ধনসম্পদের প্রাচুর্য আছে কিন্তু অন্যকে খাওয়ায় না, নিজেও খায় না এমন লোকও পৃথিবীতে অনেক আছে৷ তাদের সম্পদ ‘ভ’ পর্যায়ভুক্ত নয়৷
আমার জানা এক শেঠজী (শ্রেষ্ঠী > শেট্ঠী> শেঠী > শেঠ দক্ষিণ ভারতে ‘চেট্টি’৷ প্রাচীন কালে ৫০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) সীনক বা স্বর্ণমুদ্রার মালিককে শ্রেষ্ঠী ৰলা হত৷ ) ছিলেন যিনি টাকার বাণ্ডিলের ওপর ৰসেছিলেন৷ যাতে ঘরের কোনো ঘুলঘুলি ৰা নালি দিয়ে টাকা ৰেরিয়ে না যায়, সেদিকে সৰ সময় দৃষ্টি রাখতেন৷ ছেলেমেয়েদের জন্যে ৰাজার থেকে সৰ সময় হাত–ফেরতা (সেকেন্ড হ্যাণ্ড) জামাকাপড় কিনে দিতেন৷ পাইকারী কাপড়ের দোকানে যেসৰ ছেঁড়া শাড়ী রদ্দী মাল ৰলে ঘোষিত হত সেগুলো কিনে এনে ধরম–পত্নী পাপড় (পর্পটী > পপ্পডি > পপ্পড় > পাপড়) কুমারী দেবীকে উপহার দিতেন৷ ৰলতেন– কেউ শুধোলে ৰোলো, পোলাও রাঁধতে গিয়ে খুন্তীর খোঁচায় শাড়ীটা ছিঁড়ে গেছে৷
শেঠজী জলখাৰারে খেতেন জণ্ডা কা লাৰা অর্থাৎ ভুট্টার খই৷ লোককে ৰলতেন, কলাকন্দ (কলাকন্দ হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের ক্ষীরের সন্দেশ৷) আর ঘিওর (‘ঘিওর’ হল প্রচুর ঘি দিয়ে প্রস্তুত একটি পশ্চিম দেশীয় মিষ্টান্ন৷) না হলে জলখাবার খেতে ভাল লাগে না৷
শেঠজীর নামটা এ্যদ্দিন পরে ঠিক মনে পড়ছে না...... সম্ভবতঃ শেঠ ঝাবরমল ঝুনঝুনবালা.....ৰাড়ী ঝালবার৷ শেঠজী ছিলেন আমাদের শহরের সৰচেয়ে ধনী লোক৷ ভোরের দিকে কেউ তার নাম নিত না কারণ লোকের ভয় ছিল ভোরে ভোরে শেঠজীর নাম নিলে সারাদিন জণ্ডার লাবা খেয়ে থাকতে হৰে৷ শেঠজীর ছেলেটি আমার ভাইয়ের সঙ্গে পড়ত৷ নাম ছিল নাত্থুমল ঝুনঝুনবালা৷ নাত্থুমল লেখাপড়ায় ছিল খুৰ ভাল৷ সে যখন সকল বিষয়ে ফার্ষ্ট হয়ে ষ্ট্যাণ্ডার্ড এইটে উঠল, শহরের সৰাই খুব আনন্দিত৷ হেড মাষ্টারমশায় তাকে প্রথম পুরস্কার দেবার সময় উচ্ছ্বসিত ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করলেন৷ ৰললেন–‘‘আমি আশা করি, এই ছেলেটি একদিন আমার স্কুলের তো বটেই গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে৷’’ কিন্তু ‘‘অবাক কাণ্ড ভাই, এমন ব্যাপার আর কখনো জন্মে দেখি নাই’’৷
নাত্থুমলের মুখে বিষাদের ছায়া, ঝাবরমলের মুখে তার চেয়ে ৰেশী বিষণ্ণতার কৃষ্ণমেঘ৷ ঝাবরমলকে জিজ্ঞেস করলুম–‘‘এমন আনন্দের দিনে তোমার কপালে চিন্তার ৰলিরেখা কেন
