মানসিক রূপান্তরণের দ্বারাই জীব মুক্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে, আর সেটা তখনই সম্ভব হয় যখন জীব পরমপুরুষকে নিজের একমাত্র আভোগ বা আরাধ্য হিসেবে স্বীকার করে নেয়৷ মানুষের তথা সাধকের স্বভাবই হচ্ছে পরমপুরুষরূপ মানস–আভোগ থেকে উৎসারিত তরঙ্গসমূহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁর সমস্ত গুণকে আত্মসাৎ করে নেওয়া৷ তাই বলা হয়েছে ঃ–
‘‘অপিচেৎ সুদূরাচারো ভজতে মামনন্যভাক৷
সো অপি পাপবিনির্মুক্তো মুচ্যতে ভববন্ধনাৎ৷৷’’
সুদূরাচারী কাকে বলব? দূরাচারী কথাটার অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের পাপী৷ আর সুদূরাচারী মানে হ’ল দূরাচারীও তার পাপের জন্যে তাকে ঘৃণা করে৷
ভজন মানে কি? তোমরা জান ঈশ্বর–সন্নিধানের নানান উপায় আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভজন বা ভজনা৷ সাধক যখন তার কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সবগুলোকে ইষ্টের সেবায় নিয়োজিত করে তাকেই বলে ভজন৷ ভক্ত ভজন–কীর্ত্তন করে আর তার কাণ তা শুণতে থাকে অর্থাৎ এতে তার সমস্ত ইন্দ্রিয়, সমস্ত কর্ণেন্দ্রিয়–জ্ঞানেন্দ্র্ ঈশ্বর সেবাতেই ন্যস্ত রয়েছে৷ এই যে বিশিষ্ট ভাবনাভূতি তাই হচ্ছে ভজন৷ এখানে পরমপুরুষ বলছেন যে একজন সুদূরাচারীও যদি অনন্যমনসা হয়ে তাঁর ভজনা করে তবে সেও পাপের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে৷
পাপ বা পাপবন্ধন কাকে বলব? পাপের দু’টি প্রকারভেদ–একটি পাপ, অন্যটি প্রত্যবায়৷ নৈতিক অনুশীলনে অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়৷ যা করতে হবে তাকে সংস্কৃতে বলি ‘বিধি’ আর যা করা উচিত নয় তাকে বলি ‘নিষেধ’৷ যদি কেউ বিধিপালন না করল তাহলে সে প্রত্যবায়গ্রস্ত হ’ল, নিষেধকে যে মান্য করে না চলল সে পাপগ্রস্ত হয়ে গেল৷ চুরি করা উচিত নয়, এটি একটি নিষেধ৷ তা সত্ত্বেও যে চুরি করল সে পাপ করল৷
পাপের আবার তিনটি প্রকারভেদ–তার মধ্যে একটি হচ্ছে পাতক৷ সুদূরাচারী হ’ল মহাপাতকী যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট রকমের পাপী৷ কিন্তু পাতকী মানে নৈতিক অনুশীলন অমান্য করা৷ ধর, একজন চুরি করে বা জোরপূর্বক অন্যের কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে নিল৷ যে সেটা করল সে অবশ্যই পাপ করল কিন্তু সেই ব্যষ্টি যদি টাকাটা ফিরিয়ে দিল, আর যার কাছ থেকে চুরি করেছিল সে যদি তাকে ক্ষমা করে দিল তাহলে পাপের দোষ স্খালন হয়ে গেল৷
কিন্তু অতিপাতকের কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই৷ ধর, একজন নির্দোষ ব্যষ্টির হাতই কেউ কেটে দিল৷ সেবেত্রে সে কোনভাবেই সেই ব্যষ্টিকে হাত ফিরিয়ে দিতে পারবে না অর্থাৎ এখানে পাপের কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই৷ এই হচ্ছে অতিপাতক৷ মহাপাতক হচ্ছে এমন ধরনের অতিপাতক যা বারংবার অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে৷ ধর, একজন অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল দেওয়ার একটি বিশেষ উপায় উদ্ভাবন করল৷ সে গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের বীজ মিশিয়ে দেওয়া শুরু করল৷ এক্ষেত্রে সে যে পাতকের কাজ করল যার প্রভাব অনবরত চলতেই থাকবে কেননা অন্য ব্যবসায়ীরা এটা শিখে নিয়ে সেরকমটাই করতে থাকবে৷ এই ধরনের পাপকে বলে মহাপাতক৷
পাতকের প্রায়শ্চিত্ত আছে কিন্তু অতিপাতকের নেই৷ আর মহাপাতকীই যদি প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় তবে তার একটিই উপায় আছে আর তা হচ্ছে বিশ্বের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া৷
কিন্তু এখানে কৃষ্ণ বলছেন, ‘যদি সেই সুদূরাচারী অর্থাৎ মহাপাতকী আমার ভজনা করে তাহলে আমি তাকে পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত করব’৷ ‘মুচ্যতে ভববন্ধনাৎ’–অর্থাৎ ‘ভব’ থেকে মুক্ত হওয়া৷ ‘ভব’ কাকে বলব? ‘ভব’ কথাটার অর্থ হচ্ছে কর্মজনিত সংস্কার যার জন্যে পূণর্জন্ম হয়৷ ভগবান বলছেন যে, সুদূরাচারীও ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়৷ অর্থাৎ সে পরমাস্থিতি প্রাপ্ত হয়৷
তোমরা সবাই সাধক৷ তোমরা এই কথাটা কখনও ভুলবে না৷ আত্মিক উন্নতির জন্যে জ্ঞান–কর্ম–ভক্তি এই তিনেরই প্রয়োজন৷ কিন্তু পরমাস্থিতি লাভ করতে হলে ভক্তি অত্যাবশ্যক৷ ভক্তি বিনা পরমপুরুষের নিকটে আসা সম্ভব নয়৷ তাই বলা হচ্ছে, ‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরিয়সী’৷ –জুন ১৯৬৬, চেন্নাই