প্রভাত  সঙ্গীত ও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি

লেখক
শ্রীজ্যোতির্ময় পাহাড়ী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এক প্রভাত সঙ্গীতে তিনি বলেছেন,---

‘‘বৎসর , নববৎসর, তুমি কল্যাণ এনো চারিদিকে

নূতন ভোরের হাতছানিতে  নূতন ঊষার নবালোকে৷৷

বৃক্ষলতারা সবুজে ভরুক বন্যপশুরা নিরাপদ হোক

পাখীরা কন্ঠে অমিয় ভরিয়া উড়িয়া বেড়াক দিকে দিকে৷৷

মানুষে মানুষে ভেদ দূরে হোক, বুদ্ধির অপচয় রোধ হোক,

শক্তির সর্বনাশা প্রতাপ সংযত হোক সবদিকে৷৷’’

শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদতত্ বলেছেন, মানুষ যুক্তিবর্জিত ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানবসমাজের খুব ক্ষতিসাধন করেছে এবং বর্তমানেও করে চলেছে৷ এটা করা চলবে না, এই ধরনের কাজ জিও সেন্টিমেন্ট বা ভৌমভাবাবেগ৷ বিশেষ কোন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এই ভাবাবেগের  সৃষ্টি হয়৷ ইহা এক প্রকার উগ্র প্রাদেশিকতা যা অন্যান্য প্রদেশ  বা দেশের ক্ষতি করে৷ এই প্রবনতা থেকে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব৷ অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মমত ইত্যাদি  বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই জিও সেন্টিমেন্ট কাজ করে ঠিক এইভাবে বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর  স্বার্থরক্ষার জন্য অন্যান্য জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের  উপর শোষন, অবিচার, অত্যাচার সোসিও সেন্টিমেন্টের  ফলে হয়ে থাকে৷ জিও সেণ্টিমেণ্ট ও সোসিও সেণ্টিমেণ্টের মত মত হিউম্যান সেন্টিমেন্ট ও তথা কথিত মানবতাবাদ মানুষের স্বার্থের কথা বলে অথচ মানুষ ছাড়া জগতে যে অন্যান্য প্রাণীসত্তা আছে তাদের  কথা ভাবে না৷ তাও ক্রুটিপূর্ণ৷ মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পৃথিবীর জীবজন্তু, গাছপালা ও জঙ্গল ধবংস করে চলেছে৷ এই কাজ কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ বিবর্তনের পথ ধরে পৃথিবীতে জলজ, স্থলজ প্রাণী ও গাছপালা সৃষ্টি পর মানুষের সৃষ্টি৷ জীবের  মধ্যে মানুষ বেশী বুদ্ধিমান৷  মানুষ এই বুদ্ধির অধিকারী হয়েও যদি  অন্যান্য পশুপাখী, গাছপালা খুশীমত  ধবংস করে তবে পৃথিবীতে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে ও ভবিষ্যতে এই পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে৷ তাই জীব জগতের অভিভাবক হিসাবে সকলকে  রক্ষণাবেক্ষণ করা মানুষের কর্ত্তব্য৷ তাই পরমপুরুষ বলেছেন, শুধু মানুষকে ভাল বাসলে হবে না, পশুপাখী, গাছপালা, সকলকে ভালবাসতে  হবে এবং এই ভালবাসার  মাধূর্যকে পৃথিবীর সকল প্রাণী ও অপ্রাণী সত্তার সঙ্গে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বগত প্রান হতে হবে৷ নব্যমানবতাবাদের  মূলকথা প্রভাত সঙ্গীতের বিভিন্নগানের মধ্যে বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে৷

মহাসম্ভূতি ও মহান দার্শনিক শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ার জন্য তাঁর যুগান্তরকারী  ‘‘প্রাউট’’  (PROUT) দর্শনের কথা প্রভাত সঙ্গীতে বলেছেন,---

