পক্ষাঘাত (প্যারালিসিস)

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

হরূপী যন্ত্রের আপাতঃ নিয়ন্তা তার মস্তিষ্ক৷ সংজ্ঞা ও আজ্ঞা নাড়ীর সাহায্যে মস্তিষ্কই বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে ভাব গ্রহণ ও সঞ্চালন করে’ থাকে৷ এই মস্তিষ্করূপী স্নায়ুকেন্দ্র আবার দক্ষিণ ও বাম ভেদে মোটামুটি দু’টি অংশে বিভক্ত৷ দক্ষিণ মস্তিষ্কস্থ স্নায়ুপুঞ্জ দেহের বাম অংশ বা বাম পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে ও বাম মস্তিষ্ক স্নায়ুপুঞ্জ দেহের দক্ষিণ অংশ বা দক্ষিণ পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ রক্তের চাপে বা অন্য কোন কারণে মস্তিষ্কের কোন একটি অংশের স্নায়ুপুঞ্জ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে’ পড়লে সেই অংশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেহাংশ বা পক্ষ নিষ্ক্রিয় হয়ে’ পড়ে৷ দেহাংশবিশেষের এই যে নিষ্ক্রিয়তা একেই বলা হয় পক্ষাঘাত বা পক্ষবধ রোগ৷

কারণ ঃ মস্তিষ্কের এক একটি বিশেষ অংশ সংজ্ঞা নাড়ীর সাহায্যে এক একটি বিশেষ ভাব গ্রহণ করে৷ রক্তের চাপে অথবা অন্য কোন আঘাতে মস্তিষ্কের ওই অংশ বা স্নায়ুকোষ বিকৃত হয়ে পড়লে অথবা স্নায়ুকোষ বা স্নায়ুতন্তু ছিন্ন হয়ে’ গেলে বা সংজ্ঞা নাড়ী (যে কোন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গেই হোক না কেন) ত্রুটিযুক্ত হয়ে’ পড়লে সংজ্ঞাভাব জীবমানসে পৌঁছায় না৷ স্নায়ুর ত্রুটি বা বিচ্ছিন্নতা নিৰন্ধন সেই অঙ্গ–প্রত্যঙ্গও উত্থানশক্তি রহিত হয়ে’ যায়৷ অনুরূপভাবে যে আজ্ঞা নাড়ীর সাহায্যে মস্তিষ্ক ভাব–সঞ্চালন করে’ থাকে সেই আজ্ঞা নাড়ীতে কোন বিকৃতি এসে গেলে বা তার পরিচালক স্নায়ুকোষে কোন ত্রুটি দেখা গেলে, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলেও সংশ্লিষ্ট দেহাংশে পক্ষাঘাত রোগ দেখা দেয়৷ এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে মস্তিষ্কের যে কোষ যে ভাবের গ্রাহক বা বাহক, তার ত্রুটিতে কেবলমাত্র সেই অঙ্গই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে’ যায় বা সেই বোধই নষ্ট হয়ে যায়৷ সেইজন্যে এমনও দেখা যায় যে একই ব্যষ্টি যিনি সংস্কৃত ও ইংরেজী দুয়েতেই পণ্ডিত তাঁর মানসিক পক্ষাঘাতের ফলে (স্মৃতিভ্রংশ) হয়তো বা সংস্কৃত–জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেছে’ কিন্তু ইংরেজী জ্ঞান অটুট রয়েছে৷ পক্ষাঘাত রোগটি যে সৰ সময়েই সম্পূর্ণ ৰাম অংশে হৰে বা সম্পূর্ণ দক্ষিণাংশে হৰে এমন কোন কথা নেই৷ পূর্ববর্ণিত কারণ অনুযায়ী দেহের দক্ষিণাংশের বা বামাংশের কোন একটি বিশেষ অঙ্গেও এই ব্যাধি সীমিত থাকতে পারে৷ যেমন দক্ষিণ চক্ষু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে’ গেছে, ৰাম চক্ষু ঠিক আছে, আবার দক্ষিণ মাড়ী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে কিন্তু বাম মাড়ী ঠিক আছে৷

যে সমস্ত কারণে রক্তচাপজনিত রোগ সৃষ্টি হয় পক্ষাঘাত রোগটিও প্রায়শঃ সেই সকল কারণেই উৎপন্ন হয়৷ কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্নায়বিক ত্রুটি রক্তের চাপেই সংঘটিত হয়, কিন্তু এ ছাড়াও এ ব্যাধির আরও দু’ একটি কারণ আছে৷ যেমন, যারা অতিলোভী বা ঔদরিক অথবা যারা অত্যধিক আমিষভক্ত তাদের রক্ত অম্লবিষে জর্জরিত হয়ে’ গেলে সেই বিষ অনেক সময় স্নায়ুতন্তুকে ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন করে’ দিয়ে পক্ষাঘাত রোগগ্রস্ত করে দেয়৷ যে সকল লোকের মণিপুর চক্র অতিক্রিয় তাদের মধ্যে কাম–ক্রোধাদি বৃত্তির প্রাবল্য দেখা দেয়৷ ওই সকল ব্যষ্টিরা বেশ কর্মতৎপরও হয়ে’ থাকে, কিন্তু ক্রোধাধিক্য ও কামাধিক্য নিৰন্ধন এরা প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগে থাকে৷ এই সকল পিত্তপ্রধান ধাতুর লোকেরা জীবনে যদি কোন মহৎ আদর্শ না পায়, সেক্ষেত্রে কাম ও ক্রোধ রিপুর অতি সেবার ফলে তাদের দেহের নিম্নাংশ দুর্ৰল হয়ে যায় ও অনেক সময় দেহের নিম্নাংশের স্নায়ুতন্তু ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন হয়ে’ গিয়ে সেখানে পক্ষাঘাত রোগ সৃষ্টি করে৷ এই সকল পিত্তপ্রধান ধাতুর যে সকল রোগী জীবনে উচ্চ আদর্শ পেয়ে থাকে তারা দেহের ঊধর্বাংশের অতিক্রিয়তা নিৰন্ধন দেহের ঊধর্বভাগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে’ পড়ে৷ মনে রাখা দরকার যে এই ব্যধির সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতি নিকট সম্বন্ধ থাকে৷

