অবযন্ত্রণার মুশকিল আসান

লেখক
আচার্য রবীশানন্দ অবধূত

বৈশ্যতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত মুকেশ আম্বানীর মেয়ের বিয়ের একটি আমন্ত্রণ পত্রের মূল্য তিন লক্ষাধিক টাকা৷ অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে, জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে, বা ওড়িশ্যার কালাহান্ডি অথবা দণ্ডকারণ্যে বা ঝাড়খণ্ডের পালামো অথবা লোহার-দাগার দারিদ্র্য পীড়িত কত শত গ্রামে অনাহারে অপুষ্টিতে দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগে বিনা চিকিৎসায় অসহায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে৷ আধুনিক সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে এসব ঘটনা আজ সর্বজন বিদিত৷ এই হল বৈশ্যতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আসল রূপ৷ বৈশ্যশাসিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্ত্তন না হওয়া পর্যন্ত তিন লক্ষ টাকার নিমন্ত্রণ পত্রও হতে থাকবে,আর অর্থ তছরূপকারী তথাকথিত শিল্পপতি বিজয় মালিয়ার পায়খানা, প্রস্রাবগারও সোণা দিয়ে তৈরী হতে থাকবে৷ এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷ এটাই বর্তমান গণতন্ত্র (বোকাতন্ত্র)৷ মানুষের দুঃখ কষ্ট মৃত্যু ওদের পাষাণ হৃদয়কে স্পর্শ করে না৷

কত শত অভাবী মায়ের অভাগী কন্যা যৌতুকের এক ভরি সোনার গয়না দিন মজুর বাবার কাছ থেকে শ্বশুর বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারে নি বলে স্বামীর পাশবিক অসহনীয় অত্যাচারে আত্মঘাতী হতে বাধ্য হয়, কে তার হিসেব রাখে?

প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন ‘‘মানুষের দুঃখকষ্ট উপলব্ধি না করা একধরনের মানসিক ব্যধি৷’’ আর ওদের এই মানসিক ব্যাধির জন্যে অসংখ্য নিরীহ মানুষ বেঁচে থাকার নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির অভাবে নানান শারীরিক ব্যধিতে ভুগছে৷ অজস্র মানুষ অসময়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে৷ মানুষের এই অবযন্ত্রণাময় জীবনের সব খবর আমাদের গোচরীভূত হয় না৷ যেসব পরিবারের বা জনবসতির একটি দুটো ছেলেমেয়ে বাঁধা ধরা নিয়মের গন্ডি পেরিয়ে বিদ্যালয়ের সীমানায় পা ফেলার সুযোগ পেয়ে, একটু আধটু বাইরের আলো হাওয়ার ছোঁয়া পেয়েছে তাদের আশেপাশের খবরটাই আমরা পাই৷ ক্ষয়িষ্ণু জনবসতির দৈনন্দিন ব্যথা-বেদনার অধিকাংশ খবরই আমরা পাই না৷

নকসালদের পথ বা আন্দোলনের পদ্ধতি আমরা সমর্থন করি না৷ কিন্তু জঙ্গলমহলে যদি ওদের উপস্থিতি না থাকতো তাহলে আমলাশোলের আদিবাসীদের অনাহারক্লিষ্ট মৃত্যুর খবর রাজ্যবাসী কি জানতে পারতো ? এমন বহু ঘটনা বহু বেদনাদায়ক মৃত্যু দেশের আনাচে কানাচে আজও কিন্তু হয়ে চলেছে আর ভবিষ্যতেও হতে থাকবে৷ কারণ বর্ত্তমান কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক (সেন্ট্রালাইজড ইকোনমিক) কাঠামোয় এর প্রতিবিধান নেই৷

চা-পাতার আবিষ্কার ও পানীয় হিসেবে প্রথম ব্যবহারে এনেছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা৷ আর ইংরেজ বণিকরা এই অর্থকরী শিল্পকে বিশ্বে জনপ্রিয় করে, অর্জন করছে আশাতীত বৈদেশিক মুদ্রা৷ বংশানুক্রমে মুনাফা লুঠার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ও পরে দেশীয় পুজিঁপতিরা, স্থানীয় ও অস্থায়ী শ্রমিকদের ওপর নির্ভর না করে এই দীর্ঘ মেয়াদী ফসলের জন্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরীব অসহায় অসচেতন মানুষগুলোকে মিথ্যা আশ্বাস, প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে এনে বাগানে বাগানে চিরস্থায়ী শ্রমিক কলোনী গড়ে তুলেছিল৷ এদের আধপেট খাইয়ে, সন্ধ্যার পর চোলাই মদে আকন্ঠ ডুবিয়ে রেখে জন্তু জানোয়ারের মতো ওদেরকে চা বাগানের কাজে ব্যবহার করতো৷ এখনও ওই অমানবিক পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি৷ বংশ পরম্পরায় এরা সবাই চা-বাগানের স্থায়ী শ্রমিক৷ শ্রমিকদের রক্তজল করা মুনাফায় লক্ষ টাকার মালিকরা হাজার কোটি টাকার মালিকে পরিণত হয়েছে ৷ কিন্তু শ্রমিকরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে৷

