কোন দেশের অর্থনীতির বিকাশ নির্ভর করে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের সামবায়িক শ্রমদানের ওপর৷ এই কারণেই প্রাচীন গৃহস্থালী অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে শ্রমবিভাজন অবস্থার উদ্ভব হয়৷ শ্রমিক, কর্ষক, ছুতোর, কামার, স্বর্ণকার, কুমার, বৈদ্য, কেরাণী প্রভৃতি প্রতেক্যের কার্যের মূল্যই অর্থনীতির সামূহিক বিকাশে সমান৷ প্রাচীন ভারতের অর্থনীতিতে সামবায়িক প্রচেষ্ট-ভিত্তিক ব্যবস্থার জন্যে এক স্থিতিস্থাপক অর্থনীতি বিদ্যমান ছিল৷ বৈদিক যুগে ভারতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বর্ণাশ্রমের ওপর ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ও এই চতুবর্ণ নিজ নিজ কর্ম সুষ্ঠু ভাবে করে যেত৷ একটি বিশেষ শাখা কৃষিকাজ করতে, বাকীরা করতো অন্য কাজ ৷ সাই মিলে আজকার মতো কৃষিক্ষেত্রে ভিড় জমাতো না৷ এই বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থা ছিল উত্তরাধিকারী সূত্রে আবদ্ধ৷ ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহানির সুযোগ ছিল কম৷ কৃষিকার্য, ক্ষুদ্র ও হটাৎ উভয় প্রকারের ক্ষেত খামার, সার প্রভৃতির প্রয়োগ ,শস্যের ব্যাধি দূরীকরণের ব্যবস্থা, নদী নালা কেটে জল সেচের ব্যবস্থা, কৃষি-কার্যের উপযোগী পশুপালন প্রভৃতি বিষয়ে রাজা নিজে মনোযোগ দিতেন৷ জঙ্গল কেটে চাষযোগ্য জমির আয়তন বাড়ানো , যে সমস্ত জমিদার চাষ করতে না পারার জন্যে জমিগুলি অনাবাদি ফেলে রাখত, তাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে যারা চাষ করতে পারে তাদি’কে সুযোগ দেওয়া প্রভৃতি তখনকার রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল৷ জমির মূল্য নির্ধারিত হ’ত জমির উর্বরতা অনুর্বরতার ওপর৷ কৃষি উৎপাদিত দ্রব্যের দাম রাষ্ট্র নিজে বেঁধে দিত৷ যার ফলে ব্যবসায়ীদের দ্বারা কর্ষকেরা শোষিত হার সুযোগ প্রায়ই ছিল না৷
কিন্তু ইংরেজরা ভারতে আসার পর অর্থনীতির এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়৷ তার প্রধান কারণ হ’ল দেশীয় কৃষি বা শিল্পের উন্নতির জন্যে ব্রিটিশ সরকার সর্বদা উদাসীন ছিল৷ তারা এরজন্যে কোন পরিকল্পনা করেনি বরং এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল যার ফলে কেরাণী গোষ্ঠীর লোক তৈরী হতে থাকে৷ এদের ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন পদে চাকুরি নিতে শুরু করে দেয়৷ এর ফলে কৃষি ব্যবস্থার ওপর আঘাত লাগে বড় বেশী৷ দ্বিতীয়তঃ যে সমস্ত দেশীয় শিল্প-কারখানা ছিল সেগুলিও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়৷ যেমন--- তাঁত শিল্প৷ ম্যানচেষ্টার থেকে মিলের তৈরী কাপড় সরবরাহ হওয়ার ফলে তাঁতের তৈরী কাপড়ের চাহিদা কম হয়ে যায়৷ এ্যলুমিনিয়ামের বাসন পত্র সরবরাহের ফলে ভারতের মৃৎশিল্প ধবংস হয়ে যায়৷ যে সমস্ত দু’চারটা কারখানা ওরা প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে পুরানো শিল্প গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এরফলে লোকে ধীরে ধীরে নিজেদের পেশা পরিত্যাগ করে কৃষিকার্যে ভিড় লাগাতে শুরু করে৷ সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির চাপ আরও বাড়তে থাকে৷ পরিণতি স্বরূপ জমির ভাগ বাঁটোয়ারা বাড়তে থাকে সমগ্র কৃষিযোগ্য জমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ এর ফলে উৎপাদনের হারও কমতে থাকে৷ বাহির থেকে খাদ্য আমদানি করে ভারতীয় অধিবাসীদের খাদ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা শুরু হয়ে যায়৷ কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় খাদ্য আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ভারতের খাদ্য সমস্যা তীব্রভাবে দেখা দেয়৷ বাঙলাদেশে ১৯৪৩ সালে যে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তা থেকে মুক্তি বা উদ্বার পাবার জন্যে ওয়েবেল সরকার রেশন পদ্ধতি চালু করেন৷ এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করেও সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু এই সমস্ত ব্যবস্থায় সমস্যা তো সমাধান হয়নি বরং অধিকাংশ লোককে ধীরে ধীরে খাদ্যের রেশনিং-এর ফাঁদে পড়তে হয়৷
