পূর্ব প্রকাশিতের পর
শিবের সময়ও এই তিনটে রক্তগোষ্ঠী এসে মিশেছিল৷ একটা অষ্ট্রিক–কৃষ্ণকায় অনার্য৷ আরেকটা আর্য, পশ্চিম দিক থেকে এসেছে, গায়ের রঙ ফরসা৷ আর্যদের মধ্যে অবশ্য তিন ধরণের বিভাজন আছে৷ যেমন, একেবারে উত্তরের আর্যদের বলা হয় নর্ডিক, রঙ হ’ল লাল৷ চুলের রঙ লাল, চোখের তারা কটা অর্থাৎ লালচে৷ আরেক ধরণের আর্য হচ্ছে এ্যালপাইন যাদের চুলের রঙ নীলচে, চোখের রঙ নীলচে আর গায়ের রঙ গোলাপী ফরসা৷ আরেক ধরণের হ’ল মেডিটেরিয়ান গ্রুপের আর্য, যাদের রঙ দুধের মত ফরসা, চুল কালো, চোখের তারা কালো৷ এদের বলা হয় মেডিটেরিয়ান৷ এই তিনটে শাখায় বিভক্ত৷ ভারতবর্ষে অবশ্য যে আর্যরা ছিলেন বেশীর ভাগ তাঁরা সেকালে এসেছিলেন বাইরে থেকে৷ তাঁরা এসেছিলেন মেডিটেরিয়ান আর্যগোষ্ঠী থেকে৷ আর উত্তর দিক থেকে, তিব্বত–চীনের দিক থেকে এসেছিলেন মঙ্গোলিয়ান৷ এই তিনটে এসে মিলেছে আর তিনের মধ্যেই লড়াই৷ সেকালে পাহাড়ে পাহাড়ে, পাশাপাশি দু’টো পাহাড়ে লড়াই চলত৷ এখনও ভারতবর্ষে কোন কোন অংশে পাত্রপক্ষ, মানে বরপক্ষ যাচ্ছে ছেলে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে৷ তার মানে, লড়াই একটা হবে–লোকদেখানো লড়াই আর ওই লড়াইয়ের সর্দার করে যাকে নিয়ে যায় তারই বিয়ে হবে৷ সংসৃক্তে ‘বর’ মানে শ্রেষ্ঠ৷ ওই দলের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ তাকে করা হবে বর৷ বর মানে দলপতি, সেই দিনকার দলপতি৷ যারা পাহাড়ে লড়াই করত তারা গোষ্ঠীতে ব্জ্ত্রন্তুন্দ্বগ্গ গোষ্ঠীতে লড়াই তো করবেই৷ সেই আর্য, অনার্য আর মঙ্গোলীয়–এদের মধ্যে লড়াই চলত৷ সেটা শিবের সময়৷ শিব তখন চাইলেন, এই তিনের মধ্যে কোনভাবে একটা বন্ধুত্ব করাতে, কারণ কোন রকম বন্ধুত্ব না করে দেওয়া হলে মানব গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে৷ যেমন কৃষ্ণ ভেবেছিলেন তৎকালীন ভারতের সকলকে এক করে একটা মহাভারত গড়তে, তেমনি এই শিব চেয়েছিলেন এই তিন জনগোষ্ঠীকে মিলিয়ে এক করে দিতে৷ তা না হলে আমার এই সাধনার আদর্শ, আমার এই নৃত্য–গীত, আমার এই আয়ুর্বেদ, এই চিকিৎসাবিজ্ঞান এগুলোর বাহকতা কে করবে মানুষ যদি লড়াই করে মরতে থাকে এভাবে৷
সেকালে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল৷ শিবেরও তিন স্ত্রী ছিলেন৷ আর্যকন্যা পার্বতী, অনার্যকন্যা কালী, আর মঙ্গোলীয় কন্যা গঙ্গা৷ শিব চাইলেন, তিনের মধ্যে একটা ভাব হয়ে যাক, একটা মিটমাট হয়ে যাক৷ তিনি তাঁর ওই তিন স্ত্রীর মাধ্যমেই তিনটে সমাজে ধর্ম তথা তন্ত্রের প্রচার শুরু করে দিলেন৷ খুব সুবিধা হ’ল, মহা সুবিধা হ’ল যে আর্যরাও শিবকে দেবতা বলে মানে, মঙ্গোলীয়–তিব্বতীরাও মানে, আবার অনার্যরাও মানে৷ শিবের ভক্ত সবাই৷ পরবর্ত্তীকালে বৌদ্ধরাও মানত, জৈনরাও মানত, কারণ শিব এই ভাবে মানব সমাজের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করেছিলেন৷ এই শিবই বৌদ্ধদের কাছে হয়ে গেছেন ‘বটুক ভৈরব’–বটুক > ড়বড়ুঅ > বড়ুকা > বোড়ো > বুড়ো৷ বুড়ো শিব৷ বুড়ো শিবতলা বাঙলায় অনেক শহরেই পাবে৷ বুড়ো শিব হ’ল বৌদ্ধদের শিব৷ কলকাতায় আগে যেখানে বুড়োশিবতলা ছিল পরে সেখানে তৈরী হ’ল বুড়োবাজার৷ তারপরে ওখানে যখন মাড়োয়ারের লোকেরা এল তখন সেই জমিতে বাজার তুলল তারা৷ এখন সেই বুড়োবাজারকে ‘বড় বাজার’ করে তুলেছে৷ আসলে ওটা বড় বাজার নয়৷ অনেক শহরেই বড় বাজার থাকে কিন্তু কলকাতার বড় বাজারটা বড় বাজার নয়, বুড়োবাজার, বুড়োশিবের বাজার৷ এই রকম ভাবে হ’ল৷ তারপর শিব দেখলেন যে যদি আমি সমস্ত আদর্শগুলো প্রচার করি তাহলে সেগুলোর বাহকতার জন্যেও তো লোক চাই৷ ‘‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি৷
এত বিদ্যা, এত জ্ঞান, এত প্রজ্ঞা, এত সাধনা ধারণ করবে কারা? অপাত্রে দিলে তো হবে না৷
অপাত্রে যদি কোন শিক্ষা দিই, অপাত্রে যদি কোন কিছু দান করি, সেটা কাজে লাগে না, সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়৷ যেমন হাজারবার পড়ালে–শেখালেও বক ময়না পাখীর মতো কথা বলবে না৷ এখানে বক হ’ল অপাত্র৷ শিব এজন্যে কী করলেন?