‘‘এ গান থামিবে না, এ দাবী দমিবে না,

পথ বেঁধে দিল ‘আলোকজ্জ্বল

প্রাউটের প্রেষণা’’৷৷

বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদ মানুষের সার্বিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে৷ পুঁজিবাদ শোষন করে মানুষকে ভিখারীতে পরিণত করেছে৷ মাকর্সবাদ মানুষের মূল্যবান মানবীয় সম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং মানুষের স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে৷ এই অবস্থায় সারা বিশ্বে  সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি  হয়েছে, সেই শূন্যতা  পূরণের জন্য শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী  এক বিকল্প সামাজিক দর্শন জনগণকে উপহার দিয়েছেন , তা হল প্রাউট যার পুরো নাম  প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ আজকের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আদর্শের  খুবই অভাব৷ এই আদর্শের অভাব  থাকার ফলেই সুশৃঙ্খল নীতি পরায়ণ নীতিও নাই আর জনগণের  প্রকৃত কল্যাণকামী কোন প্রগতিশীল দলও নাই৷ বিশ্ববন্দিত মহান দার্শনিক তথা জগদগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি পৃথিবীর মানুষকে  প্রকৃতধর্ম ও ধর্মীয় পথ অর্থাৎ  আনন্দমার্গের  ঠিকানা জানাবার  সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সার্বিক প্রগতির কথা চিন্তার করে ‘‘প্রাউট’’ তত্ত্ব দিয়েছেন৷ প্রাউট আজ পৃথিবীর শোষিত মানুষের মুক্তিমন্ত্র৷ তিনি তাঁর প্রভাতসঙ্গীতে এই নূতন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ণ সুন্দরভাবে বলেছেন---

‘‘সেই সোনালী স্বপনে আমি দেখেছি গো এক দেশ,

যেথা বঞ্চনা নাই কোন, কেউ দেয় নাকো কোন ক্লেশ৷

সেথা কুসুম মধুতে ভরা, নাই কোন কাঁটা তার

সেথা অমার আঁধার  চিরে কৌমুদী ঝলকায়

সেথা গোপনে  গহনে কে সে গেয়েছে গীতি অশেষ৷

সেথা সরিতা জোয়ারে ভরা, নেই কোন ভাটা তায়

সেথা মমতায়  বুকভরা, প্রীতিধারা উপচায়,

সেই আলোর রাজ্যে এসে আমি পেয়েছি প্রীতির বেশ৷

(প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা ১৬৯৩)৷

আজকের বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংসৃকতির  ও ধর্মীয় সকল প্রকার সংকট সমাধানের পথের  কথা প্রাউটে বলা হয়েছে৷  তাই প্রাউট ছাড়া  পৃথিবীকে বাঁচাবার আর অন্যকোন পথ নাই৷

পরিশেষে বলা যায়, জীবন ও সঙ্গীত ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত, উচ্চমানের সঙ্গীতে  মানুষ বেঁচে থাকার  রসদ পায় ও অগ্রগতির সোপানে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পায়৷ এই প্রসঙ্গে বলা  প্রয়োজন যে রাগরাগিনী তথা সঙ্গীত শাস্ত্রের আবিষ্কার করেছিলেন, মহাসম্ভূতি ভগবান সদাশিব যিনি প্রায় সাতহাজার বছর আগে এদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন৷ সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি এই সুর সপ্তক তাঁরই সৃষ্টি৷ সারা পৃথিবীতে সঙ্গীত শাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে সদাশিবের  দেওয়া এই সুর সপ্তকের উপর৷ বর্তমানে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের যুগে অত্যাধুনিকতার আতিশয্যে, বিকৃত রুচির নিম্নমানের গান ও মিউজিকের  আবর্তে পড়ে সর্বত্রই রুচিগর্হিত গানের রমরমা৷ ফলে সদাশিবের দেওয়া সেই মার্গীয় সংস্কৃতির নাচ গান বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ভগবান শিবের দেওয়া সেই সংস্কৃতিকে পুনর্জাগরিত করে তুলেছেন৷ বিশ্বজ্ঞানভাণ্ডার মহাসম্ভূতি, তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারমুক্ত  নব্যমানবতাভিত্তিক  শোষণমুক্ত ‘‘নোতুন পৃথিবী’’ গঠনের উদ্দেশ্যে যে আনন্দমার্গ দর্শন দিয়েছেন তার বিভিন্ন দিক প্রভাত সঙ্গীতের  বিভিন্ন গানে  বিকশিত হয়েছে একটি কথা বলে শেষ করব, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মগুরুর সঙ্গে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান৷ তিনি অনন্য ও  অসাধারণ৷ তাঁর প্রভাতসঙ্গীত ধর্মমত আধ্যাত্মিক দর্শন ও ধর্মানুশীলন পদ্ধতি, নব্যমানবতাবাদ ও প্রাউট দর্শন ও অন্যান্য অনেক বিষয় অভিনবও যুগান্তকারী৷ তাঁর ধর্মমত ও আধ্যাত্মিক দর্শনের জন্য যদি তিনি এক মহান ধর্মগুরু হিসাবে চিহ্ণিত হন, তাহলে কেবলমাত্র এই প্রাউট দর্শনের জন্য তিনি কোটি কোটি ক্ষুধার্ত ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে চিরস্মরণীয়--- এক মহান পরিত্রাতা হিসাব পরিগণিত হবেন৷   (সমাপ্ত)