বেল/বিল্ব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃত শব্দ ‘বিল্ব’ থেকে ক্ষাংলায় ‘বেল’ শব্দটি এসেছে৷ ‘বিল’ শব্দের অর্থ ছিদ্র, ‘বিল্ব’ মানে যে বস্তুতে ছিদ্র আছে অথবা যে বস্তু ছিদ্র তৈরী করে৷ বেলের পর্যায়বাচক শব্দ ‘শ্রীফল’ পশ্চিম বিহারে ও উত্তর ভারতে কোন কোন স্থানে প্রচলিত৷ ভারতে ও বহির্ভারতে বেলের নানা শ্রেণীবিভাগ দেখা যায়৷ পাতলা খোলা, কম বীজ, কম আঠা, স্বাদ ও গন্ধের বিচারে রংপুরী বেলই সর্বশ্রেষ্ঠ৷

বেল একটি সাত্ত্বিক ফল৷ সে বেরিয়ে যাবার পথ খোঁজে সাধারণতঃ মলের মাধ্যমে৷ তাই বেল খেলে তাড়াতাড়ি পেট পরিষ্কার হয়৷ পাকা বেল পুষ্টিকর খাদ্য৷ পাকা বেলের যা গুণ কাঁচা বেল বা বেল পোড়ায় সে গুণগুলো তো আছেই, অধিকন্তু বাড়তি গুণও অনেক রয়েছে৷ তাই সুযোগ পেলেই বেল পুড়িয়ে শরবৎ করে খাবে৷ বেল পোড়ার অনেক গুণ৷ পেটকে ঠাণ্ডা রাখে৷ স্নায়ুতন্তুকে ঠাণ্ডা রাখে৷ মেধারও উৎকর্ষ ঘটায়৷ (আখের গুড়ের সঙ্গে বেলপোড়া আমাশয়/অর্শরোগে উত্তম জলখাবার ও ঔষধ৷ শিবঠাকুর নাকি বেল খেতে ভালবাসতেন৷ (শোনা যায় ‘শ্রী’ অর্থাৎ পার্বতী শিবের জন্যে বেল সংগ্রহ করাকে একটি পবিত্র কাজ বলে মনে করতেন৷ পার্বতীকে এই ভাবে কষ্ট করে বেল সংগ্রহ করতে দেখে শিব বেলের নাম রেখেছিলেন ‘শ্রীফল’৷)

বেলের শরবৎ স্নিগ্ধকারক ও গ্রীষ্মকালে শরীরকে সুসন্তুলিত রাখে৷ বেল–পোড়া বা বেল–পোড়ার শরবতের যা গুণ, বেলের মোরব্বার গুণ ঠিক ততটা না হলেও তার কাছাকাছি৷ তবে বেল তো আর বার মাস পাওয়া যাবে না, অথচ মোরব্বা বার মাস রেখে দিতে পার৷ বেলের মোরব্বা যদি চীনী দিয়ে তৈরী না করে এখো গুড় দিয়ে তৈরী কর তাহলে তার গুণ আরো বেড়ে যায়৷ পাকা বেলের শরবৎ না করে যদি পাকা বেলের পানা তৈরী করা হয়, তার গুণ সাধারণতঃ পাকা বেলের চেয়ে একটু বেশী৷ বেলের পানাও এখো গুড় দিয়ে তৈরী করলে তার গুণ বেড়ে যায়৷ স্বাদও আমার মনে হয় কমে না৷ [বেলপাতা ও পেঁপের পাতা এক সঙ্গে বেটে লাগালে পারা বা উপদংশের (Syphilis) ক্ষতস্থানের দাগ দূরীভূত হয়৷]

ত্রিফলা

হরিতকী, আমলকী ও বহেড়া (Terminalia belerica Roxb.) –এই তিন নিয়ে ত্রিফলা৷ ত্রিফলা ভেজানো জল  ত্রিদোষ–নাশক বলে গণ্য করা হয়৷ এই জল বায়ু–পিত্ত–কফ–এই তিনের সমতা রক্ষা করে৷ এই জল কোষ্ঠপরিষ্কারকও বটে৷

শ্লীপদ বা ফাইলেরিয়া সংক্রান্ত বাত জ্বরে ‘‘দু’তোলা ত্রিফলা (তিনটিই সম পরিমাণ) আধ সের জলে সেদ্ধ করে আধ পোয়া থাকতে নামিয়ে উষ্ণ থাকতে থাকতে তাতে দু’তোলা আদার রস মিশিয়ে তিন দিন পান করলে বাত জ্বর অবশ্যই সেরে যায়৷’’

