(শিরোনামে লিখিত বিষয়ের ওপর প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর বিভিন্ন পুস্তকে যা বলেছেন, সেগুলিকে সংকলিত করে’ তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট প্রাউটিষ্ট আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত৷)
ইংরেজ রাজত্বের প্রথম দিকে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাঙলার বাজার দখল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙলার শিল্প ধ্বংস করে’ দিল৷ নিজেদের মালিকানায় ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি খুলে সেখানে স্থানীয় শিল্পপতি ও দক্ষ কর্মীদের কাজ করতে বাধ্য করলো৷ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাঙালীদের ঠকিয়ে ও লুঠপাট করে’ কাঁচামাল সংগ্রহ করতো৷ যে সমস্ত বাঙালীরা কুটির শিল্পের মালিক ছিল তারা কোম্পানী থেকে কাঁচামাল কিনতে, ও তৈরী মাল কোম্পানীর কাছে বেচতে বাধ্য থাকতো৷ কোম্পানী চড়া দামে কাঁচামাল বেচতো, আর ২৫ শতাংশ কম দরে তৈরী মাল কিনতো৷ কোম্পানির বিরোধিতা করলে হাতে হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে চাবুক মারা হ’ত৷ তাঁতীরা যাতে মিহি কাপড় বুনতে না পারে সেজন্যে তাদের বুড়ো আঙুল কেটে দেওয়া হ’ত৷ এর ফলে পরবর্তীকালে যখন ইংল্যাণ্ডের ম্যাঞ্চেষ্টার থেকে কাপড় আসতে লাগলো তখন তার সঙ্গে বাঙলার তাঁতীরা প্রতিযোগিতায় হেরে গেল৷
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের দশ বছরের মধ্যে চিনি, লবন, কাপড় রাঙানোর রঙ, যন্ত্রাংশ ও জাহাজ কারখানা পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্ধ করে’ দেওয়া হ’ল৷ যারা বংশপরম্পরায় এই সব কাজে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, ও এর দ্বারাই তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতো তারা চাষের কাজ করতে বাধ্য হ’ল৷ এর ফলে ১৭৭০ সালে হ’ল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ৷ ক্রমশঃ বাঙলা হয়ে গেল কাঁচামালের যোগানদার আর ইংল্যাণ্ডে তৈরী মালের খরিদদার৷
স্বাধীনতার পরেও শোষণ বন্ধ হয়নি৷ ভারতীয় পুঁজিপতিদের শোষণ বরং আরও ব্যপ্ত হয়েছে, আরও তীব্র হয়েছে৷ এদের বহিরাগতই বলা চলে৷ কারণ স্থানীয় লোকের সামাজিক–র্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে তারা নিজেদের সামাজিক–র্থনৈতিক স্বার্থকে এক করে’ দেয়নি৷ পশ্চিম বাঙলা ও তার আশপাশের জায়গা গুলোকে তারা কেবল কাঁচামালের ভাণ্ডারের দৃষ্টিতেই দেখেছে৷ এরা বাঙলার কৃষিজ, খনিজ ও বনজ সম্পদ সস্তা দরে কিনে গুজরাট, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে নিজেদের কারখানায় ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত করে’ বেশী দরে বাঙলার বাজারে বিক্রি করছে৷
দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অত্যাবশ্যক সমস্ত জিনিসই বাঙলার বাইরে তৈরী হয়ে বাঙলার বাজারে বিক্রি হচ্ছে৷ পাশাপাশি ষড়যন্ত্র করে’ বাঙলার শিল্পগুলোকে একে একে পঙ্গু বা বন্ধ করে দিচ্ছে, যাতে বাঙলার কারখানায় তৈরী জিনিস বাঙলার বাইরের কারখানায় তৈরী জিনিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারে৷ এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে যে কয়েকটি কারখানা আছে তার বেশীরভাগেরই মালিক বহিরাগত৷ তারা পশ্চিমবঙ্গকে ভাবে তাদের উপনিবেশ৷ এখান থেকে তারা কাঁচামাল কিনে নিজেদের অঞ্চলের কারখানায় ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত করে’ এখানকার বাজারে বিক্রি করে৷ এই সব বহিরাগতদের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, ‘আমরা যখন বিদেশেই এসেছি, যত পারি লুটে নিই৷’
