটা বে-সরকারী ডাক বহনের  জন্যেও ঘোটক-শকট অথবা অশ্বারোহী মানুষ কাজ করে দিত৷ দূরগামী মানুষ ও শকটের  জন্যে প্রতি যোজন অন্তর (আন্দাজ ছ’ক্রোশ বা ৰার মাইল) একটি করে চটি (প্রাচীন তামিলে চউলট্রি ও সংস্কৃতে ‘চউট্রি’, বাংলায় ‘চটি’ শব্দ এসেছে) বা সরাই থাকত৷ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের জন্যে আজও এই ধরনের চটি রয়েছে৷ আমাদের আসানসোলের কাছে রয়েছে নিরসাচটি, বর্ধমানের কাছে নঈসরায়, মুঙ্গেরের কাছে রয়েছে পূরসরায় ও সোফিয়াসরায়, কাশীর কাছে রয়েছে মোগল সরায়৷  তা সেই  সরকারী সরক ধরে যে যোজনান্তর চটি বা সরায় থাকত সেখানে যাত্রীদের জন্যে জ্বালানী কাঠ, জল ও কাঁচা খাদ্যের ব্যবস্থা থাকত৷  লোকেরা নিজে রেঁধে খেতেন৷ যাঁরা রাঁধতে পারতেন না তাঁদের জন্যে রেঁধে দেবার লোকও থাকত৷  এই চটি বা সরায়ের  কাছাকাছি জায়গায় থাকত খরগৃহ, যেখানে  পরিশ্রমে ক্লান্ত পশুরা বিশ্রাম নিত,তাদের  দানা-পানী পেত৷ যাঁরা ডাক বহন করতেন (ডাকহরকরা) তাঁরা ওখানে এসে অনেক সময় বিশ্রাম নিতেন! আবার  অনেক সময়  কর্মচারী-বদলও ওই স্থানে  করে দেওয়া হত৷  কর্মচারী বদলের সঙ্গে সঙ্গে  অনেক সময় বাহক  পশু বা শকটের  পরিবর্তনও করে দেওয়া হত৷ এখন তোমরা উত্তর ভারতের  দিকে  যাবার সময় বিহার ও উত্তর প্রদেশের পথপার্শ্বে কিছু কিছু এই ধরণের  গুমটি হয়তো দেখে  থাকবে৷ তা’ পশুদের জন্যে নির্দিষ্ট সেই গুমটিতে গোরু, গাধা, ঘোড়া, যাই থাকুক না কেন তাদের সাধারণ শব্দ ছিল ‘খরগ্রহ’৷

খরগ্রহের  কথা বলতে গিয়ে একটি গল্পের কথা মনে পড়ল৷ একবার এক স্কুল-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ পণ্ডিত মানুষ তো ছিলেনই, সংস্কৃতে ছিল তাঁর অসামান্য দখল৷ যে বিদ্যালয় পরির্দশনে গেছলেন সেখানকার সংস্কৃতের পণ্ডিত মশায়ও ছিলেন ধুরন্ধর পণ্ডিত৷ মানুষটি বেশ ভাল, তবে একটু স্পষ্টবাদী৷ ইন্সপেক্টর সাহেবের বিদ্যালয়টির কোন কিছুই পছন্দ হল না৷ সংস্কৃতের ক্লাশে  গিয়ে তিনি তো রেগেই টং৷ পণ্ডিতজীর দিকে তাকিয়ে রোষকোষায়িত নয়নে বললেন--- এটি কি বিদ্যালয়, না  ‘খরগ্রহ’ (গাধার ঘর) ?

পণ্ডিত মশায় তাঁর কথাটা গায়ে না মেখে হাসতে হাসতে  ৰললেন--- একটা অনুরোধ রাখবেন স্যর?

ইন্সপেক্টার সাহেব বললেন--- কী অনুরোধ! কিসের অনুরোধ! কেন অনুরোধ!

