জীবনের গতি সর্বদা পরম লক্ষ্যের দিকে কিন্তু জড় প্রকৃতি তাকে সবসময় নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের শক্তি যখন আর কিছুই করতে পারে না, সেই সময়ের যে অবস্থা তাকে বলে মৃত্যু৷ এমনিতে শরীর থেকে প্রাণশক্তি যখন বেরিয়ে যায়, সেই সময়ের যে পরিস্থিতি তাকে মৃত্যু বলা হয়---এটা স্বাভাবিক তথা গৌণ মৃত্যু৷ কিন্তু মানুষের আবার অকাল মৃত্যুও হয়৷ আসলে প্রকৃতির এই আসুরী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তাকেই জীবন বলে৷ তমোগুণী বৃত্তিগুলো সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে মানুসের চরম লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে৷ যে এই আসুরী বৃত্তির সঙ্গে সংগ্রাম করতে ভয় পায়, সে সমাজে থেকেও নিজে তো অকাল মৃত্যুর দ্বারা গ্রস্ত হয়ই, তাছাড়া অপরেরও অকাল মৃত্যুর কারণ হয়৷ তথা সমাজের সর্বতোমুখী প্রগতিকে অবরুদ্ধ করতে থাকে৷ তাই এই ধরণের ব্যষ্টির সমাজে থাকার কোনও অধিকার নেই৷ তার উপযুক্ত স্থান হ’ল শ্মশান৷ কারণ জীবন নিজেই একটা সংগ্রাম আর সংসার তার সমরভূমি৷ জীবনের মূল উদ্দেশ্য অনুসত্তাকে ভূমা সত্তাতে মিলিয়ে দিয়ে ভূমা সত্তা হয়ে যাওয়া৷ ব্যষ্টিগতভাবে এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে, ব্যষ্টিগত তথা সামূহিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে যা কিছু বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, তাকে সবলে বিতাড়িত করাই মানুষের পরম কর্তব্য৷ এসব বাধা-বিপত্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিরন্তর নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই হ’ল পুরুষার্থ৷
তান্ত্রিকেরা সাধনাকে সাধনা-সমর বলে৷ আর এই সাধনা-সমরে তিনটি সত্তার আবশ্যকতা আছে---সাধক, সাধনা ও সাধ্য---অর্থাৎ ভক্ত, ভক্তি ও ভগবান৷ এখানে সাধক তাকেই বলব সে সাধ্যের নিকটে পৌঁছনোর জন্যে সাধনার পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে৷ আর সাধ্য হ’ল যাঁকে পাওয়ার জন্যে সাধক সাধনার পথ ধরে চলছে৷ সাধনা হ’ল সেই প্রচেষ্টা, সুনিয়ন্ত্রিত সংগ্রাম যার মাধ্যমে সাধক সাধ্যকে পেতে চায়৷ সাধককে সাধনার দ্বারা সাধ্য হয়ে যেতে হয়৷
আধ্যাত্মিক সাধনা করতে গেলে সাধককে বিভিন্ন বাধার সঙ্গে লড়াই করতে হয়৷ লড়াই করে নিজের কু-সংস্কার ও দোষত্রুটিগুলোকে বিতাড়িত করতে হয়৷ এই দোষত্রুটিগুলোকে বিতাড়িত করার পর তাদের দিকে আর দৃষ্টি না দেওয়াই উচিত৷ কারণ এসবের কথা ভাবলে আবার সেগুলো ধ্যানের বিষয় হয়ে যাবে৷ ঠিক একইভাবে অতীতের যে কু-কর্মগুলো তুমি করেছ তার দিকে আর নজর দেওয়া উচিত নয়৷ অতীতের কোনও দোষের ওপরই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আত্মগ্লানিতে ভোগার কোনও প্রয়োজন নেই৷ কারণ তা করলে ওটাই মনের ধ্যেয় হয়ে যায়৷ আর এইরকম পরিস্থিতিতে দোষত্রুটি আর কু-সংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ তাই প্রতিটি সাধককে শুধু লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে নিরন্তর গতি-বিরামক (cease less speed and pause) গতিধারার পথ ধরে সেই পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলতে হবে৷
সাধনা-সমরে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে সহস্রারে বিলীন করে দিতে হয়৷ কুণ্ডলিনীকে জাগানো একটা প্রক্রিয়া৷ প্রতিটি ক্রিয়া থেকে একটা শব্দ উত্থিত হয়৷ কুলকুণ্ডলিনীরও নিজের একটা শব্দ রয়েছে৷ আর তা হচ্ছে ‘হুং’৷ ‘হুং’ কুলকুণ্ডলিনীর বীজমন্ত্র৷ তা অনুক্ষণ কুণ্ডলিনী থেকে এত সূক্ষ্মভাবে স্পন্দিত হয়ে চলেছে যে সাধারণ মানুষ তার কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা এই ধবনি শুনতে পায় না৷ ‘হুং’ বীজমন্ত্রের উপযোগ করলে কুণ্ডলিনী গতিশিলা হয় ও তা ওপরের দিকে উঠতে থাকে৷ সংগ্রামেরও বীজমন্ত্র ‘হুং’৷ রণহুঙ্কার শব্দেও এই ‘হুং’ ধবনি নিহিত আছে৷
সামাজিক জীবনেও জড়তার সঙ্গে সংগ্রাম করাই জীবন৷ তমোগুণী প্রবৃত্তি হ’ল প্রকৃতির আসুরী শক্তি৷ এই আসুরী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করাটাই পুরুষার্থ৷ সামাজিক স্তরে তমোগুণী প্রবৃত্তির সঙ্গে, জড়তার সঙ্গে, অসৎ-এর সঙ্গে লড়াই করা ছাড়া সাধকের কাছে অন্য কোনও উপায় নেই৷ বিরোধী শক্তির জড়তরঙ্গের সঙ্গে লড়াই করা সাধকের অতি-আবশ্যিক কর্তব্য৷ সেই সঙ্গে মূলাধারে অবস্থিত সুপ্ত পরমাশক্তি কুণ্ডলিনীকে ওপরে ওঠানোর যে কৌশল তারও সততও সদুপোযোগ করা উচিত৷
আসুরী শক্তির সঙ্গে লড়াই করার জন্যে একটা সমাজ তৈরী করতে হবে৷ দু’বছর আগেই আনন্দার্গে এই ধরণের একটা সমাজ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে৷ এখন সমাজের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে যাঁরা বাহাদূর সৈনিক তাদেরও মার্গে আনতে হবে যারা সমাজের নবনির্মাণের কাজে হাসতে হাসতে আত্মোৎসর্গ করবে৷ সেই সঙ্গে তাঁরা সাধনা সমরে এগিয়ে যেতে যেতে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করবে৷ ---৫ই জুন, ১৯৬১, লহেরিয়াসরায়