অর্থনৈতিক শোষণের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক শোষণ যুক্ত হয় তবে শোষকদের পক্ষে তা হয় সোণায় সোহাগা৷ ইংরেজরা এ জন্যেই বৃহত্তর বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে’ অসম, বিহার আর ওড়িষ্যার সঙ্গে জুড়ে দিল৷ এর ফলে ওইখানকার সম্পদ থেকে মূল বাঙলার মানুষ বঞ্চিত হ’ল৷ অপরদিকে যে সব অঞ্চলকে বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হ’ল সেখানকার বাঙালীরা কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই বাঙলার মূল ধারার জীবনযাত্রা ও সংসৃক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল৷ লক্ষ্যণীয় এই যে, ইংরেজরা ভারতের অন্য কোন অঞ্চলে এই ‘ভাগ করে শাসন কর’ নীতি নেয়নি৷ বাঙলার সম্পদ শোষণ করার উদ্দেশ্যেই ইংরেজরা বাঙলায় রাজনৈতিক দমন নীতি প্রয়োগ করেছিল৷
স্বাধীনতার পরও ভারতীয় শাসক শোষকরা এই দমননীতি সমানে প্রয়োগ করে’ চলেছে৷ ইংরেজরা বাঙলাকে নির্মম ভাবে শোষণ করা সত্ত্বেও স্বাধীনতার সময় অন্যান্য রাজ্য থেকে বাঙলা সমৃদ্ধ ছিল, ও বেশ কিছু বাঙালী শিল্পপতি ছিল৷ ভারতীয় বহিরাগতরা বিশেষ বিশেষ শিল্প ও ব্যবসা থেকে বাঙালী শিল্পপতিদের পরিকল্পনা মাফিক সরিয়ে দিল৷ ভারত স্বাধীন হওয়ার পরই এই অর্থনৈতিক দমননীতি কার্যকর করা শুরু হ’ল৷
এই সময়েই বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার জন্যে বাঙলার ধানের জমিকে পাট চাষের কাজে লাগানো হ’ল৷ চাষীরা দু’দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল৷ প্রথমতঃ ধান থেকে তাদের আয় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল৷ আর দ্বিতীয়তঃ পাটের বাজার দর থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হ’ল৷ অপরদিকে বহিরাগতরা দু’ভাবে লাভবান হ’ল৷ বিদেশে পাট রপ্তানি করে’ তারা ডলার (বৈদেশিক মুদ্রা) ঘরে তুললো, আর তাদের নিজেদের অঞ্চলে উৎপন্ন চাল বাঙলায় বিক্রী করলো৷ সেই সময়ে বাঙলায় প্রায় ৮০টা পাটকল ছিল, তার সবকটির বহিরাগত মালিকরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে’ নিজেদের অঞ্চলে পাচার করতো৷ কেন্দ্রীয় সরকারও পাট রপ্তানি করে’ আর শুল্ক্ চাপিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে৷ ভারতের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ২০ক্ম এসেছে পাট শিল্পের মাধ্যমে, কিন্তু বাঙলার পাটচাষীদের ভাগ্যে সেই লভ্যাংশের ছিটে ফোঁটাও জোটে নি৷
পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার কোন ভাগই পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়নি৷ কেন্দ্রীয় সরকার মহারাষ্ট্র আর গুজরাটে তুলনামূলক কম দরে তুলো বেচেছে, অথচ সেই একই তুলো বাঙলার মানুষকে কিনতে হয়েছে বেশী দামে৷ স্বাভাবিকভাবেই বাঙলার তাঁত থেকে বা কাপড়ের কলে যে কাপড় তৈরী হয়েছে তার উৎপাদন মূল্য বেশী পড়েছে৷ চিনির ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি৷ অথচ বাঙলার কয়লা ও লৌহ আকরিক সারা ভারতেই একই দরে বিক্রী করতে হয়েছে৷ এজন্যে বাঙলা অতিরিক্ত লাভ করতে না পারলেও, ভোজ্যতেল ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী বাঙলাকে বেশী দরেই কিনতে বাধ্য করা হয়েছে৷
এই ধরণের অর্থনৈতিক দমন নীতি চালিয়ে বাঙলার অর্থনৈতিক সংরচনাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ও বাঙলার বেশীর ভাগ মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নীচে ঠেলে দেওয়া হয়েছে৷ বহিরাগতরা একদিকে প্রতি মাসে বাঙলা থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাঙলার কারখানাগুলো একে একে বন্ধ করে’ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে৷ বহিরাগতরাই এখন বাঙলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও ব্যবসায়ের মালিক৷ এই বহিরাগত মালিকরা আবার বাঙলার বাইরের লোকদের কাজ দিচ্ছে, আর কাজ করার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি বাঙালী বেকার জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে৷