সে ৰললে–‘‘জানেন সরকার সাহেৰ, ছেলেটি যদি লেখাপড়া শেখে তাহলে ইয়ূনিভার্সিটিতে ‘প্রাপসার’ হৰে কিংবা সরকারী ‘আপসার’ হৰে৷ আমার গদ্দী কে দেখবে এর চেয়ে ঢ়ের ভাল হত যদি সে কয়েকটি পরীক্ষায় ফেল করত আর আমি সেই যুক্তিতে ওর পড়া ছাড়িয়ে দিতুম৷ তা ছাড়া আরও জানেন সরকার সাহেৰ, ও নিশ্চয় আমার কারখানার কর্মচারীদের মাইনে ৰাড়াবার জন্যে তাদের নিয়ে আন্দোলন করৰে, আমার বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেৰে....তাদের নিয়ে এক মজৰুত ওলিয়ন (ইউনিয়ন .....মজ্দুর ইয়ূনিয়ন) গড়ৰে৷ তাই ভাৰছি কী করা যায়৷ ধরমপত্নীর সঙ্গে ৰাতচিৎ করলুম৷ সে ৰললে–ছেলেটি যখন এতই ভাল....এতই তেজ, ওকে লেখাপড়া শিখতে দাও তোমার যদি পয়সা খরচ করতে অনিচ্ছা থাকে, তাহলে ওকে আমার ৰাপের ৰাড়ীতে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ আমার ভাইয়েরা ওকে মানুষ করৰে৷’’
শেঠজীর সঙ্গে তার ধরমপত্নীর সেদিন দারুণ ওঠাপটক লড়াই হয়ে গেল৷ রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে শেঠনী একদিন খেলেন না৷ তাতে অবশ্য শেঠজী একটু আনন্দিতই হলেন, কারণ তাতে একজনের একদিনের খোরাক ৰাঁচল৷
ৰাজারে নাত্থুমলের সঙ্গে আমার দেখা৷ সে কাঁদতে কাঁদতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷ ৰললে–‘‘সরকার সাহেৰ, আমি রেললাইনে গলা দিয়ে মরৰ৷’’
আমি বললুম–‘‘কেন রে! তুই এতটুকু ছেলে, তোর এই দুর্ৰুদ্ধি হল কেন’’
সে ৰললে–‘‘পিতাজী ৰলেছে, আর আমি তোকে পড়াতে পারব না৷ কারৰারে মন্দী চলছে৷ ভুষিমালের ৰেৰসায় একলাখ টাকার লোকসান হয়েছে৷’’
আমি জিজ্ঞেস করলুম–‘‘কথাটা কি সত্যি’’
সে বললে–‘‘না সরকার সাহেৰ, কথাটা মোটেই সত্যি নয়৷ আসলে ৰাৰুজীর আড়াই লাখ টাকা লাভ হয়েছে৷ ইন্কামট্যাক্স, সেল্স্ট্যাক্স থেকে ৰাঁচবার জন্যে নকল খাতায় (দু’নম্বর খাতায়) এক লাখ টাকা লোকসান দেখিয়েছে৷’’
আমি ৰললুম–‘‘তাহলে কী ক রা যায় ৰল৷’’
নাত্থুমল ৰললে–‘‘সরকার সাহেৰ, আপনি একবার পিতাজীকে ৰলুন৷’’
আমি ৰললুম–‘‘তোর মাতাজী যে আমাকে ৰলছিলেন, তোকে মামার ৰাড়ীতে রেখে তিনি পড়াতে চান৷ তাতে কী তোর পিতাজীর আপত্তি রয়েছে’’
সে ৰললে–‘‘পিতাজী ৰলছে, ও যদি লেখাপড়া শেখে তাহলে ও শেঠ না হয়ে ৰাৰু হয়ে যাৰে৷ আমার ৰেৰসা খতম হয়ে যাৰে৷’’
