(ইতোমধ্যেই ‘যজ্ঞ প্রসঙ্গে’ (১) প্রবচনটি প্রকাশ করা হয়েছে৷ ‘যজ্ঞ প্রসঙ্গে’ প্রদত্ত অন্যান্য প্রবচনগুলি ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করা হবে৷ –সম্পাদক)
যজ্ঞ সম্বন্ধে বলছিলাম৷ বলেছিলাম, যজ্ঞ শব্দটার আসল মানে হ’ল কর্ম৷ ‘যজ্’ ধাতু আর ‘কৃ’ ধাতুর মানে একই রকমের৷ যজ্ঞ বা কর্ম তিন ধরনের –– জাগতিক কর্ম, পিতৃকর্ম, আর দৈবকর্ম৷ আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে দেবী বা দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে কর্ম করা হয় তাকে বলা হয় দৈবযজ্ঞ, পিতৃলোকের জন্যে যা করা হয় তাকে বলা হয় পিতৃযজ্ঞ ও জগতের জন্যে যা করা হয় তাকে বলা হয় জাগতিক কর্ম বা সামাজিক কর্ম৷
‘দেবতা’ বলতে ৰোঝায় –– পরমব্রহ্ম কত রকম ভাবে নিজেকে অভিব্যক্ত করে চলেছেন বিভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে৷ এখন সেই প্রতিটি তরঙ্গকে এক একটি দেবতা বলা হয়৷ সেই দেবতার সন্তুষ্টির জন্যে যজ্ঞ করা হয় অর্থাৎ চাওয়া হচ্ছে যে আমার ইচ্ছাটা যেন এমনভাবে চলে যাতে দেবতার ইচ্ছা পূর্ণ হয়, ও দেবতা এমনভাবে তরঙ্গ উৎসারিত করুন যাতে জগতের কল্যাণ হয়৷
দৈবকর্ম যখন করা হয় তখন কর্ম নিষ্পন্নের মন্ত্রটাকে ‘স্বাহা’ বলা হয় –– দৈবকর্মে যা কিছু দেওয়া হ’ল, তারপরে শেষে ‘স্বাহা’ শব্দটা বলতে হয়৷ ‘শুভ হউক’ –– এটাই হ’ল মূল তাৎপর্য৷
এখন সেকালে যজ্ঞ করতে গেলে বিভিন্ন বেদের জ্ঞান থাকার দরকার হতো৷ এ প্রসঙ্গে প্রাচীন ভাষা সম্বন্ধে কিছুটা উল্লেখ করা দরকার৷ আর্যদের আদি নিবাস ছিল রুশ দেশের দক্ষিণাংশে ও মধ্যাংশে৷ ইয়ূরাল পর্বতের কাছাকাছি জায়গাটা –– অন্য নাম ককেশাস৷ আজ থেকে আনুমানিক ১৫০০০ বছর আগে তাঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন আজ আমরা সেই ভাষাকে বলি বৈদিক ভাষা৷ কেন বৈদিক ভাষা বলি? সে ভাষার কোন নাম ছিল না৷ আমরা বৈদিক ভাষা এই কারণে বলি যে, সে ভাষাতে কেবলমাত্র একটি বইয়ের আমরা সন্ধান পেয়েছি –– বইটির নাম বেদ৷ তাই ভাষাটার নাম বৈদিক ভাষা৷ বৈদিক ভাষাতে ‘বেদ’ শব্দটার মানেও জ্ঞান৷ ‘বিদ্’ ধাতুর উত্তর ‘অল’ প্রত্যয় করে ‘বেদ’ শব্দটা নিষ্পন্ন৷ ‘বিদ্’ ধাতুর মানে জানা৷ তোমরা জান যে ‘ঘঙ্’ আর ‘অল্’ প্রত্যয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে৷ যদিও এই দুই প্রত্যয়ান্ত শব্দই পুংলিঙ্গবাচক৷ ‘ঘঙলৌ পুংসি’ –– সংস্কৃত ব্যাকরণের এই নিয়ম৷ বেদ শব্দটাকে দেখে মনে হয়, ‘বিদ’ ধাতু ঘঙ্ প্রত্যয় ‘বিদ্’ ধাতুর ই–কার বেদ শব্দে এ–কার হয়ে গেল৷ কিন্তু তা নয়৷ বেদ, দ্রোহ, মোহ –– এই রকম কতকগুলো শব্দ আছে যেগুলো দেখে মনে হয় ‘ঘঙ্’ প্রত্যয়ান্ত শব্দ কিন্তু ওগুলো আসলে ‘অল্’ প্রত্যয়ান্ত শব্দ৷ বৈদিক ভাষায় ‘জানা’ অর্থে ‘বিদ্’ ধাতুর প্রচলন ছিল৷ তাই ‘বিদ্’ থেকে বিশেষ্য পদে হ’ল বেদ৷ বিদ্ ধাতুর রোমান্ সংস্কৃতে বানান হবে দ্দঢড্ড, ঙ্মদিয়েৰ নয়৷
