মহান আদর্শের জন্যে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন তাঁদেরই বলা হয় দধীচি

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

পুরাণে দধীচি ঋষির কাহিনী রয়েছে৷ এখানে বলা প্রয়োজন, প্রাচীনকালে ৪ ধরণের পুস্তক রচনা করা হ’ত৷ কাব্য, পুরকথা বা ইতিকথা, ইতিহাস ও পুরাণ৷ কাব্য হ’ল ছন্দ, উপমাদি সংযোগে রসসমৃদ্ধ আকর্ষণীয় রচনা৷ ‘বাক্যং রসাত্মক কাব্যম্’৷

পুরকথা হল ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ৷ আবার পুরকথার কিছু কিছু ঘটনা --- যা বিশেষ ভাবে শিক্ষণীয়---তাকে কেন্দ্র করে বিশেষ এক ধরণের রচনাকে বলা হয় ইতিহাস৷ সংসৃকত পুরাবৃত্ত মানেই ইতিহাস নয়৷ ‘‘ধর্র্মর্থকামমোক্ষার্থ্ নীতিবাক্য সমন্বিতম্/ পুরাবৃত্ত-কথাযুক্তমিতিহাস প্রচক্ষ্যতে৷’’ যা জানার ফলে ধর্ম-অর্থ-কাম -মোক্ষ---এই চতুবর্গের ফলপ্রাপ্তি হয়--- যাতে নীতিকথা আছে এইরূপ যে পুরকথা বা ইতিকথা তাকেই ইতিহাস বলা হয়৷

আর, পুরাণ হ’ল লোকশিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ এখানে সত্যমিথ্যাটা বড় কথা নয়, লোকশিক্ষাটাই বড় কথা৷

যা বলছিলাম, পুরাণ-কথিকায় আছে, বৃত্রাসুরের আক্রমণে দেবাতারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্রহ্মার কাছে অসুর দমনের উপায়ের সন্ধানে গেলেন৷ তখন ব্রহ্মা বললেন, প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে বৃত্রাসুরকে নিধন করা যাবে না৷ যদি কেউ স্বেচ্ছায় নিজ অস্থিদান করে---ওই অস্থি দিয়ে নির্মিত অস্ত্রের সাহায্যেই একমাত্র বৃত্রাসুর বধ হতে পারে৷ তখন সমস্ত দেবতারা দধীচি মুনীর শরণাপন্ন হলেন৷ দধীচি মুনী সব জেনে সানন্দে নিজের জীবন দান করার জন্যে সম্মত হলেন৷ তারপর ‘দধীচি ত্যজিলা তনু দেবের মঙ্গলে’৷ তখন দধীচি মুনীর অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্র্ম বানালেন বজ্র৷ আর সেই বজ্র দিয়ে ইন্দ্র বৃত্রাসুর নিধন করে অসুরদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার করলেন৷

বলাবাহুল্য, ‘স্বর্গ’ বলে ঊধর্বাকাশে কোথাও একটা পৃথক স্থান আছে আর ‘নরক’ নামেও পৃথক কোনো স্থান রয়েছে, এ ধারণা নিছক কাল্পনিক৷ আসলে স্বর্গ হল--- মনোজগতের এক উচ্চাবস্থা --- যাকে ভূমামনের ‘স্বর্লোক’ বলা হয়৷ নরকও তেমনি অধোগতি প্রাপ্ত মনেরই এক অবস্থা৷ তেমনি সুর বা দেবতা অথবা ‘অসুর’ বা দানব বলে পৃথক কোন জীব নেই৷

‘‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক৷

               কে বলে তা বহুদূর

মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক

               মানুষেতে সুরাসুর৷’’

তাই প্রকৃত পক্ষে, দেবতা হল সৎ মানুষদের প্রতীক,অসুর হল অসৎ অত্যাচারী মানুষের প্রতীক৷ আর ‘দধীচি’ হ’ল মহৎ আদর্শের জন্যে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেন তাঁদেরই প্রতীকী নাম৷

বর্তমানে প্রচলিত বাংলায় যাঁরা মহৎ আদর্শের জন্যে আত্মোৎসর্গ করেন তাঁদের জন্যে সাধারণতঃ ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ আরবী ‘শহীদ্’ থেকে আগত বাংলা শ‘হিদ শব্দের প্রকৃত অর্থ ইসলাম ধর্মের জন্যে’ যারা জীবন উৎসর্গ করেন৷ আর Martyr-এর মূলগত অর্থ হ’ল, যাঁরা খৃষ্টধর্মের জন্যে আত্মত্যাগ করেছেন৷ যাইহোক, সেদিক থেকে ‘দধীচি’ শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক---যাঁরা মহত্তর আদর্শের জন্যে আত্মোৎসর্গ করেন৷

‘দধীচি’ আসলে বিশেষ কোনো মুনীর নাম নয়, লোক শিক্ষার্থে রচিত পুরাণ কথিকায় মহান আদর্শের জন্যে আত্মোৎসর্গকারী প্রতীকী নামই ‘দধীচি’৷