ড্যাম, ড্যাইক, ব্যারাজ
সেচের খাল নৌ-চালনার জন্য নয়, তাতে জলও সব সময় থাকে না৷ প্রয়োজন বোধে স্লুইস্ গেট দিয়ে তাতে জল ছাড়া হয়৷ সেচের ছোট খালগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কানা খাল অর্থাৎ কিছুটা গিয়েই তাদের চলার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়৷ এই সেচের খালকে ‘কুল্যা’ বলা হয়৷ নৌবহ খাল ও সেচের খালকে পৃথক ভাবে ৰোঝাবার জন্য নৌ-কুল্যা ও সেচ- কুল্যা ৰলা যেতে পারে৷
নদীয়া জেলায় কৃষ্ণনগরের কাছে একটি স্থানের নাম তথা ইষ্টিশানের নাম বাদকুল্যা৷ শব্দটি ‘বদ্ধকুল্যা’ থেকে এসেছে অর্থাৎ সেখানে ‘কুল্যা’ ছিল৷ পরে কুল্যার মুখ বুজে যাওয়ায় তা বদ্ধকুল্যায় পরিণত হয়৷ ‘বদ্ধকুল্যা’র অপভ্রংশ হৰে ‘ৰাধকুল্যা’! ‘ধ’ মহাপ্রাণ বর্ণ, তাই তার হীনপ্রাণ হিসেবে তদ্ভবে ‘বাদকুল্যা’ও চলতে পারে কিন্তু ‘ল্লা’ হবে না৷
নদী বা অন্য কোন জলাশয়ের গর্ভদেশ যেখানে পার্শ্ববর্তী জমির চেয়ে উঁচু সেখানে যে কোন সময়ে ওই নদী বা জলাশয়ের জল প্রচণ্ড বেগে এসে পার্শ্ববর্তী ভূমিকে প্লাবিত করে দিতে পারে৷ এরূপ অবস্থায় ওই জলাশয়ের গর্ভদেশ ড্রেজার বা অন্য কোন কিছুর সাহায্যে কেটে অর্থাৎ বালি-পলি সরিয়ে হয় তাকে গভীর করে দিতে হবে অথবা জলাশয়ের পাশে খুব উঁচু বাঁধ দিতে হবে যাতে ওই জল কিছুতেই পার্শ্ববর্তী জমিকে ডুবিয়ে দিতে না পারে৷ উঁচু স্তরের জলরাশির স্রোতকে নিরুদ্ধ করবার জন্য যে বাঁধ embankment) দেওয়া হয় ইংরেজীতে ও আরও কয়েকটি ইয়ূরোপীয় ভাষায় তাকে ‘ডাইক’ dyke) ৰলা হয়--- বাংলায় বলতে পারি ‘স্তরবাঁধ’৷
দামোদরের গর্ভদেশ বর্ধমান জেলার অববাহিকার চেয়ে কোথাও কোথাও উঁচু হয়ে গেছে৷ কোথাও বা তা হতে চলেছে৷ এ অবস্থায় দামোদর থেকে কোথাও যদি বিপুল পরিমাণে জলের ঢল নেবে আসে তাহলে বর্ধমান, হুগলী ও হাওড়া জেলা যে প্লাবিত হবে তাতে সন্দেহই নেই৷ এই অবস্থায় কার্যকরী পন্থা হচ্ছে ড্রেজারে করে দামোদরের গর্ভদেশ থেকে বালি-পলি সরিয়ে দিয়ে পাশের জমির চেয়ে নদীর খাতকে অনেকখানি গভীর করে দেওয়া৷ আর খরচ এড়াবার জন্য তা যদি করা না হয় তাহলে দামোদরের পাশে সুউচ্চ বাঁধ রেখে দিতেই হৰে৷ কেবল দামোদরের বা তীরকে ৰাঁচাবার জন্যই নয়, ডান তীরের কথাও সমভাবে ভাবতে হবে৷ অন্যথা বর্ধমান, হুগলী ও হাওড়ার যে অংশ দামোদরের বাঁ তীরে অবস্থিত, সেখানে---বিশেষ করে আরামৰাগ মহকুমায় যে কোন সময়ে বন্যা হতে পারে৷ দামোদরের তীরে এই যে বিশেষ ধরণের বাঁধ এটাও ‘ডাইক’৷