নাত্থুমলের মুখের দিকে চেয়ে আমার মনটা ব্যথাভারাক্রান্ত হয়ে উঠল কিন্তু করৰার কিছু ছিল না, কারণ তখন মেধাবী ছাত্রদের জন্যে তেমন কোনো নিঃশুল্ক ছাত্রাবাস (students' home) ছিল না, তাই আমি কিছুই করতে পারলুম না৷
নাত্থুমল কাঁদতে কাঁদতে ৰাপের গদীতে গিয়েই ৰসল৷ সে লাল রঙের মোটা মোটা খাতাগুলোতে কী যেন লিখত৷ আমাকে রাস্তায় যেতে দেখলেই একবার তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নীচু করত৷ আমার পক্ষে সে অবস্থাটা ছিল একেবারে অসহনীয়৷ তারপর থেকে সে আর কখনও আমার সামনে এসে দাঁড়ায়নি৷ ঝাবরমল একটি প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটালে৷
একদিন ঝাবরমলের সম্ধী (আমাদের এখানে ৰেয়াইকে ‘সম্ধী’ ৰলা হয়৷) এলেন কোনো দূর দেশ থেকে৷ ঝাবরমলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল৷ ৰেয়াই কতদিন থাকবেন কে জানে! ৰেয়াইমশাইকে তো আর ৰাজরার রুটি আর লংকার অচার খাইয়ে রাখা যাৰে না! তিনি এলেন ৰেলা প্রায় ১০–২১ টায়৷ ঝাবরমল দু’হাত ৰাড়িয়ে ৰেয়াইকে স্বাগত জানালেন,.....ৰল্লেন–‘‘আসুন...আসুন৷ আপনার কী কৃপা! আজ গরীৰের ঘরে চরণধূলি দিয়েছেন৷ তা আমার ৰেৰসায় মন্দী যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আপনাকে দেখে আমার সে দুঃখ দূর হয়ে গেল৷ তা আমার দুঃখ তো আপনি বুঝৰেনই৷ ৰেৰসা যদি তেজী চলত তাহলে আপনাকে যতটা স্বাগত করতে পারতুম ততটা হয়তো করতে পারৰ না৷ তবু যতটা পারি অবশ্যই করৰ৷’’
ৰেয়াই ৰললেন–‘‘তাতে কী হয়েছে, তাতে কী হয়েছে! সে জন্যে আপনি ভাবৰেন না শেঠজী৷’’
ঝাবরমলজী ৰললেন–‘‘জানেন ৰেয়াইমশায়, আমাদের ৰাড়ীর চউকার (হেঁসেল–অঙ্গিকায় ‘ভান্সা’) কাজ ৰেলা দশটার সময় শেষ হয়ে যায়৷ আপনি এসেছেন৷ আপনার জন্যে আবার নোতুন করে চুল্হা (উনুন বা আখা) জ্বালিয়ে রাঁধতে হৰে তো! আপনি ৰেয়াইমশায়, আপনার জন্যে দু’চারটে ভাল ভাল রান্না আবার তো করতে হৰে–তা সে আমার আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন৷ রান্নাবান্না সারতে অন্ততঃ দু’ঘণ্টা লেগে যাৰে৷ আপনাকে তো আর অতক্ষণ না খাইয়ে রাখতে পারি না৷ হ্যাঁ, আমার উঠোনের কুয়োর জল খুৰই ভাল৷ আপাততঃ অন্ততঃ এক গ্লাস জল খেয়ে গলাটা ৰুকটা ঠান্ডা করে নিন৷ তার পরে চলুন, কাছেই রয়েছে এখানকার সৰচেয়ে উমদা*(*উম্দা মূলতঃ একটি ফার্সী শব্দ৷ ‘উম্দা’, ‘পরায়া’, ‘ৰুলন্দ্’ প্রভৃতি কয়েকটি হিন্দুস্তানীতে ব্যবহূত