আজকের আলোচ্য বিষয়বস্তু হল ‘‘জাতি race), ভাষা, ধর্মমত ও সংস্কৃতিতে বিশ্বজনীনতা৷’’ যদিও মানুষের ভাষা, বর্ণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আপাতঃ বৈষম্য রয়েছে তথাপি মানুষের এই সকল অপরিহার্য বিষয়গুলি কিন্তু এসেছে একই উৎস থেকে- সবই এসেছে সেই একক সত্যা পরমপুরুষ থেকে৷ ভাষাগত বৈষম্য বর্ণগত বৈষম্য , জাতিগত বৈষম্য আছে ঠিকই কিন্তু এসবই বাহ্য আপাতঃদৃষ্ট৷ মুখের ভাষা নয়, আসলে হৃদয়ের ভাষা, সেন্টিমেন্টের ভাষায় শুণতে হবে৷
বস্তুতঃ কোনো একক ভাষাই আদি ভাষা বলে দাবী করতে পারে না---তা সে ইংরেজিই হোক, বা তাগালগই হোক বা বাংলাই হোক৷ ইংরেজি ভাষা আদি ভাষা Original language) নয়৷ সত্যি কথা বলতে কি , ৯০০ বছর আগে ইংরেজি ভাষা ছিল না৷ ১৫০০ বছর আগেও বাংলা ভাষা ছিল না, ৮০০ বছর আগে অঙ্গিকা, মৈথিলী , অসমিয়া ভাষা ছিল না৷ আধুনিক ইংরেজি ভাষা হল স্কচ্, পুরানো নর্র্মন, অ্যাংলোস্যক্সন, ব্রাইটন, কেল্ট, লাতিন ও গ্রীক কথ্যভাষার সংমিশ্রণ৷ এই সকল কথ্য ভাষায় মিলিত ভাবে জন্ম দিয়েছে আধুনিক ইংরেজি কথ্যভাষা৷ ‘আলফ্রেড দি গ্রেট’-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার নিজস্ব স্বীকৃত শব্দভাণ্ডার ছিল না৷ তেমনই বাংলা ভাষাও সংস্কৃত ধাতু ও শব্দ, বিলুপ সংখ্যক ইংরেজী শব্দ জাপানি , পর্তুগীজ, আরবীয় ভাষার শব্দ দিয়ে তৈরী৷ এমনিভাবে তাগালগ্ ভাষা তৈরী হয়েছে ক্যান্টনীজ, চাইনিজ, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ান ও বেশ কিছু সংস্কত শব্দ নিয়ে৷
আবার তেমনি কোনো জনগোষ্ঠীও তার রক্তের পুরোপুরি বিশুদ্ধতা দাবী করতে পারে না৷ হিটলার যে আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা দাবী করতেন সেটা বস্তুতঃ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই৷ এক ইয়ূরোপেই রয়েছে নানান জনগোষ্ঠী, যেমন নর্ডিক, ভূমধ্যসাগরীয়, এ্যালপাইন, মঙ্গোলীয়ান, মঙ্গোলো নিগ্রয়েড, প্রভৃতি৷ ভারতবর্ষে রয়েছে অষ্ট্রিক, অষ্ট্রিকো- নিগ্রোয়েড, দ্রাবিড়ীয়, মঙ্গোলীয়, মঙ্গলো-নিগ্রোয়েড এমনি কত জনগোষ্ঠী৷ সুতরাং কোন জনগোষ্ঠীই এই রক্তগত সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়৷ সর্বত্রই চলছে এই বিশ্বজনীন সংমিশ্রণ৷ বিশ্বের কোথাও একটা মৌলিক জনগোষ্ঠী বা ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ মানব-সমাজ একটা একক সত্তা৷ সমাজের সকল দোষগুণ মিলিতভাবে আমাদের সকলের৷ সবকিছু আমাদের সকলের পৈতৃক সম্পত্তি৷ সমাজের সব ভালগুণগুলো আমাদের আর সব অ-গুণগুলো অপরের - এরকম দাবী করা নির্বুদ্ধিত৷
এই বিশ্বে সকল সত্তাই দিব্যসত্তা---এটাই মানুষকে উপলদ্ধি করতে হবে৷ কেউই এ বিশ্বে একা বা অসহায় নয়৷ বিশ্বের সঙ্গে আমাদের রয়েছে ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক৷ যেহেতু বিশ্বের সকল সীমিত সত্তার মধ্যে অসীমের ক্ষুধা রয়েছে, তাই সকল মানুষকেই তাদের মনের পরিভূ বাড়িয়ে চলতে হবে৷ এটা তাদের অবশ্য করণীয়৷ সর্ববন্ধন মুক্ত পরমসত্তাই সবার লক্ষ্য৷ মানুষকেও এমনভাবে মনের বিস্তার ঘটাতে হবে যাতে সে সমস্ত সীমার বন্ধন অতিক্রম করে যায়৷ কারুর মনের মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা বা মহাম্মন্যতা থাকবে না---থাকা উচিতও নয়৷ যারা ব্যষ্টিগত বা জাতি গত শ্রেষ্ঠতা প্রচার করে, তারা পাপ কাজ করছে৷ তারা মানব-ধর্মের বিরোধিতা করছে৷ মাটি, জল, বায়ুর মতো ধর্মও সকলের সাধারণ Common) সম্পদ৷ সবাইকেই ভূমাসত্ত্বার সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যেতে হবে৷
প্রখ্যাত আমেরিকান কবি কার্ল স্যাণ্ডবার্গের ভাষায় ---
‘There is only one man in the world
And his name is All-men.
There is only one woman in the world
And her name is All-women.
There is only one child in this universe
And his name is All-children.’’
ঠিক এই কথাটিকেই অতিসুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এশিয়ার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-
‘‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে,
সে জাতির নাম মানুষ জাতি৷
একই পৃথিবীর স্তন্যে পালিত,
একই রবি শশী মোদের সাথী৷৷ ’’