নিরাপত্তার  পরিবর্ত্তে নির্যাতন ঃ এ কোন আশ্রয়?

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

 সারাদেশের প্রত্যেক রাজ্যেই সরকারী ও বেসরকারী পরিচালনায় মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধীদের জন্যে ‘হোম’ বা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে আবাসিকগণের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা৷ কিন্তু মাঝে মধ্যেই এই সমস্ত হোমগুলির সম্পর্কে জঘন্য ও নিন্দনীয় ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়৷ কয়েকদিন আগে হাওড়া জেলার জয়পুরের পারবাকসিতে অবস্থিত একটি বেসরকারী হোমের চারজন কিশোরীকে যৌননির্যাতনের অভিযোগে সেই হোমেরই তিনজন কর্মী --- কেয়ার টেকার ফণীমোহন বাগ, কর্মী প্রতাপ প্রামাণিক ও ড্রাইভার বাবলু ধাড়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ নির্যাতিতাদের মধ্যে তিনজন মানসিক প্রতিবন্ধী ও একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী৷ কয়েকদিন আগে জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক হোম পরিদর্শনের সময় আবাসিকদের কাছ থেকে এই যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পান৷ এরপরে ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয় ও ফলস্বরূপ হোমের উপর্যুক্ত কর্মীগণকে ‘‘পকসো’’ আইনে গ্রেপ্তার করে গত শনিবার, ১লা ডিসেম্বর ২০১৮, উলুবেড়িয়া আদালতে হাজির করানো হয়৷

বছর আটেক আগে ২০১২ সালের জুলাই মাসে হুগলি জেলার গুড়াপের একটি বেসরকারী হোমের ঘটনায় চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল৷ সেই সময় মাটি খঁুড়ে ওই হোমের এক আবাসিক মহিলার পচাগলা দেহ পাওয়া যায়৷ তদন্তে জানা যায় যে যৌন নির্যাতনে বাধা দেওয়ার কারণে তাঁকে খুন করে মাটিতে পঁুতে দেওয়া হয়েছিল৷ পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলির তিওড়ের বেসরকারী হোমে ও নদীয়ার কৃষ্ণনগরের সরকারী হোমে, ২০১৬ সালে কুচবিহারের বাবুর হাটের সরকারী হোমে ও বিভিন্ন সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সরকারী বেসরকারী হোবামগুলিতে কোথাও যৌননির্যাতন , কোথাও শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার , খুন , আবাসিকদের হোম থেকে পলায়ন ইত্যাদি নানা ধরনের ঘটনার সংবাদ পত্রপত্রিকায় ও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ শুধু এই রাজ্যেই নয়, অন্যান্য রাজ্যের হোমগুলিতেও একই অবস্থা পরিদৃশ্যমান৷ বেশ কিছুদিন আগে বিহারের ১৭টি ‘শেলটার হোম’ এর যৌন নির্র্যতনের ঘটনা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনামে এসেছিল৷ এই ঘটনাগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে অভিযুক্তরা হলেন সেইসব হোমেরই কর্র্তব্যষ্টিগণ কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীবর্গ--- অর্থাৎ রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ৷

এই সমস্ত হোমগুলির আবাসিকগণ হলেন সমাজের সর্র্বপেক্ষা দুর্বল অংশ যাঁরা অনন্যোপায় হয়েই হোমগুলিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন৷ এমনকি নিজের  পরিবার-পরিজনদের কাছেও যারা নিরাপত্তা পান না তাদেরও এই হোমগুলিতে রাখার ব্যবস্থা হয়--- বিশেষতঃ বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপে৷ এই হোমগুলিতে যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা ও সাময়িক  পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকে বলেই শোণা যায় ও কর্ত্তৃপক্ষও তা-ই বলে থাকেন৷ তথাপি হোমগুলিতে এইধরণের ঘটনা ঘটে কিভাবে? আমরা যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি তার গভীরে প্রবেশ করলেই এই প্রশ্ণের উত্তর খঁুজে পাওয়া সম্ভব৷ বৈশ্যতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থার মূল প্রতিপাদ্যই হল’ ভোগবাদ আর দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার ও শোষণ৷ মানবিক মূল্যবোধ , ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠা এই সমাজব্যবস্থায় অচল পয়সার মত মূল্যহীন৷ পৃথিবীর সমস্ত কিছুকেই ভোগ্য হিসেবে করায়ত্ত করার সীমাহীন লোভ মানুষকে সর্ববিধ অন্যায় ও দুর্নীতির পথে পরিচালিত করে চলেছে৷ ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষও তাই আজ ভোগ্যপণ্যে পরিণত৷ বয  উদ্দেশ্যে আইনকানুনও তৈরী হয়৷ কিন্তু এই আইনকানুনগুলির যথাযথ প্রয়োগ ও পালন করার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত থাকে তারা এই সমাজেরই অংশ৷ তাই গাছের গোড়া কেটে উপর থেকে জল ঢাললে কোন লাভ হয় না--- সব পরিশ্রম ও ব্যবস্থাপনা বিফলে যায় ৷ সেই কারণে গোড়াটি মজবুত হওয়া একান্ত প্রয়োজন৷ তাই মানুষের সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়নীতির ভিত দৃঢ় না হলে ভোগবাদ ও জড়বাদের ষ্টীমরোলারে পিষ্ট হওয়া ছাড়া সেই সমাজের মানুষের সামনে অন্যপথ খোলা থাকে না৷

