মানবিক মৌল সিদ্ধান্ত বা Human cardinal principle হ’ল a silver lining between the psycho-spiritual and spiritual strata of human existence. আধ্যাত্মিক স্তর ও মানসাধ্যাত্মিক স্তর–এ দু’য়ের যে মিলনক্ষেত্র তাকেই বলি মৌল মানবিক স্তর৷ মানুষের অস্তিত্ব ত্রিমুখী, ত্রিধারা সমন্বিত–দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ এই ত্রিমুখী অস্তিত্বের মধ্যে দৈহিক ক্ষেত্রের সীমা অনেকে পেরিয়ে উঠতে পারে না৷ স্থূল ভোগই তাদের একমাত্র ধ্যেয় হয়ে পড়ে৷ তাদের বলব দানব বা পশুশ্রেণীভুক্ত৷ নিজেদের জৈব বৃত্তির তাড়নায় তারা সর্বদা প্রেষিত হয়৷ জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি, সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, সুস্থ অনুশীলন তাদের নাগালের বাইরে৷ তারা জানে শুধু তাদের দেহকে, দৈহিক প্রয়োজনকে৷ আবার অনেকে রয়েছেন যাঁরা শুধু দেহ নয়, মন নিয়েও তাঁদের কারবার৷ তাঁরা অনুভব করেন যে মনের প্রাধান্যই পশুদের থেকে তাঁদের পৃথক করেছে৷ মানসিক পরিতৃপ্তির এষণায় তাঁদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত৷ সূক্ষ্ম অনুশীলনের প্রচেষ্টায় তাঁরাই সৃষ্টি করেন কাব্য, শিল্প, সঙ্গীত, ভাস্কর্য৷ দয়া, মমতা, প্রেম, মৈত্রী, করুণা নিয়ে তাঁদের জীবনাভিব্যক্তি৷ তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, মনের গতিধারা অনন্তের সাথে মিলনের জন্যেই প্রবাহিত, তাই তাঁদের সমস্ত শক্তিকে তাঁরা নিয়োজিত করেছেন পরম সুন্দরের ধ্যানে৷ বৈবহারিক জীবনে তাঁরা আধ্যাত্মিক সাধক৷ এঁদেরই বলব মানব৷ এই আধ্যাত্মিক সাধক পরমপুরুষের আকর্ষণে তীব্রবেগে চলতে চলতে একদিন এসে পৌঁছান এমন এক স্থানে যেখানে মানসিক সত্তার শেষ ও আধ্যাত্মিকতার শুরু৷ সে সময় তাঁকে আর সাধারণ মানবের পর্যায়ে ফেলতে পারি না৷ তাঁকে তখন বলব দেবতা৷ মানবাস্তিত্বের এই যে পরিণতি, যেখানে মানসিক স্তর আর আধ্যাত্মিক স্তর–দু’য়ের হয় সংযুক্তি, সেই অবস্থায় পৌঁছানো প্রত্যেকটি মানুষের কাম্য ও কর্ত্তব্য৷ মানবতার চরম উন্নতি এখানেই৷ এরপর আর মানবতা থাকে না–থাকে শুধু দেবত্বের মহিমা৷ যেখানে পশুত্বের পরিসমাপ্তি, সেখান থেকে শুরু হয় মানবতার যাত্রা, আর মানবতার চরম শিখরে উন্নয়নের পরই শুরু হয় দেবত্বের পরমা প্রশান্তি৷ Where animality ends, humanity begins; where humanity culminates, divinity starts. মানবতার চরম বিকাশ ও দেবত্বের প্রারম্ভ–এ দু’য়ের যে সন্ধি পর্যায় তারই ওপর ভিত্তি করে’ মানবিক মৌল নীতি নির্ধারিত হয়৷৯
তাই বলি, তথাকথিত পাপী–তাপীদের চারিত্রিক সংশোধনের অন্যতম উপায় হ’ল প্রশংসা করা৷ ধরো, কোন মানুষ পাপের পথে এগোচ্ছিল৷ মনের পুরো শক্তি নিয়েই পাপ পথে এগিয়ে চলছিল৷ অবশ্য তার মধ্যে দু’–চারটে সদ্গুণও ছিল৷ এখন তুমি যদি সেই গুণগুলোর প্রশংসা করে’ দিলে, তো, সে তখন পাপের পথে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে চলা শুরু করে’ দেবে–অর্থাৎ তার অস্তিত্বে বড় রকমের একটা দিক্–পরিবর্ত্তন ঘটে গেল৷ এটাই হ’ল ঠিক পথ৷ তা না করে’ বার বার তাকে কেবল পাপী বলে’ অবজ্ঞা করলে, সে তখন তার অন্তর্নিহিত সদগুণের চর্চা তো করবেই না, বরং সে পাপের পথকে এত জোরে আঁকড়ে ধরবে যে, একদিন সে সমাজের একটা মস্ত বড় বোঝায় পরিণত হবে৷ মানুষ মানুষের এই মনস্তত্ত্বটা না জানায়, তাকে একটা বিরাট সামাজিক বোঝায় পরিণত করে৷ তোমাদের অজান্তে যেন এ ধরণের মনস্তত্ত্ববিরোধী কাজ না হয়ে যায়৷ দুষ্টকে ধর্মপথে নিয়ে