অশোক একটি ভারতীয় প্রজাতির (Indica) গাছ৷ অত্যুষ্ণ বা অতি শীতল অঞ্চল বাদে ভারতের সর্বত্রই অশোক গাছ জন্মায়৷ কেউ কেউ দেবদারু (ঢেউ খেলানো পাতা) গাছকে ভুল করে অশোক বলে থাকেন৷ না, দেবদারু ও অশোক এক গাছ নয়৷ দেবদারু (Indian Pine) পাইন বর্গীয় গাছ, অশোক তা নয়৷ অশোক ফুল অধিকাংশ ক্ষেত্রে লালচে রঙের৷ কিন্তু শাদা, সোণালী ও হলদে রঙের অশোক ফুলও হয় যদিও তারা দুষ্প্রাপ্য৷
অশোক ফুল, ছাল ও মূল নানান ধরনের ঔষধ প্রস্তুতিতে লাগে৷ বিশেষ করে বিভিন্ন স্ত্রী–ব্যাধিতে অশোকের ঔষধীয় গুণ সর্বজনস্বীকৃত৷ অশোকাসব, অশোকারিষ্ট, অশোকক্ষীর প্রভৃতি ঔষধগুলি এই অশোক থেকেই প্রস্তুত হয়৷
সূতিকা রোগে অশোকাসব ঃ গর্ভবতী নারী এক বল্কা (একবার ওথলানো) গো–দুগ্ধের সঙ্গে অশোকাসব ব্যবহার করলে প্রসবকালীন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কমে যায়৷
সূতিকা রোগে দ্রাক্ষাসব ঃ মেয়েদের সূতিকা রোগে এক বল্কা ছাগ–দুগ্ধের সঙ্গে দশ ফোঁটা দ্রাক্ষাসব ব্যবহার করলে তাঁরা অল্প সময়ে শক্তি ফিরে পাবেন৷
প্রসূতির মৃত্যুকালীন অবস্থায় দ্রাক্ষারিষ্ট ঃ প্রসূতির মৃত্যুকালীন অবস্থা এসে গেলে দ্রাক্ষারিষ্টের সঙ্গে গুড়ুচির চীনী পান করালে মৃত্যুর সম্ভাবনা কাটলেও কেটে যেতে পারে৷ দ্রাক্ষারিষ্ট হাতের কাছে না পেলে মৃতসঞ্জীবনী সুরাতেও কিছুটা কাজ দেয়৷
ক্ষাধক রোগে অশোক ক্ষীর ঃ ১০/১২টি বোঁটা ছাড়ানো অশোক ফুল, আধ সের দুধ ও চার সের জলের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে, দেড় পোয়া থাকতে নাক্ষিয়ে, তিন দিন সেব্য৷ এরই নাম অশোক ক্ষীর৷
ঋতুরোগে অশোক ক্ষীর ঃ অশোক ক্ষীর সমস্ত ঋতুরোগে ভাল ফল দেয়৷
নারীর অশোক ষষ্ঠী ও অশোকাষ্টমী কৃত্য ঃ অশোকষষ্ঠীতে ঋতুপ্রাপ্তা প্রত্যেক নারীই একটা পাকা কলার মধ্যে অথবা জল বা দুধের সঙ্গে, ছয়টি মুগ বা মাষকলায় ও ছয়টি অশোক ফুল বা স্ফুটনোন্মুখ কুঁড়ি সব এক গ্রাসে গিলে খাবে৷ অনুরূপ অশোকাষ্টমী তিথিতেও আটটি মুগ বা মাষকলায় ও আটটি অশোক ফুল বা কুঁড়ি ব্যবহার করবে৷
সধবা ও বিধবা নারীরাও অশোকষষ্ঠী ও অশোকাষ্টমী পালন করবে৷ অন্যান্য ষষ্ঠী তিথিতেও ভাত রুটির পরিবর্ত্তে দিনের বেলায় ফলমূল খেয়ে থাকবে ও রাত্রে ভাত জাতীয় জিনিস খাবে না৷