শব্দ পুংলিঙ্গ–স্ত্রীলিঙ্গ ভেদে ভিন্নতা প্রাপ্ত হয় না, অর্থাৎ উন্নত মানের জিনিসকে ‘উম্দা চীজ ’–ই ৰলৰ, ‘উম্দী চীজ’ নয় যদিও ‘চীজ’ শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ৷ তেমনি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দের পূর্বে ‘পরায়া’ ব্যবহার করা যাবে, ‘পরায়ী’ হৰে না৷ ‘পরায়ী’ লেখা বা ৰলা একটি সাধারণ ভুল ন্তুপ্সপ্পপ্পপ্সু ন্দ্বব্জব্জপ্সব্জগ্গ৷ ‘ৰুলন্দ্’ শব্দটিও পুংলিঙ্গ–স্ত্রীলিঙ্গে অপরিবর্ত্তিত থাকবে–‘ৰুলন্দী’ হৰে না৷ ‘ৰুলন্দী’ ভাববাচক বিশেষ্য ত্ব্ব্দব্ধব্জ্ত্রন্তুব্ধ প্সব্ভুগ্গ, মানে উঁচাঈ–উচ্চতা৷ ) হোটেল৷ নাম ঃ ‘অতি বিশুদ্ধ্ পরোটা ভাণ্ডার’৷ একেবারে শুদ্ধ্ শাকাহার শুদ্ধ্ ঘি৷
পথশ্রমে ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও ৰেয়াই ঝাবরমলের সঙ্গে সঙ্গে চলল ‘অতি বিশুদ্ধ্ পরোটা ভাণ্ডারের’ দিকে৷ হোটেলের মালিককে ঝাবরমল ৰললেন–‘‘ইনি আমার বেয়াইমশায়....খুব রঈস লোক.....প্রচুর টাকাপয়সার মালিক৷ কখনও অন্যের পয়সায় খান না৷ এমনকি আমি ওঁর অতি নিকট আত্মীয়....আমার পয়সাতেও কখনো খান না৷ এঁর জন্যে আপনার হোটেলে যে উম্দা উম্দা মেনু আছে তাই নিয়ে আসুন–কচৌরী, খড়ি ৰড়ি, রতুয়া, লড্ডু, ঘিওর, কলাকন্দ, সাৰুদানা কা পাপড়, আলু কা পাপড়, রাৰড়ি আর মালাই৷ এছাড়াও ৰেয়াইমশায় আর যা যা চাইৰেন তাও দিন৷’’
ৰেয়াইকে খেতে ৰসিয়ে দিয়ে ঝাবরমলজী বললেন–‘‘আমার দোকানে কাজ রয়েছে ৰেয়াইমশায়, আমি একটু চলি৷’’ যাৰার সময় হোটেলের মালিককে ৰললেন, ‘‘যদিও নীতিগতভাবে উনি অন্যের পয়সায় খান না, তৰু উনি আমার নিকট আত্মীয়......আমি ওঁকে কিছুতেই ছাড়ৰ না৷ আপাততঃ পেমেন্টটা উনিই করে দেৰেন৷ তবে সেটা পরে আমি জোর করে ওঁর পকেটে ঢুকিয়ে দোৰ৷ উনি আমার অতিথি, আমার টাকায় ওঁকে খেতেই হৰে৷’’ তারপর ৰেয়াইকে বললেন–‘‘ৰেয়াই মশায়, যা খাৰার খেয়ে নিন কিন্তু জল খেয়ে পেট ভরাৰেন না যেন৷ জলটা আমার ৰাড়ীতেই খাৰেন৷ অমন পাচক জল পৃথিৰীতে আর কোথাও হয় না৷’’
তারপর ঝাৰরমল ৰাড়ী চলে এলেন....ধরমপত্নীকে ৰললেন–‘‘দেখ, আমরা সৰাই একসঙ্গে তাড়াতাড়ি খেতে ৰসে যাই৷ ৰেয়াই মশায় এ ৰাড়ীতে আসার আগেই খাৰার পাট চুকিয়ে দিতে হৰে তো৷’’ এই যে ঝাবরমলজী এঁর সম্পত্তি থাকুক মানুষের এতে কিছুই যায় আসে না৷ তাই এঁর সম্পত্তি ‘ভ’ পর্যায়ভুক্ত নয়৷