চিকিৎসা ঃ প্রাতেঃ–উৎক্ষেপমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, যোগমুদ্রা, ভুজঙ্গাসন (অথবা এই তিনটি আসনের মধ্যে যেটি করা সম্ভব), পক্ষবধ প্রাণায়াম৷

সন্ধ্যায়–সকালের অনুরূপ৷

পথ্য ঃ এই ব্যাধিতে ক্ষার জাতীয় দ্রব্য অর্থাৎ ফলমূল–শাকসব্জির ঝোল ও যথেষ্ট পরিমাণে নেবুর রস গ্রহণ করা বিধেয়৷ রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থায় নেবুর রস সহ স–ম্বু উপবাসই একমাত্র করণীয়৷ দৈনিক প্রায় ৪১–২ সের জল রোগীর পক্ষে পান করা উচিত তবে কখনও একসঙ্গে আধ পোয়ার অধিক নয়৷

বিধিনিষেধ ঃ– আমিষাহার, মৈথুন, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার, দিবানিদ্রা, রািত্র জাগরণ প্রভৃতি কঠোরভাবে বর্জনীয়৷ ব্যাপক স্নান এই রোগে অত্যন্ত হিতকর৷ গ্রীষ্মে ও শীতকালে নির্দিষ্ট সময়ে আতপস্নানও রোগীকে করতে হৰে৷ প্রথমে সর্বাঙ্গে আতপস্নান করে’ অতঃপর ভিজে তোয়ালে দিয়ে সর্বাঙ্গ মুছে নিয়ে তারপর কেবলমাত্র রোগগ্রস্ত দেহাংশেই আতপস্নান করতে হৰে৷ একটানা ১৫৷২০ মিনিট ধরে’ এই রকমভাৰে রোগগ্রস্ত অঙ্গে দু’তিনবার আতপস্নান করবার পরে সর্বশেষে ওই অঙ্গে উত্তমরূপে মর্দনক্রিয়া করে’ নিতে হৰে (তৈলসহ বা শুষ্ক)৷   (‘‘যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ’’)

 

কণ্টকারী (ক্রোড়পর্ণী) ও বসন্তরোগ

‘ক্রোড়পর্ণী’ শব্দের অর্থ হ’ল কণ্টকারী৷ কণ্টকারী একটি ঔষধ৷ রাঢ়ের মানুষ কণ্টকারী ফল খেতেন৷ পথেঘাটে–জঙ্গলে–বা এই কণ্টকারীর গাছ অযত্নে জন্মায়, অনেক সময় আগাছা হিসেবে তুলে ফেলতে হয়৷ এর পাতা বেগুন পাতার মত কিন্তু পাতায় বেশ কাঁটা আছে৷ গ্রাম ৰাংলায় একে কেউ কেউ জঙ্গলী বেগুনও বলে থাকেন৷ ঈষৎ তিক্ত এই কণ্টকারীর ফল তথা অধিক তিক্ত এর শেকড় নানাবিধ রোগের, বিশেষ করে চর্মরোগের ঔষধ বলে পরিচিত৷ এক আনা পরিমিত (১–গ্রামের মত) কণ্টকারীর মূল আড়াইটা গোলমরিচের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে এক বৎসরের মধ্যে বসন্তরোগের আক্রমণ হয় না৷  কণ্টকারীর শেকড়ের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে কফরোগের ঔষধ তৈরী হয়৷

লাট খাওয়া হাম বা বসন্ত ঃ

কুলের পাতা মিহি করে শিলে ৰেটে এক বালতি জলে বাটা জিনিস ফেলে দিয়ে খানিকক্ষণ ধরে’ হাতে করে’ নাড়লে জলের ওপর ফেনা দেখা দেয়৷ চামড়ার ওপর সেই ফেনা লাগালে লাট–খাওয়া বসন্ত বা লাট খাওয়া হাম জেগে ওঠে৷ তখন তা আর মারাত্মক থাকে না৷৮১ গাছটি বার্তাকু (বেগুন) বর্গীয়৷ তবে মাটিতে শুয়ে শুয়ে এগিয়ে যায়৷ কাঁটার সংখ্যা একটু বেশী৷ এর ফল অল্প তেলে ভেজে অগ্ণ্যাশয়ের ঔষধ রূপে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহারের বিধি প্রচলিত আছে৷