শোষকরা যখন কোনরকম রাখ–ঢাক না রেখেই শোষণের রথ অব্যাহতভাবে চালাতে চায় তখন সেই সঙ্গে শুরু করে’ দেয় মানসিক স্তরের শোষণ৷ আর যখন এই মানসিক স্তরের শোষণকে অর্থনৈতিক শোষণের কাজে লাগানো হয় তাকেই বলে মানস–র্থনৈতিক শোষণ৷ প্রথমে তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ কোন অঞ্চলকে বেছে নেয়৷ তারপর তারা সেই জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংসৃক্তিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে’ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর নিজেদের ভাষা ও নিজেদের সংসৃক্তি চাপিয়ে দেয়৷ এর ফলে যখন সেই জনগোষ্ঠীর লোকদের ব্যষ্টিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে সেই চাপিয়ে দেওয়া ভাষায় কাজ চালাতে বাধোবাধো ঠেকে তখন তাদের মনে বহিরাগতের কাছে হেরে যাওয়ার মনস্তত্ত্ব তথা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়৷ এই হীনম্মন্যতা বোধই সেই জনগোষ্ঠীর জাতীয় মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়, আর তারই ফলে তারা লড়াই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে৷ বহিরাগতরা তাদের স্বার্থে এই সুবর্ণসুযোগকে শোষণের কাজে লাগায়৷
ইংরেজ আমলে বাঙালীরা এই ধরণের অর্থগৃধ্ণু শোষকদের মানসিক শোষণের শিকার হয়েছিল৷ স্বাধীনতা আন্দোলনকে তথা যে কোন বিদ্রোহকে দমন করার উদ্দেশ্যে তারা সুকৌশলে বাঙালীর বিপ্লবী চেতনায় আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছিল৷ আর সেই কাজে সাফল্য পেতেই শুরু করেছিল মানস–র্থনৈতিক শোষণ৷
দেশ স্বাধীন হবার পর দেশীয় শোষকরা একই কৌশল কাজে লাগাচ্ছে৷ উদ্বাস্তু সমস্যার দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ১৯৪৯ সালের মধ্যেই, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাঙলাদেশ) থেকে যেসব উদ্বাস্তু এসেছে তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্য নীতি নেওয়া হয়েছে৷ বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যাটা ঝুলিয়ে রাখা হ’ল৷ বেশীর ভাগ বাঙালী উদ্বাস্তু তাদের আত্মমর্যাদা বোধ, শারীরিক ক্ষমতা ও কর্মোদ্যোগ কাজে লাগিয়ে আজও ত্রিপুরা, অসম ও ওড়িশায় জীবনসংগ্রামে রত, আর সহায় সম্বলহীন কিছু উদ্বাস্তু আহার ও আশ্রয়ের আশায় বাঙলার পথে পথে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে মরছে৷
কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্যই হচ্ছে তার সামূহিক মনস্তাত্ত্বিক অভিপ্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম৷ সেই জন্যেই সাংসৃক্তিক স্তরের শোষণের মাধ্যমে সেই জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব সংসৃক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে’ দেওয়া হয়৷ সমগ্র পূর্ব ভারতে বাঙালীদের ওপরে নির্মম ভাবে চলছে এই সাংসৃক্তিক শোষণ৷ বাঙালী চরিত্রের জাতীয় বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে’ দেওয়ার হীন উদ্দ্যেশে অশ্লীল সিনেমা ও অশ্লীল সাহিত্য বাঙলার প্রতিটি অঞ্চলে দুষ্ট ক্ষতের জীবাণুর মত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷
তবুও একথা ঠিক যে বাঙলার সমস্যা যেমন অনেক, সম্ভাবনাও তেমনি বিশাল৷