পণ্ডিতজী ৰললেন--- আপনি  দয়া করে দরজার চউকাঠের  বাইরে দাঁড়ান স্যার, নইলে আমি মনে অত্যন্ত ব্যথা পাব৷

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন--- আমি ঘরে থাকলে ব্যথা পাবেন, আর আমি চউকাঠের বাইরে দাঁড়ালে ব্যথা দূর হবে, এ কেমনতর কথা৷

পণ্ডিতজী বললেন--- ‘‘খরগ্রহ’’ মানে যে ঘরে গাধারা থাকে৷ আমরা তো গাধা আছিই...ছিলুম... থাকবও৷ কিন্তু আপনাকে আমরা একমূহুর্তের জন্যেও  গাধা বলে ভাবতে চাই না৷ তাই  আপনাকে  অনুরোধ করছি আপনি  ঘরের বাইরে থাকুন৷                    

‘খর’ সম্বন্ধে আরো একটি ছোট্ট গল্প মনে পড়ল৷ একবার নাকি পাটনা সচিবালয় থেকে কোন একজন বি.ডি.ও, সাহেবের কাছে একটি পত্রাঘাত গেছল যে তিনি যেন আগামী চবিবশ  ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেন তাঁর ব্লকে কতগুলি ‘খর’ অর্র্থৎ গাধা আছে৷

তোমরা সেই পটনা সচিবালয়ের গল্প জান তো? একবার আকল্‌মন্দ সিং বাঁকীপুর রেল ইষ্টিশান থেকে (এখন ইষ্টিশানটির নাম হয়েছে পটনা জংশন) সেক্রেটারিয়েট যাচ্ছিলেন৷ ইষ্টিশনে তিনি রিক্সাওলাকে বলেছিলেন--- ‘‘মুঝে সচিবালয় লে চলো’’৷

রিক্সাওলা তাঁর কথা ৰুঝতে না পেরে ৰলেছিল--- সা’ব,রাষ্ট্রভাষামে ৰোলিয়ে, সচিবালয় মুঝে মালুম নেহী হৈ৷ আকল্‌মন্দ সিং ৰলেছিলেন---  সচিবালয় তুমহে মালুম নহীঁ?  সচিবালয়! সচিবালয়! জিস্‌কো আংরেজীমেঁ সেক্রেটারীয়েট  কহতেঁ হৈ৷

রিক্সাওলা তাকে বলেছিল--- বহী ৰোলিয়ে সেক্রেটারীয়েট, আপ রাষ্ট্রভাষা মেঁ  কিঁউ নহী ৰোলতে হেঁ?  কিঁউ আপ আংরেজীমেঁ ‘সচিবালয়’ ‘সচিবালয়’ ৰোলতা হেঁ? আজকাল আংরেজী কা জমানা নহীঁ হৈ৷

তা’সে যাইহোক, সেই পটনা সচিবালয় থেকে পত্র দণ্ডটি পেয়ে বি.ডি.ও সাহেব তাঁর বি. এল ডব্লিউ Village  level worker)  বা গ্রামসেবককে বললেন---তিনি যেন চবিবশ ঘন্টার মধ্যে তথ্যটি পটনা সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেন৷ বি.এল. ডব্লিউ. তো খবরটা শুণে ভয়ে চক্ষুস্থির ৷ চবিবশ ঘন্টার মধ্যে  সে কী করে তাদের বাহাত্তরটি গ্রামে গিয়ে গাধার সংখ্যা নিয়ে আসবে৷ যখন তেইশ ঘন্টা উর্ত্তীণ হয়ে গেল তখন বি.ডি. ও  সাহেবের  কাছে  গিয়ে কেঁদে  কেটে আছড়ে পড়ে বললে--- স্যার, আর চাকরি বাঁচানো গেল না৷  আমি মাত্র দশটি গ্রামে এযাবৎ ঘুরতে পেরেছি৷ এখন যেভাবে হো’ক আমার চাক্‌রিটা বাঁচিয়ে দিন স্যর!

বি.ডি.ও সাহেব বললেন---সে জন্যে ঘাবড়াচ্ছো কেন? তুমি শুধু জানিয়ে দাও, আমি কেবল তিনটি গাধার সন্ধান জানি৷

বি.এল.ডব্লিউ. বি.ডি.ওকে  শুধোলেন--- তিনটি গাধা কে  কে  স্যর !

বি.ডি. ও সাহেব ৰললেন--- এক গদ্‌হা তুম, দুসরা গদহা মঁৈ, অঔর তীস্‌রা গদ্‌হা সচিবালয় কা বহ আফুসার জিন্‌হোনে গদ্‌হাওলা রাপোর্ট মাংগা৷ (শব্দ চয়নিকা-১৩শ খণ্ড)