পরবর্তীকালে, আজ থেকে আন্দাজ ১০০০০ বছর আগের ভাষার নামও বৈদিক, সংস্কৃত নয়৷ আরও পরবর্তীকালে আন্দাজ ১০০০০ সাল পরে ভাষাটার আরও অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ কারণ, ১০০০ বছর পর পর ভাষাতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে আর ১০০০ বছর আগেকার ভাষাটা পরবর্তীকালের লোকেরা ৰুঝতে পারে না৷ এই জন্যে বৈদিক ভাষাতেও পরিবর্তন এল৷ বৈদিক ভাষাটাও এক রকমের নয়৷ ঋক্বেদের যে অতি পুরোনো ভাষাটা –– ১৫০০০ বছর আগেকার ভাষা –– তা ১০০০০ বছর আগেকার বৈদিকের সঙ্গে মিলছে না৷ কারণ, এক একটা ভাষার আয়ুষ্কাল গড়ে ১০০০ বছর৷ তখনকার দিনের বৈদিক ভাষায় ‘জানা’ অর্থে ‘বিদ্’ ধাতুটাই চলত৷ কিন্তু ১০০০ বছরে ‘বিদ্’ ধাতুর ব্যবহার কমে গেল৷ তখন এল ‘জ্ঞা’ ধাতুটা৷ অর্থাৎ জানা অর্থে জ্ঞান শব্দটা এল, বেদ শব্দটা সরে গেল৷
পুরোনো বৈদিকে যে ‘জ্ঞা’ ধাতু সেটাই পুরোনো ল্যাটিনে হয়ে গেল ন্ড্রত্ত্বত্থ ৷ এই ন্ড্রত্ত্বত্থ থেকে ইংরেজীতে হয়ে গেল ন্ত্ত্বত্থ্ব৷ লক্ষ্য করবে, ন্ড্রত্ত্বত্থ–তে ন্–ও আছে, ত্ত্ব–ও আছে ও দু’টো বর্ণেরই উচ্চারণ আছে৷ কিন্তু ইংরাজী ন্ত্ত্বত্থ্ব–তে বর্ণটা রয়েছে কিন্তু উচ্চারণ নেই৷ উচ্চারণ হওয়া উচিত কন–নো কিন্তু ‘’–র উচ্চারণ আর নেই৷ কিন্তু মূল ধাতুতে ‘’ ছিল বলে ইংরাজী বানানেও ন্–টা রাখা হয়েছে৷
বৈদিক ভাষাটা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে যে রূপটা নিল তাকে বলা হয় ভারতের প্রাকৃত ভাষা৷ ভারতবর্ষের সাতটি অঞ্চলে সাত ধরনের প্রাকৃত চলে৷ সব জায়গায় তো এরকম হবে না৷ আমাদের পূর্ব ভারতে যে প্রাকৃত চলে সেটার নাম মাগধী প্রাকৃত৷ যাকে আমরা পালি ভাষাও বলি৷ ৰুদ্ধের সময়কার ভাষা৷ মধ্য–উত্তর ভারতে যেটা চলে তার নাম শৌরসেনী প্রাকৃত৷ শূরসেন হচ্ছে গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগ, অতি প্রাচীনকালে যাকে ব্রহ্মাবর্ত বা ব্রহ্মর্ষিদেশ বলা হতো, পরবর্তীকালে সেই অঞ্চলটার নাম হয়ে গেল শূরসেন৷ ব্রহ্মাবর্ত বা ব্রহ্মর্ষিদেশের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর৷ কানপুরের কাছে এখনও একটা ছোট্ট শহর রয়েছে –– নাম বিঠুর ওইখানটায় রাজধানী ছিল৷ পরবর্তীকালে যখন তার নাম পালটে হ’ল শূরসেন, তখন তার রাজধানী হয়ে গেল মথুরা৷ শূরসেনের রাজা ছিলেন কংস শূরসেনের রাজা ছিলেন কৃষ্ণ৷ তাই মধ্য–উত্তর ভারতের যে প্রাকৃত, তার নাম শৌরসেনী প্রাকৃত৷ পশ্চিম–উত্তর ভারতের পঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ, জম্মু –– এই অঞ্চলে যে প্রাকৃত ভাষা, তার নাম পৈশাচী প্রাকৃত৷ চরম ঙ্মদূরবর্ত্তীৰ উত্তর ভারতের কশ্মীর, আফগানিস্তান, তাজাকিস্তান, তুর্কীস্তান, দক্ষিণ রাশিয়ায় যে প্রাকৃত ভাষার প্রচলন হ’ল সংস্কৃত ভাষা মরে যাবার পর, তার নাম হ’ল পাশ্চাত্য প্রাকৃত৷ এই পাশ্চাত্য শব্দটার সংক্ষিপ্ত রূপ হ’ল পস্তো৷ পাঠানদের ভাষা, আফ্গানদের ভাষার নাম হ’ল পস্তো ভাষা৷ পেশোয়ারের ভাষাও তাই৷ আর সিন্ধুনদীর নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলের যে ভাষা তার নাম সৈন্ধবী প্রাকৃত বা পহ্লবী প্রাকৃত৷ সিন্ধুর পশ্চিমের ৰৃহৎ অঞ্চলের নাম পহ্লব৷ পারস্য বা ইরাণের রাজ পরিবার এই ‘পহ্লবী’ শব্দটা পদবী হিসেবে ব্যবহার করতেন৷ এই রাজ পরিবারের সর্বশেষ রাজা ছিলেন রেজা শাহ পহ্লবী, আর মধ্যভারতে অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশে ও রাজস্থান ও গুজরাটের যে প্রাকৃত ভাষার প্রচলন হ’ল তার নাম ছিল মালবী প্রাকৃত৷ এতগুলো প্রাকৃতের জন্ম হয়েছিল৷