কোন বস্তু অগ্ণির সংস্পর্শ এলে তাতে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়৷ তার দ্বারা বস্তুকে পোড়ানো যায়, জ্বালানো যায় ও ঝলসানো যায়৷ এ ছাড়া স্যাঁকাও যায়৷
পোড়ানোর অর্থ হল বস্তুর বহিরাবরণ অগ্ণিদগ্ধ হয়ে বিনষ্ট হয়ে যায় কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ অগ্ণিপক্ব হয়ে নরম হয়ে যায়৷ জ্বালানোর অর্থ হল বস্তুর অগ্ণিসংযুক্তি ঘটার ফলে তার বাহির ও ভেতর দু’ই নষ্ট হয়ে যায় বা ভষ্মে পরিণত হয়৷ বেগুনকে পোড়ানো হয়, প্রদীপের সলতেকে জ্বালানো হয়৷ বস্তুর অগ্ণিসংযুক্তির ফলে যখন বস্তুর বহিরাবরণ মোটামুটিভাবে পুড়ে যায় কিন্তু ভেতরের দিকটা কোনভাবে নরম হয় না, কিছুটা প্রভাবিত হয় মাত্র, এই ধরনের অগ্ণিসংযুক্তিকে ঝলসানো বলে৷ এই ঝলসানোর জন্যে ‘রা’ ধাতু + ড প্রত্যয় করে ‘র’ শব্দ প্রযোজ্য (পুংলিঙ্গে)৷
বস্তুর অগ্ণিসংযুক্তিতে যখন বস্তুদেহে বিবর্ত্তন ঘটে কিন্তু কোন অংশই পোড়ে না তাকে আমরা স্যাঁকা বা সেঁক দেওয়া বলি৷ ‘র’ বলতে কিন্তু এই স্যাঁকা বা সেঁক দেওয়াকে ক্ষোঝায় না অর্থাৎ আমরা যে রুটি সেঁকি সেই স্যাঁকা রুটিকে কিন্তু ‘র’ বলতে পারব না৷ তোমরা বেগুন পোড়া বলো, না বেগুন জ্বালানো বলো, না বেগুন ঝলসানো বলো? নিশ্চয়ই বেগুন পোড়া বলো কারণ বেগুন পোড়ানোর পরেই তার ভেতরটি খাও৷
বেগুন–পোড়ার কথা বলতে গিয়ে অনেককাল আগেকার একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ল৷ সেকালে নাটকে খুব বেশী অতি–নাটকীয়তা চলত৷ নাটকের সংলাপ অবশ্যই স্বাভাবিক হওয়া বাঞ্ছনীয়৷ তবে দৈনন্দিন সাদামাটা জীবনে যে ধরনের সংলাপ ব্যবহার করা হয় নাটকের সংলাপের সঙ্গে তার অল্প–স্বল্প তফাৎ থাকে৷ বিশেষ করে স্বাভাবিক জীবনে যখন আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি তখন হয় আমরা ভাবি যেন আর কেউ তা না শোনে অথবা তখন আমরা আর কাউকে শোনানোর কথা ভাবি না৷ কথাটাকে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি৷ কিন্তু নাটকীয় সংলাপে মনে রাখতে হয়, শ্রোতা–দর্শকেরা যেন অভিনয়কারীদের কথা শুনতে পান অথবা হাবভাব দেখে তাঁদের বক্তব্য বুঝতে পারেন৷ স্বাভাবিক সংলাপ ও নাটকীয় সংলাপের মধ্যে এটাই বড় তফাৎ........এ ছাড়া অন্যান্য তফাৎও আছে৷
সেকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত নাটক মানেই অতি–নাটকীয়তা৷ সে সময় একবার আমাদের গ্রামে কোলকাতা থেকে একটি সেরা যাত্রার দল গেছল৷ আমি আর আমার ঠাকুমা যাত্রা দেখতে গেছি (সেকালে বলা হত যাত্রাগান শুনতে যাওয়া)৷ সংলাপ চলছে রাজার সঙ্গে রাণীর৷ রাজা রাংতা–মাখা পোষাক, রাংতার মুকুট পরে রূপোলী রাংতা মোড়া মাখনশিম হাতে নিয়ে এই–মারে–কী–সেই মারে করে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে৷ তখন রাজা–রাণীতে কথা হচ্ছে অতি–নাটকীয়ভাবে৷ রাণী বলছে–‘‘প্রাণেশ্বর, প্রাণনাথ কোথা যাও ফেলিয়া আমারে?’’
ঠাক্মা বললেন–‘‘মরণ দশা মিনসের ঢং দেখ৷’’
আমারও মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না৷ তারপর দ্বিতীয়বার যখন রাণী উদাত্ত কণ্ঠে পুরুষালী হেঁড়ে* গলায় চীৎকার করে বলে উঠল– ‘‘প্রাণেশ্বর...........প্রাণনাথ’’৷
আমি আর থাকতে না পেরে বললুম–‘‘বেগুন–পোড়া মাখো ভাত৷’’
ঠাক্মা শুনে আমাকে বললেন–‘‘বেশ বলেছিস্ ....... বেশ করেছিস৷ তোকে আমি হীরে–বসানো আংটি গড়িয়ে দোব৷’’
তা যাই হোক্, বেগুনপোড়া খাবার জিনিস৷ তাই আমরা বেগুন পোড়া বলি–বেগুন–জ্বালানো বলি না৷
(*হাঁড়িয়া > হেঁড়ে৷ মুখের সামনে একটা হাঁড়ি রেখে কথা বললে ধ্বনিটি যে ধরনের হয় তাকে বলে হেঁড়ে আওয়াজ৷)
(‘বর্ণ বিচিত্রা’ থেকে গৃহীত)