সারাদিনের পরিশ্রমের পর নিজেদের পছন্দ মতো কিছু কেনাকাটা করবে সেই সুযোগটুকুও ছিল না, কারণ দু’টি ---

(এক) তাদেরকে মুজুরী হিসেবে নগদ টাকা কখনোই দেওয়া হত না৷

(দুই) শ্রমিকদের জনবিচ্ছিন্ন করে রাখতে বাজারহাট রহিত স্থানেই বাগানের অবস্থান৷ কাজের বিনিময়ে দেওয়া হত গোডাউনের পোকাধরা-অভ্যক্ষ চাল-ডাল৷ ওই পচা চাল ডালই ওদের প্রধান খাদ্য৷ আজও একই ধারা চলছে৷

এ এক অন্ধকার জগৎ৷ ওই অন্ধকার জগতের শ্রমিকরা আজও জানে না যে, এর বাইরেও একটি জগৎ আছে৷ বয়সের নিরিখে ওদের জীবনে বার্দ্ধক্য আসে না, প্রৌঢ়ত্বেই ওদের বার্দ্ধক্য ও মৃত্যু৷ যত ভয়ানক রোগই হোক না কেন একজন হাতুড়ে ডাক্তারের কটা বড়ি, আর ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলে এক শিশি সিরাপই সকল রোগের মকরধবজ, আর তাতেও কাজ না হলে মৃত্যুই ভবিতব্য ৷

এতসবের পরেও কিন্তু ওদের কোন ক্ষোভ নেই, প্রতিবাদ নেই৷ কারণ ওদের সমস্ত সমস্যার সমাধান চোলাইয়ে৷ শুধু মদের ঘোরই নয়, আসলে ওদেরকে চিরনিদ্রিত করে রেখেছে--- অশিক্ষা, অসচেতনতা ও জনবিচ্ছিন্ন পরিবেশ৷ তাই চরম শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচারেও ওরা নির্বাক৷ ওরা মেনে নিয়েছে এসবই ওদের বিধিলিপি৷

বর্ত্তমানে চা-বাগানের গন্ডি ছাড়িয়ে শোষকরা গোটা দেশটাকেই শ্রমিক কলোনীতে পরিণত করতে তৎপর৷ ওরা ও ওদের রাজনৈতিক দালালরা মানুষকে ক্রমশঃ বিপথগামী করে পাশবিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ তাই মানুষ তার মহান লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে৷

শোষকরা আজ তাদের চক্রান্তের জাল সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ভীষণভাবে সক্রিয়, সাধারণ মানুষ, প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞান, সূক্ষ্মবুদ্ধি ও সচেতনার অভাবে শোষকদের পাতা মরণফাঁদে অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে৷ ওই মরণফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ বড় একটা থাকে না৷ কারণ সেখানে ‘‘ মানুষ মদ খায় না, মদে মানুষ খায়৷’’

 রাজনৈতিক পার্টি থেকে শুরু করে, বিভিন্ন স্যোস্যাল মিডিয়া ‘অ্যাপস’ ‘চলচ্চিত্র, বার, নাইট ক্লাব থেকে শুরু করে, নার্সিং হোম, রেঁস্তোরা আরো কত কী --- সর্বত্র পাতা রয়েছে শোষকদের চক্রান্তের জাল৷ লক্ষ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করা৷ লক্ষ্যচ্যুত করে আত্মসম্মানহীন উদরসর্বস্ব দু’পায়া জীবে পরিণত করা৷

প্রাচীনকালে মানুষ তার শত্রুকে চিনতে পারতো, কারণ মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সহজ সরল৷ তাই মানুষ সম্ভাব্য বিপদকে সহজেই এড়িয়ে চলতে পারতো৷ বর্ত্তমান সময়ে মানুষের মন অত্যন্ত জটিল তাই কে শক্র, কে মিত্র সাধারণ মানুষের পক্ষে তা চিহ্ণিত করা খুবই দুরূহ৷