হল্যাণ্ডে সমুদ্রকে গভীর করে দেশকে সামুদ্রিক বন্যার হাত থেকে বাঁচানো কষ্টসাধ্য৷ তাই সেখানে সুউচ্চ ডাইক তৈরী করে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই৷ আমি ব্যষ্টিগত ভাবে সেই ডাইক দেখে এই কথাই বারবার ভেবেছি, এই ধরণের ডাইক ৰাঙলার কাঁথি ও ডায়মণ্ড হারৰার মহকুমায়ও কোথাও কোথাও দরকার রয়েছে৷
হল্যাণ্ডের মত উইগু-মিল (হবা-চক্কী) এখানেও হতে পারে৷ কারণ, এই সৰ অঞ্চলের হাওয়া সমুদ্রের তরঙ্গ-তাড়িত হওয়ায় সেটা স্বাভাবিক হাওয়ার চেয়ে প্রধরতর৷ ওই উইণ্ড- মিল বা হবা-চক্কী থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা সম্ভব, সামুদ্রিক জোয়ার থেকে তৈরী করা তো সম্ভব বটেই৷ এই হবা-কলগুলি হল্যাণ্ডের শিল্পোন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা এককালে নিয়েছিল৷ মেদিনীপুর ও চবিবশ পরগণা জেলাতেও এরা তাই করৰে৷
আমাদের অজয় নদীর গর্ভদেশে পলি জমে ক্রমশঃ তা উঁচু হয়ে উঠেছে৷ দক্ষিণ বীরভূমে অজয় অববাহিকার কিছু অংশের মাটিতে ৰালির ভাগ অত্যন্ত বেড়ে গেছে৷ তবে এখনও সে জমিতে বেলে মাটির ফসল শীতের কন্দ ও আখের চাষের সুযোগ রয়েছে৷ আর দেরী করলে সেই সুযোগ নাও থাকতে পারে৷ তখন যন্ত্রের সাহায্যে ওপরের বালি সরিয়ে তবে চাষের জমি কেটে বের করতে হবে৷ অজয়ের দক্ষিণাংশে বর্ধমান জেলারও ঠিক সেই অবস্থাই এখনই না এলেও এর গর্ভদেশ এরই উপনদী কুনুরের চেয়ে উঁচু যার ফলে কুনুরের জল অজয়ে না ঢুকে (ঢোকাটাই স্বাভাবিক ছিল) অজয়ের জল সময় সময় কুনুরে ঢুকে যায়৷ এই অবস্থাটা বাঞ্ছনীয় নয়৷ কেবল ডাইক দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না৷
বাঁধ বা এমব্যাঙ্কমেন্ট ৰলতে যা বুঝি তার অতিরিক্ত রাটী ৰাংলায় বৃহৎ পুষ্করিণী অর্থেও ‘ৰাঁধ’ শব্দের প্রচলন রয়েছে৷ রাঢ়, বিশেষ করে পশ্চিম রাঢ় অসমতল৷ বৃষ্টিপাতও কম, যদিও জমি আমন ধানের চাষের পক্ষে খুবই ভাল৷ কিন্তু অন্য ফল তেমন ভাল হয় না৷ তবে যেখানে ঈষৎ হরিদ্রাভ মাটি আছে সে সকল জায়গা আবার সরষের চাষের পক্ষে খুবই ভাল৷’’