আমানি ঃ রাত্রে ভাত রেঁধে তা মাটির হাঁড়িতে রেখে তার সঙ্গে যদি কিছুটা জল, তেঁতুলের রস, প্রয়োজনৰোধে অত্যল্প লবণ দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা পরের দিন সকালে গেঁজে গিয়ে যে বস্তুতে রূপান্তরিত হয়, তাকে যদি ভাল করে চট্কে কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়, তবে সেই তরল বস্তু ‘আমানি’ নামে অভিহিত হয়৷ এই আমানি এক ধরনের গেঁজানো সুরা৷ এতে অল্প পরিমাণ নেশা হয়৷ তবে এতে নেশার সঙ্গে সঙ্গে ঔষধীয় গুণও আছে৷ এ ঘুম আনিয়ে দেয়৷ বদহজম হলে হজমেও সাহায্য করে দেয়৷ (গরম কালে) ঘর থেকে বেরোবার সময় আমানি খেয়ে বেরোতে হয়, আর সর্দি–গর্মী হলে আমানি খেলে তাড়াতাড়ি ফল দিয়ে দেয়৷ কয়েকটি বিশেষ খাদ্য গ্রহণের ফলে উদরাময় বা অতি সার দেখা দিলে, আমানি তাতেও ঔষধ রূপে ব্যবহূত হয়৷ এই আমানির ভাল নাম ‘কুল্মাষ’৷
স্ত্রীরোগে আমানি ঃ গর্ভবতী নারীদের অতি দৌর্বল্যেও আমানি কিছুটা কাজ করে৷ আমানির সঙ্গে লাল জবা (চারটে) বেটে আধ তোলা পরিমাণ ঋতুকালে প্রত্যহ পান করলে সমস্ত ঋতুরোগে ভাল ফল পাওয়া যায়৷ ডালিমের ফুল আমানি দিয়ে বেঁটে খেলে স্ত্রীরোগে ঔষধের কাজ করে৷
ডালিম / বেদানা
সংসৃক্তে ‘দাড়িম্ব’ থেকে মৈথিলিতে ‘দাড়িম’, ৰাংলায় ‘ডালিম’ শব্দ এসেছে৷ এই দাড়িম্ব বা ডালিমের বৈজ্ঞানিক চর্চা করে প্রাচীনকালে বেদানার উদ্ভব হয়েছিল৷ ইংরেজীতে এই দু’টিকেই pomegranate বলা হয়৷ বেদানার ভাল নাম ‘দাড়িম্বী’৷ আকারে ডালিম ৰড়, মাঝারি ও ছোট নানান ধরনের হয়৷ বেদানা হয় মাঝারি আকারের৷ ডালিমের খোলার গাত্রবর্ণ কিছুটা লালচে, বেদানার গায়ের রঙ খয়ের বা কপিশ বর্ণ৷ ডালিমের দানা লাল৷ বেদানার দানা হালকা গোলাপী অথবা বেগ্নে মিশ্রিত গোলাপী৷ স্বাদে ডালিম টক অথবা টক–মিষ্টি মেশানো৷ বেদানা সাধারণতঃ মিষ্টি৷ খাদ্যগুণ ডালিম ও বেদানায় থাকলেও, বেদানায় বেশী রোগীদের পথ্য হিসেবে বেদানাই ব্যবহার্য৷ ডালিম একটি রক্ত–ৰর্ধক ফল৷
স্ত্রী ব্যাধিতে ডালিম ঃ ডালিমের গাছ, ফুল ও ছাল স্ত্রীব্যাধির মহৌষধ৷ চীনদেশের আয়ুর্বেদে স্ত্রী–ব্যাধিতে জবাফুল ও ডালিম ফুলের ব্যবহার ব্যাপক রূপে রয়েছে৷ ৩/৪ টে ডালিম ফুল কাঁচা দুধে বেটে ঋতুকালে নারীর প্রত্যহ দিনে দু’বার করে সেব্য৷ অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে রোগিনী দুর্বল হয়ে পড়লে দু’তোলা কুকসিমার রস বা দুর্ব্বার রস কিঞ্চিৎ মধুসহ ঋতুকালে প্রত্যহ একবার সেব্য৷
