গত ১৮ই জুন দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে রাজ্যের সমস্ত পুরসভার নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই অভিযোগ করেছেন, নানান্ জনহিতকর প্রকল্পে জনগণের স্বার্থে সরকার যে অর্থব্যয় করছেন, দলীয় নেতা কর্মীরা তার কাটমানি অর্থাৎ কমিশন নিচ্ছেন, এটা তাঁর অজানা নয়৷
তাঁর দাবী, ‘বাংলার বাড়ী’ প্রকল্পে ২৫ শতাংশ কমিশন নেওয়া হচ্ছে, এমনকি ‘কন্যাশ্রী’ ও ‘সমব্যথী’ প্রকল্পে সরকার থেকে ২০০০ টাকা দেওয়া হয় সেখানেও ২০০ টাকা কমিশন দিতে হচ্ছে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এসব বরদাস্ত করা হবে না৷ যারা কাটমানি নিয়েছে, তাদের অবিলম্বে সেই টাকা ফেরৎ দিতে হবে, না হলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে৷
মমতা যে দলের মধ্য সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন,এটা খুবই প্রশংসনীয়৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার বিষয়৷
আসলে এই কাটমানি বা কমিশন নেওয়ার ব্যাপারটা সারা দেশেরই রোগ৷ রাজীব গান্ধীও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মন্তব্য করেছিলেন, সরকার থেকে জনগণের জন্যে যদি ১ টাকা বরাদ্দ হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণের হাতে পৌঁছায় প্রায় ১৬ পয়সা মাত্র৷ অর্থাৎ প্রায় ৮৪ শতাংশ অর্থ মাঝেই লুঠ হয়ে যায়৷
দেখা গেছে, একটা পঞ্চায়েতে গরীব মানুষের ঘর তৈরীর জন্যে হোক, বৃদ্ধার পেনশন হোক--- প্রায় সর্বক্ষেত্রেই কমিশন দিতে হয় বিভিন্ন আধিকারিকদের বা পার্টি কর্মীদের৷ এটা পুরোনো কংগ্রেস আমলেও ছিল, বামফ্রন্ট আমলেও ছিল, বর্তমানেও বহাল তবিয়তে রয়েছে৷
একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেতে হলে কোথাও কোথাও ৮/১০ লক্ষ টাকা ঘুস দিতে হয়৷
এইভাবে প্রায় সবক্ষেত্রেই চলছে৷ মমতা কি এই কমিশন নেওয়ার অভ্যাস বন্ধ করতে পারবেন? তা সময় বলে দেবে৷ কিন্তু এতদিনের অভ্যাস সহজে বন্ধ হবে বলে মনে হয় না৷ হয়তো কিছুদিন হৈ-হাল্লা হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ধামা-চাপা পড়ে যাবে৷ কারণ এটা তো যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তারাই করে৷
তবে এটা বন্ধ করা খুবই প্রয়োজন৷ মমতা যদি এটা সত্যিই বন্ধ করতে পারেন তাহলে জনমনে তাঁর ভাবমূর্ত্তি অতি উজ্জ্বল হবে৷ কিন্তু সমস্যা হ’ল ‘ঠগ বাছাতে গাঁ উঝাড়’ হয়ে যাবে৷ আজ তো দুর্নীতিতে ভরে গেছে গোটা দেশ৷ মানুষ আবার কেবল অর্থের জন্যেই অন্যায় বা দুর্নীতির পথে পা মাড়ায় তা নয়, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির জন্যেও তা করে৷ স্বীয় পদ, অর্থ, ক্ষমতা, যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি--- এসবের জন্যে মানুষ দুর্নীতির আশ্রয় নেয়৷
প্রকৃতপক্ষে যে মানুষ কঠোরভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত নয়, সমস্তপ্রকার অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী নয়, পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ও সেবাব্রতী নয়, জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার কোনো অধিকার তার নেই৷
যুগান্তকারী সমাজদর্শন প্রাউটের প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন যাঁরা জন-প্রতিনিধি হিসেবে সমাজের কাজে নাববেন, তাদের অবশ্যই ‘সদবিপ্র’ হতে হবে৷ ‘সদ্বিপ্র’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন? তিনি তাঁর ‘আজকের সমস্যা’ পুস্তকে বলেছেন, ‘‘যাঁরা যম-নিয়মে (নীতিবাদ) প্রতিষ্ঠিত--- যারা ভূমাভাবের সাধক, তারাই সদ্বিপ্র৷ মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেবল করবে৷ নিঃস্বার্থভাবে জীব-সেবা কেবল তারাই করতে পারে৷ মানুষ সদ্বিপ্রকে চিনে নেবে তার আচরণ থেকে, তার সেবাপরায়ণতা থেকে, তার কর্মনিষ্ঠা থেকে তার চারিত্রিক দৃঢ়তা থেকে৷’’
এরাই হবেন যথার্থ নেতা৷ আজ মূলতঃ এই সদ্বিপ্র চরিত্রের মানুষের অভাবের জন্যে সমাজের এত সংকট৷ দুর্নীতিতে শোষণে দেশ ভরে গেছে৷ সমাজে যে আজ এত ভেদ-বিভেদ, এর পেছনেও রয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত৷
একমাত্র এই সদ্বিপ্ররাই পারে ভেদ-বিভেদহীন, শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে৷ প্রাউট-প্রবক্তা বলেছেন,‘‘এই সদ্বিপ্ররা দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করবে --- সকল মানুষের এক জাত, প্রত্যেক মানুষেরই সমান অধিকার৷
মানুষ মানুষ ভাইভাই এরা বজ্রকন্ঠে সমাজ শোষকদের জানিয়ে দেবে--- ‘‘মানুষকে শোষণ করা চলবে না৷’’
- Log in to post comments