মানকচু

পৃথিবীতে এমন অনেক আরণ্য উদ্ভিদ আছে যার মূল মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার করে এসেছে৷ ওই সকল মূলের মধ্যে যেগুলি বিশেষ সুস্বাদু ও বিশেষ পুষ্টিকর, মানুষ সেগুলি নিয়ে চর্চা বা কালচার করে তাদের মধ্যে উৎকর্ষ এনেছে৷ যেমন বুনো কচুকে মানুষ দীর্ঘকালের চর্চার ফলে সুখাদ্য সুভোজ্য কালীকচু, মুখীকচু, কমলভোগ কচুতে রূপান্তরিত করেছে৷ জলের কচুর কন্দ ক্ষড় একটা থাকে না৷ তার ডাঁটাটাই মানুষের খাদ্য৷ তাই জলের কচু পাঁকে লাগিয়ে মানুষ তার ডাঁটার স্বাদ বাড়িয়েছে বুনো মানকচু থেকে কৃষ্ণ মানকচু, শ্বেত মানকচু, পদ্ম মানকচু তৈরী করে নিয়েছে বুনো মেটে আলু থেকে মানুষ করে নিয়েছে খামালু৷ বুনো ওল থেকে আজ কোচবিহারের বড় ওল, সাঁতরাগাছি ও গেঁয়োখালির নামজাদা ওল তৈরী হয়েছে৷

আমাদের নামকরা কন্দের মধ্যে আলু তৈরী হয়ে যায় তিন মাসে৷ (সাধারণ) কচু আরেকটু বেশী সময় নেয়৷ ওল সময় নেয় এক বছর৷ কোন কোন প্রজাতির ওল দু’বছর সময়ও নেয়৷ মানকচু আর খামালু সময় নেয় তিন বছর৷ কৃষিবিজ্ঞানীদের উচিত গবেষণা করে এর পূর্ণতাপ্রাপ্তির সময়কে তিন বছর থেকে কমিয়ে আনা৷

পুষ্টিকারক, বিরেচক, ভগন্দরের ঔষধ হিসেবে মানকচু ঃ মানকচু পুষ্টিকারক, বিরেচক (কোষ্ঠ পরিষ্কারক), প্রথম পাতে খেলে কিছুটা ক্ষুধাক্ষর্দ্ধক, ভগন্দর (fistula) ব্যাধির ঔষধ৷ মধুমেহ (রোগ) থাকলে যথেষ্ট পরিমাণে মানকচু খেলেও কোন ক্ষতি হয় না৷ মানকচু শরীরে শক্তিও যোগায়৷ পাকস্থলীর ক্ষতে ও আলসার রোগে মানকচু (কিছুটা) উপকারী৷

(অর্শরোগে) রক্তক্ষরণ নিবারণে দুর্ব্বা – Cynodon dactylon Linn., কুকসিমা – Blumea Lacera D. C.,  ক্যালেণ্ডুলা Calendula sp.  ঃ

মানুষের যা মুখ্য খাদ্য তারা সব ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাস বা তৃণ জাতীয়৷ তৃণ বর্গের সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতি হচ্ছে বাঁশ আর সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রজাতি হচ্ছে দুর্ব্বা ঘাস (দুর্ব্বা>দুব্বা>দুব্)৷ সবচেয়ে ছোট হলে কী হবে এর মধ্যে অনেক ঔষধীয় গুণ রয়েছে৷ একে তো খাদ্য–প্রাণে ভরপুর৷ তাছাড়া রক্তক্ষয় (haemorrhage) নিবারণে এর গুণের কথা অনেকেই জানেন৷ অন্য কোন উপায় না থাকলে খানিকটা দুর্ব্বা ঘাস দাঁতে করে চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলে রক্তপাত ক্ষন্ধ হয়ে যায়৷ এই গুণ কালেন্ডুলা বর্গীয় ফুল গাছেরও রয়েছে, যে জন্যে কালেন্ডুলা একটি স্বীকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ৷ কুকসিমা বা কুকুরশোঁকার পাতাও রক্তপাত ক্ষন্ধে বিশেষ উপযোগী৷ এই গাছটা দেখলেই কুকুর এতে মূত্রত্যাগ করে৷ তাই বিহারে এর নাম কুকুরমূত্তা [বিশল্যকরণী পাতার রসেরও বাহ্যিক ক্ষতের ক্ষেত্রে রক্তপাত নিবারণের ক্ষমতা আছে]৷

অর্শরোগে ‘‘অত্যধিক রক্ত ঝরতে থাকলে দিনে দু’বার ২/১ তোলা পরিমাণ কুকসিমা অভাবে দুর্ব্বার রস পান করলে ভাল ফল পাওয়া যায়৷’’

‘‘শিমুল তুলা কুকসিমার রসে ভিজিয়ে (অর্শের) ক্ষলির ওপর পটির মত লাগিয়ে রেখে কয়েক দিন রৌদ্র লাগালে ক্ষলি ধীরে ধীরে খসে যায়৷’’

[ এছাড়া আমাশয় রোগে ও নারীর মৃতবৎসা রোগে কুকসিমা বা দুর্ব্বার ব্যবহার আছে ]

 

উৎস

(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)