অপামার্গ / অপরাজিতা
অপামার্গের পর্যায়বাচক শব্দগুলি হ’ল ‘কোষাতকী’ ও ‘খরমঞ্জরী’৷ ভারতীয় অপামার্গ মুখ্যতঃ দুই প্রজাতির–শ্বেত অপামার্গ ও রক্ত অপামার্গ৷ কলকাতা অঞ্চলে আমরা অপামার্গকে কথ্য ভাষায় বলে থাকি অপাঙ বা আপাঙ৷ রােে বলি চচ্চড়ে, অঙ্গিকা ভাষায় বলা হয় চিড়চিড়া৷ অপামার্গের শীষ কারো গায়ে ছুঁড়ে দিলে তা তার বস্ত্রে আটকে যায়৷
অপরাজিতা একটি ফুলের নাম৷ এর আদিবাস মালয়ে (মূল নাম তেলাঙ)৷ শাদা, নীল ও রক্তাভ ভেদে অপরাজিতা তিন ধরনের হয়ে থাকে৷ প্রতিটি প্রজাতি এক পাতি বা দু’থোকা, দু’ধরনের হয়ে থাকে৷ অপরাজিতা একটি নির্দোষ ভেষজ৷ এর নীলরঙকে তাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে খাদ্যবস্তুকে নীল রঙ করার কাজে ব্যবহার করা হয়৷ ধাতুঘটিত রঙের চেয়ে এই রঙ অনেক বেশী নির্দোষ৷
স্ত্রীব্যাধিতে অপামার্গ ও অপরাজিতা ঃ (১) গর্ভিণীর কটিদেশে শ্বেত অপামার্গের মূল (সম্পূর্ণ মূলটা) ধারণ করলে অথবা শ্বেত অপরাজিতার মূল ধারণ করলে গর্ভপাত বিদূরিত হয়৷
(২) মৃতবৎসা নারীর প্রসবকালে শ্বেত অপরাজিতার মূল আলুলায়িত কেশে ক্ষেঁধে রাখলে সুসন্তান প্রসূত হয়৷
(৩) অপামার্গের মূল, আরো বিশেষ করে শ্বেত অপামার্গের মূল মৃতবৎসা রোগেরও অন্যতম ঔষধরূপে গণ্য হয়ে থাকে৷
(৪) কৃষ্ণপক্ষে অপামার্গের ঔষধীয় গুণ ক্ষেড়ে যায়৷ বন্ধ্যা (বাঁঝা) নারীর রোগ–নিবৃত্তির ঔষধ রক্ত–পামার্গ থেকে তৈরী হয়৷ আর বন্ধ্যা পুরুষ বা অপুত্রক পুরুষের জন্যেও কয়েকটি ঔষধ শ্বেত অপামার্গ থেকে তৈরী হয়ে থাকে৷
(৫) যে সব নারী মৃতবৎসা রোগে ভোগেন কুকসিমা তাঁদের উপকারে লাগবে৷
অন্যান্য রোগে অপামার্গ ঃ এক আনা পরিমিত অপামার্গের শেকড় কাঁচা পেঁপের মধ্যে ভরে সেদ্ধ করে খেলে পারা ও উপদংশের ৰীজ ত্রম্ভহ্মড়ন্প্তন্ব্দগ্ দুই–ই নষ্ট হয়৷ প্রমেহ বা গণোরিয়া রোগে অন্ধত্বের সম্ভাবনা দেখা দিলে অপামার্গের কাজল ব্যবহার করতে হয়৷
কুর্চি ফুল ও মৃতবৎসা রোগ
‘গিরিমল্লিকা’ মানে কুটজ পুষ্পম্ বা কুর্চি ফুল৷ আয়ুর্বেদে কুর্চির অজস্র গুণ বর্ণনা করা হয়েছে৷ কুর্চি ফুল মৃতবৎসা রোগীর ঔষধ৷ এর ফুল ও মূল থেকে ঔষধ তৈরী হয়৷ কিম্বদন্তী এই যে ছ’টি কন্যার মৃত্যুর পর শচীদেবী (শ্রীমন্মমহাপ্রভু চৈতন্যদেবের মাতাদেবী) কুর্চি ফলজাত ঔষধ খেয়ে পুত্রসন্তানের জননী হয়েছিলেন৷