বহু মানুষের সমাহারেই সমাজের সৃষ্টি৷ সমাজের মানুষগুলি যদি সুন্দর হয় তবে সমাজও সুন্দর হতে বাধ্য৷ প্রত্যেক মানুষ তার মন ও বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়৷ এই মনের আবেগেই একজন অপরজনকে ভালোবাসে , প্রেম-প্রীতি স্নেহমায়া মমতার ডোরে বাঁধে৷ আবার এই মনের কালিমার কারণেই লোভ-লালসা, হিংসা-সন্ত্রাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৷ একটা চারা গাছ কে যেমন বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত রেখে বড় করা হয়, ঠিক তেমনই মানুষকেও শিশুকাল থেকে সত্য-ন্যায়ের পথে চলার সুশিক্ষা দান অত্যন্ত প্রয়োজন৷ এরজন্যে আধ্যাত্মিকতার পাঠ নিতেই হবে৷ কারণ, আধ্যাত্মিক চেতনা ব্যতীত নৈতিকতার শিক্ষা সম্পন্ন হয় না৷ আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি সুদৃঢ় হলেই নৈতিক চরিত্রের মান উন্নত হয়, সত্য ও ধর্মের পথে চলার অনুপ্রেরণা জাগে৷ এইজন্যেই অতীতের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতা, মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ছিল গভীর ও নিবিড়৷ সেই সময়ে গুরুগৃহে ছাত্র-ছাত্রাদের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতারও শিক্ষা দান করা হত৷ কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আধ্যাত্মিক দিককে অবহেলা করার ফলে ছাত্রছাত্রাদের নৈতিক চরিত্র নির্র্মণ যথাযথ ভাবে হচ্ছে না৷ তারা ভবিষ্যতে এক একজন দক্ষ অর্থউপার্জনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রতিযোগীরূপে পরিগণিত--- যেন তেন প্রকারে বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে প্রকৃত মানুষ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না৷ ফলে সত্যিকারের মানুষের সমাজও গড়ে উঠতে পারছে না৷

মানুষ সামাজিক জীব ও নিজেদের প্রয়োজনে সমাজ রচনা করেছে৷ সমানম্ এজতে ইতি সমাজঃ৷ সমাজের প্রত্যেক সদস্যই সমান সুবিধা ও অধিকার ভোগ করার ভাগীদার৷ প্রত্যেকের সবরকম বিস্তারের সুযোগ থাকতে হবে যাতে তার প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব হয় ও সমগ্র সমাজ তার দ্বারা উপকৃত হয়৷ সমাজের কাউকে বঞ্চিত, প্রতারিত বা শোষিত হতে দেওয়া চলবে না৷ একমাত্র তখনই সমাজ শব্দটির সার্থক রূপায়ণ সম্ভব হবে৷ এই উদ্দেশ্যেই মহান দার্শনিক তথা আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার যুগোপযোগী সর্র্বনুসূ্যত পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক দর্শন ‘আনন্দমার্গ’ ও সামাজিক -অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ বা PROUT - Progressive Utilisation Theory প্রবর্তন করেছেন৷ আনন্দমার্গের যোগসাধনা, যম-নিয়ম আসন প্রাণায়াম, ধ্যান-ধারণা, সমাধি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করবে ও প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে৷ আর আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাউট দর্শনের প্রয়োগে একটি শোষণহীন সমাজ তৈরী হবে যেখানে প্রত্যেকটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনের (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা) নিশ্চিততা থাকবে৷ সমাজের শোষণের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে প্রাউট দর্শনের মূলনীতিগুলির মধ্যে৷ বিশ্বের সমগ্র সম্পদে সৃষ্টির প্রতিটি সত্তার ভোগ দখলের সমানাধিকার প্রাউটতত্ত্বে স্বীকৃত হয়েছে৷ সমাজের নেতৃত্ত্বে থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত, বলিষ্ঠ চরিত্র বিশিষ্ট আপোষহীন সংগ্রামী, নীতিবাদী ব্যষ্টিগণ---এক কথায় যাঁদের সদবিপ্র বলা হয়৷

আনন্দমার্গ দর্শনের মূলনীতিই হলো ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’৷ প্রতিটি মানুষ সাধনার দ্বারা নিজ মুক্তির জন্যে নিরন্তর সত্য ও ধর্মের পথে এগিয়ে চলবে আর সেবা ও ত্যাগের দ্বারা জগতের হিত বা কল্যাণের চেষ্টা করে যাবে৷ সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলা যদি কঠোরভাবে বলবৎ করা হয় ও নীতিবাদের পথে চলায় কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে তবে সেই সমাজের মানুষেরাও সত্য ধর্মের পথে নির্দ্বিধায় এগিয়ে চলবে৷ সৎ নীতিবাদী মানুষের দ্বারা তৈরি সমাজ অবশ্যম্ভাবীরূপে শোষণহীন সমাজে পরিণত হবে৷ এই সমাজের প্রতিটি গৃহকোণই হবে সব মানুষের নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ আশ্রয়৷ তখন হয়তো আর কোনো হোমের প্রয়োজন হবে না বা কোনো নারী, শিশু, যুবতীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না৷ তাই আজকের পৃথিবীতে যতদ্রুত সম্ভব আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এক সুন্দর নিরাপদ আশ্রয় স্থাপনার শপথ গ্রহণ করতেই হবে৷