ব্রিটিশ চলে যাবার পরও ১৯৪৭ সালে ১৪৫ লক্ষ লোককে রেশনের আওতায় আসতে হয়েছিল৷ এরফলে কালোবাজারী, ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরী ও দুর্নীতি প্রভৃতি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়৷ ভারতের জাতীয় সরকার সেদিন এই সমস্যা দূর করার জন্যে হঠাৎ এই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে উঠিয়ে দেন৷ এই হঠকারিতার জন্যে খাদ্যমূল্য অত্যধিক বেড়ে যায়৷ ফলে পুনরায় খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চাল করতে হয়৷ পরে ভারতের নেতৃবৃন্দ ‘খাদ্যের উৎপাদন বাড়াও’ এই শ্লোগান (‘Grow more food’ campaign) দিয়ে খাদ্য-সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করেন৷ তা কোন অংশেই সার্থক হতে পারে নি৷ এর কারণ হ’ল এই পদ্ধতিতে আাদী জমির উৎপাদনকে বাড়ানোর জন্যে কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তন না করে বন-জঙ্গল কেটে জমির পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা চলে৷ সে সমস্ত জমি চাষযোগ্য হবে কিনা, সে সব বিচার বিবেচনা না করে’ জমির আয়তন বৃদ্ধিতে কোনই ফল হয় না৷ তাদের অধিকাংশ জায়গায় উপযুক্ত সেচব্যবস্থার সুবিধা না থাকার জন্যে কৃষিকার্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়৷ সর্র্র্েপরি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আমলারা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি গাফিলতি দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন৷ কারণ দেশের শাসন-ব্যবস্থার নীতির ফলে কোন দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এরফলে অসৎ ব্যবসায়ীরা ভারতে কৃষিব্যবস্থাকে আধমরা করে রেখে, খাদ্য সমস্যাকে বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ-পূর্তির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ সামগ্রিক বিচারে তাই ভারতের বর্তমান কৃষিব্যবস্থা অতীব দূর্বল৷
যে কোন উন্নত অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হ’ল শতকরা ৩০ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ ভাগ লোক কৃষি ও বাকী লোকেরা শিল্পে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকবে৷ কৃষিতে অধিক লোকের চাপ সুস্থ অর্থনীতির লক্ষণ নয়৷ কিন্তু ভারতের প্রায় ৭৫ শতাংশ লোক জমির ওপর নির্ভরশীল৷ ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে এটি বিপজ্জনক লক্ষণ৷ যারা কৃষি-কাজে আত্ম নিয়োগ করেছে তাদের বছরের মধ্যে বেশিরভাগ দিনই বেকার বসে থাকতে হয়৷ এতে করে মনুষ্যশক্তির অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয় না৷ ভারতের এই কৃষিসমস্যা দূর করা আশু প্রয়োজন৷ এরজন্যে অধুনা ভারতের এক বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কৃষিবিপ্লবের শ্লোগান দিতে আরম্ভ করেছেন৷ তাঁরা চীনের কৃষিবিপ্লবের পদ্ধতিকে অনুসরণ করে ভারতের সমস্যার সমাধান করতে চান, কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা ও ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যার আকাশ-পাতাল পার্থক্য৷ তাই কখনও সেখানকার পলিসি-তে এদেশের সমস্যার সমাধান হবে না৷ চীনের সমস্যা হ’ল কৃষি-ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি করা সত্ত্বেও তার বিরাট জনসংখ্যাকে খাওয়ান সম্ভব হয়ে উঠছে না৷ এই বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের জায়গাও চীনে বর্তমানে নেই৷ তার ওপর জনসংখ্যা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে৷ শিল্পক্ষেত্রে চীন প্রায় সমস্ত সম্পদ নিয়োজিত করে ফেলেছে৷ যে অল্প পরিমাণ শিল্পের সম্ভাবনা বাকী রয়েছে, চীন তা বর্তমানে ব্যবহার করে ভবিষ্যতকে আরও অন্ধকারময় করে দিতে চায় না বলে তার সংরক্ষণ করে চলেছে৷ সুতরাং চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা এখন প্রধানতঃ তিনটি, ১৷ কৃষিব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্যে খাদ্য সরবরাহ করা, ২৷ কৃষিকার্যে বেশ কিছু সংখ্যক লোককে নিয়োজিত করা ও ৩৷ শিল্প-কারখানা প্রসার করে বাকি সংখ্যক লোকদের কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া৷
এই তিনটির কোনটাই তাড়াতাড়ি করে ফেলা সম্ভব নয় বলে মাওবাদে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে৷ তিববত, ভারতবর্ষ ও রুশের ওপর চীনের যে হামলা তার মূলে রয়েছে এই জমির ক্ষুধা৷ এটাই চীনের পক্ষে এখন কৃষি বিপ্লবের চতুর পরিকল্পনা৷ (ক্রমশঃ)