পার্বতীর এক ছেলে যার নাম ভৈরব৷ আর কালীর এক মেয়ে যার নাম ভৈরবী৷ শিব ভৈরবকে প্রথম তন্ত্রসাধনা, কাপালিক সাধনা, নরকপাল দিয়ে সাধনা, ওই তাণ্ডব নৃত্য–সব শেখালেন৷ তারপর থেকে পৃথিবীর যত মানুষ এই কপাল –সাধনা, এই তন্ত্রসাধনা শিখেছে, সবাইকেই এই ভৈরব বলে মেনে নেওয়া হয়, সবাই ভৈরব পরিচিতি বহন করে ও সবাই যখন ওই সাধনা করে তখন তাদের নামই হয়ে যায় ভৈরব৷ রাম, শ্যাম, যদু, মধু ইত্যাদি নাম থাকে না৷ সবাই হয়ে যায় শিবগোত্র৷
শিব বললেন–সবাই আমার৷ যে যে পাহাড়েই থাক না কেন, সবাই আমার আপন জন৷ আমি সবাইকারই ভাল চিন্তা করব, মঙ্গল চিন্তা করব৷ সবাইকেই আমি ভাল করে দেব, সবাই আমার কাছে নিরাপদে ও নির্ভয়ে এসো, কার কী প্রয়োজন আমাকে জানিও৷ আমি সাহায্য করে দেব৷ সুতরাং ‘‘আত্মগোত্রং পরিত্যজ্য শিবগোত্রং প্রবিশতু’’৷ যে সাধক সে–ই সব গোত্র ছেড়ে, সমস্ত গোত্র ছেড়ে শিবগোত্র হয়ে গেছে৷ তাই আনন্দমার্গে পৃথক গোত্রের স্বীকৃতি নেই৷ সবাই শিবগোত্র৷ কেবল বিবাহের বেলায় বলে দিয়েছি যেন পাত্র আর পাত্রীর ওপরের দিকে তিন পুরুষ ও নীচের দিকে তিন পুরুষের মধ্যে কোন সম্পর্ক না থাকে৷ তার বাইরে হলে ঠিক আছে৷ গোত্র–টোত্র নেই৷ এর আগেও আমি বলেছি যে কাশ্যপ গোত্র, ভরদ্বাজ গোত্র–এসব লোকঠকানো ব্যাপার, কারণ মানুষ জাতের ইতিহাসের পিছনের দিকে যদি তাকাই তবে দেখব আদিতে বানর থেকে (apeman), এপ থেকে মানুষ এসেছে৷ বাঁদরই মানুষের পূর্বপুরুষ৷ সুতরাং গোত্র নিয়ে কেউ যদি বেশী মাতামাতি করে তাহলে তার মুখের ওপরেই আমি বলে দেব–‘‘ব্যাটাচ্ছেলে৷ তোরা তো বাঁদরগোত্র’’৷ বাঁদর থেকেই সব এসেছে৷ তেমনই জাতের ব্যাপারেও ঠিক তাই৷ বামুনের পুর্বপুরুষ বাঁদর বামুন, আর ক্ষত্রিয়ের পুর্বপুরুষ বাঁদর ক্ষত্রিয়? তা তো নয় বাপু, কারণ বাঁদরের কোন জাতটাত নেই৷ সব ভড়ং, সব বদমাইসি৷ তোমরা ওসব জিনিসকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেবে, মনের মধ্যে ওসবকে স্থান দেবে না৷
(পরবর্তী অংশ ১০ই জানুয়ারী, ২০১৪ )