এসো, দেখবে সে তখন পরমপুরুষের আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছে আর সঙ্গে সঙ্গে ওই মানুষটির মধ্যে যে যে সদ্গুণ নিহিত রয়েছে সেগুলো প্রোৎসাহিত করো–এটাই ঠিক মনস্তাত্ত্বিক উপায় সত্যিকারের সংশোধনের রাস্তা৷ তাহলে এখানে দুটো কথা এসে পড়ছে৷ এক, বৃহতের আকর্ষণ দুই, সামাজিক চাপ৷ বৃহতের আকর্ষণের ফলে সে ধর্মপথে চলতে শুরু করে’ দেবে৷ আর সামাজিক চাপের ফলে তার অভ্যন্তরীণ সদ্গুণগুলো বাহ্যিক স্ফূরণের সুযোগ পাবে৷ সামাজিক চাপ মানে কাউকে সমাজচ্যুত করা নয়৷ সামাজিক চাপ বলতে বোঝায় সেই লোকটার ভালো দিকটাকে, তার সদ্গুণগুলো প্রোৎসাহিত করে’ তার অস্তিত্বের দিক্ পরিবর্ত্তনে সহায়তা করা৷২৭
কোন বিশেষ কার্যে বা জীবনের কোন বিশেষ ক্ষেত্রে, কোন বিশেষ মানুষ বা শ্রেণীর মধ্যে যদি কোন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক দুর্বলতা দেখা দেয়, তবে বাকীদের উচিত তাদের হূদয়বৃত্তির সবটুকু মাধুর্য ঢ়েলে দিয়ে তাদের সেই দূর্বলতাটুকু দূর করে’ দেওয়া৷ প্রকৃত মানবিকতা বা প্রকৃত অধ্যাত্মদৃষ্টির অভাবে মানুষ কিন্তু ঠিক তার উল্টোটাই করে’ থাকে৷ কারুর কোথাও কোন দুর্বলতা দেখতে পেলে সুবিধাবাদী মানুষ সেই ফাঁক দিয়ে শিং গলিয়ে তার প্রাণের ফসলটুকু খেয়ে ফেলতে চায়–দুর্বলের ব্যথা বা মর্মবেদনার কথা ভেবে দেখাটাই নিজের দুর্বলতা বলে’ মনে করে৷ (তাই) সমাজে যত প্রকারের অনর্থ ঘটে থাকে তার প্রায় ৭৫ ভাগই হয়ে থাকে মানুষের প্রতি মানুষের সুবিচারের অভাবে৷
অতীত থেকে বর্ত্তমান পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখব যে, কোথাও মানবিক মূল্য সম্মানিত হয়নি৷ সম্মান তো দূরের কথা মানুষের মনুষ্যত্বের দিকে কেউ দাক্ষিণ্যের দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করেনি৷ মানুষ শ্রদ্ধা করেছে তাদের– যার দ্বারা তার স্বার্থপূর্তি হতে পারে৷ ভূলুণ্ঠিত মানবতাকে অবহেলা করে’ তারা সম্মান করেছে তাদের–যারা সমাজের উচ্চমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত৷ সামাজিক মূল্যকে মানবিক মূল্যের থেকে বড় করে’ দেখা হ’ল আজ পর্যন্ত চিরাচরিত প্রথা৷ মানুষের মূল্যকে সামাজিক মূল্যের আগে স্থান দিতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদের সংখ্যাই বেশী, তারাই বাহন৷ তাদের মানুষ হবার সময় নেই৷ দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত৷ সবচেয়ে কম খেয়ে–পরে, কম শিখে, বাকী সকলের চেয়ে বেশী তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশী তাদের অসম্মান, কথায় কথায় তারা উপোস করে’ মরে, ওপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে৷ জীবনযাত্রার জন্যে সবকিছু সুবিধা, সব থেকে তারা বঞ্চিত৷ তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে৷ ওপরে সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে৷ এইভাবে মানুষের অবমাননা, মানবিক মূল্যের অবহেলা আজকের এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে৷ Human Value precedes Social Value. মানুষ নিয়ে সমাজ৷ এই সামাজিক মূল্য মানবিক মূল্যের ওপর ভিত্তি করে’ গড়ে’ উঠবে–অর্থাৎ সামাজিক মূল্য তাদেরই প্রাপ্য হবে যারা মানবিক মূল্যকে সম্মান করে৷ সমাজ এই স্বীকৃতি দেয়নি বলেই মানুষের জীবনে এত হাহাকার আজ যাকে আমরা ঘৃণা করছি, যে সমস্ত বখে–যাওয়া ছেলেগুলোকে আজ তাচ্ছিল্য করছি, তাদের যদি সমাজ সুযোগ দিত, তবে তাদের মধ্যে থেকেই যে মহান মনীষীর আবির্ভাব হত না তা কে বলতে পারে?