 সারদার (চিটফান্ড গোষ্ঠী) সুদীপ্ত সেনকে, তার এজেন্ট কর্মী ও অন্যান্যরা সাধারণ মানুষের কাছে দেবতা বানিয়ে দিয়েছিলো৷ সুদীপ্ত সেনের মিষ্টি কথায় অন্ধ ও মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল আমানতকারী থেকে অর্থসংগ্রহকারী সবাই৷ আর এই অন্ধত্বের সুযোগ নিয়েই ওদের নয়নের মণি শ্রীসেন একদিন তার মুখোশ ছেড়ে আসলরূপে অবতীর্ণ হন৷ হাজার হাজার মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে৷ শুধু সারদা কেন! রোজভ্যালী, অ্যালকামিষ্ট, প্রমথ মান্নার এম.পি.এস আরও কত কী! কিন্তু সবার একটাই কাজ---প্রতারণা৷

আজ দেশের সর্বত্র গ্রাম থেকে শহর, নগর থেকে মহানগর সর্বত্র ওই প্রতারকদের ছড়াছড়ি৷ কারণ ওই প্রতারকরাই কমবেশী সমস্ত রাজনৈতিক দলের যোগানদার৷ এরাই নেতা- মন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষক৷ তাই নীরব মোদী, বিজয় মালিয়ারা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও নির্বিঘ্নে -ভি.ভি. আই.পি’র তকমা এঁটে সটান দেশান্তরে চালান হয়ে যায়৷ দেশে এমন কেউ নেই যে, ওদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে৷ কারণ দেশকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ওই প্রতারকরা ৷

দেশের আনাচে কানাচে ছোট বড় প্রায় সবদলের (কমবেশী) হোমরাচোমরাই ওই প্রতারকদের প্রতারণার অর্থেই লালিত পালিত৷ এতএব কে আঙ্গুল ওঠাবে ওই প্রতারকদের বিরুদ্ধে৷ এসবই হ’ল বৈশ্যোচিত শাসন তথা সমাজব্যবস্থার কুফল৷ এই যুগে দেশ তথা সমাজের রিমোর্ট’টি থাকে তাদের হাতে, যাদের মেয়ের বিয়ের কার্ডের দাম তিনলক্ষ টাকা৷ তাদের অঙ্গুলি হেলনে একদিকে দেশের চালিকাশক্তি , অন্যদিকে শক্তির যোগানদার প্রতারকগণ দেশ ও দেশের সামাজিক - অর্থনৈতিক কাঠামোকে ওই সর্বনিয়ন্তা ধনকুবেরদের ইচ্ছানুযায়ী নাড়াচাড়া করে মাত্র৷ এরা বাজিগরের হাতের পুতুল বিশেষ৷

এইসব সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকল্পে একমাত্র প্রকৃত শিক্ষিত, সচেতন সৎসাহসী তথা নীতিবাদী ছাত্রযুবক ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিক যদি ওইসব পাপাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তবেই সমাজের প্রকৃত পরিবর্ত্তন সম্ভব৷

অতএব, বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যে মুখ্যতঃ দুটো উপাদান চাই, সর্বস্তরে আদর্শ নীতিপরায়ণ মানুষের নেতৃত্ব---যারা রাজনীতিকে উপার্জনের আখড়া না বানিয়ে, জনকল্যাণ তথা সমাজ কল্যাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবে৷ সেবার ভাবনা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে৷ এই মানসিকতা সম্পন্ন সৎসাহসী মানুষরাই আনতে পারবে সমাজের প্রকৃত পরিবর্ত্তন৷

দ্বিতীয়তঃ চাই অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ৷ অর্থনৈতিক সম্পদের, উৎপাদন তথা শিল্পের কেন্দ্রীকরণই সমস্ত সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু৷ তাই চাই স্থানীয় কাঁচামালে স্থানীয় শিল্প৷ সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে চাই সব জায়গা সব অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি৷ মেগাসিটি, স্মার্টসিটি, স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) সবই একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ অর্থাৎ বিত্তবানদের জন্যে৷ এসব সিটির সবকটিই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের বিষবৃক্ষ৷

অতএব জনসাধারণের অর্থনৈতিক দৈন্য তা, সামাজিক হীনম্মন্যতা ও মানুষে মানুষে ভেদভাবনা দূর করে মানব সমাজকে এক অখণ্ড ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে চাই সর্বস্তরের উন্নয়ন৷ আর তজ্জন্য অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণই একমাত্র মুসকিল আসান৷

আর তখনই বাস্তবে কায়েম হবে প্রকৃত স্বর্গরাজ্য---রামেরও ---বামেদেরও৷

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ---

            ‘‘বিশ্বজনের পায়ের তলে

                        ধূলিময় যে ভূমি

                                    সেই তো স্বর্গভূমি৷

            সবায় নিয়ে সবার মাঝে

                        লুকিয়ে আছো তুমি৷৷

                                    সেই তো আমার তুমি৷’’