তা সে যাই হোক, জলাভাব পশ্চিম রাঢ়ের একটি স্থায়ী সমস্যা৷ প্রাচীন কালে রাঢ়ের রাজারা এজন্য ৰড় ৰড় পুষ্করিণী খনন করিয়ে দিতেন৷ সেই পুষ্করিণীগুলির নিজস্ব গভীরতা তো থাকতই, অধিকন্তু চারি পাশে সুউচ্চ পাড় থাকায় এদের বর্ষায় জল ধারণ করবার সামর্থ্যও থাকত যথেষ্ট৷ ধান রোয়ার সময় অথবা ধানের ফুলোবার সময় জলাভাব দেখা দিলে পুকুরের পাড় কেটে জমিতে জল দিয়ে ফসল বাঁচানো হত৷ এই ৰৃহৎ পুষ্করিণীগুলি মুখ্যতঃ সেচের উদ্দেশ্যেই জল বেঁধে রাখার জন্য তৈরী করা হত বলে রাঢ়ী বাংলায় এদের ‘ৰাঁধ’ বলে৷ দুমকার বড়বাঁধ, বর্ধমানের রাজবাঁধ, বাঁকুড়ার সমূদ্রবাঁধ, ভগলদীঘি, রাণীবাঁধ, মেদিনীপুরের সরশংকা, পুরুলিয়ার সাহেববাঁধ হচ্ছে ৰাঙলার নামকরা বাঁধ৷ এই বাঁধগুলিকে ইংরেজীতে embankment বলৰ না---বলৰ reservoir সম্ভবতঃ ৰাঁকুড়া জেলার সমুদ্রবাঁধই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধরণের ৰাঁধ বা reservoir এই বাঁধটি থেকে আমোদর নামে একটি ক্ষুদ্র নদীও বেরিয়ে এসেছে যা দামোদরের উপনদী৷
একটি নদী উন্নয়ন পরিকল্পনায় নদীর পার্বত্য স্তরের শেষাশেষি অবস্থায় যে বাঁধ দেওয়া হয় তাতে একটি বিরাট এলাকা জলমগ্ণ হয় ও সেই স্থানটিতে বিপুল পরিমাণ জলকে আটক করে রাখা হয়৷ নদীমুখ আটকে দিয়ে এই যে জলসঞ্চয় করার বিধি একেও বাঁধ ৰলা হয়--- এর ইংরেজী ‘ড্যাম’ dam) ৷ ড্যামের চেয়ে ভাটিতে নদীর পার্বত্য স্তর শেষ হয়ে যেখান থেকে সমতল স্তর শুরু হয় যেখানে নদীর মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে কিন্তু পার্শ্বস্থ জমিকে প্লাবিত না করে যে জলবাঁধ তৈরী করা হয় ইংরেজীতে তাকে বলে ‘ব্যারাজ’ (barrage), ৰাংলায় বলতে পারি জলবন্ধ বা ‘কৰদ্ধ’৷ তাহলে বুঝলে, নদীর উজান অংশে থাকছে জলবন্ধ বা বাঁধ বা ড্যাম, আর সমতলের শুরুর দিকে থাকৰে জলবন্ধ বা কৰদ্ধ বা ব্যারাজ৷
সাধারণতঃ প্রতিটি নদীরই তিনটি স্তর থাকে-- পার্বত্য স্তর, সমতল স্তর ও ৰ-দ্বীপীয় স্তর৷ পৃথিবীর কোন কোন নদী ব-দ্বীপ স্তরে গিয়ে অত্যন্ত লবণাক্ত হয়ে যায়৷ সেক্ষেত্রে ওই লবণজলের জ্বালা থেকে পাশ্ববর্তী জমির ফসলকে বাঁচানোর জন্য বাঁধ (embankment বা স্তরবাঁধ (dyke) দেওয়ার দরকার পড়ে৷ এই রকমের স্তর-বাঁধ (dyke) বা বাঁধের embankment) দরকার দক্ষিণ চবিবশ পরগণার কোন কোন নদীতে রয়েছে৷ আগেকার দিনে মেদিনীপুরের রসুলপুর নদীতে ও সুবর্ণরেখার ভাটিতে এই সমস্যা ছিল৷ এখনও সমস্যা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দরকার আছে৷ (শব্দ-চয়নিকা,১/১৯০)