একটা গল্প আছে৷ একবার হনুমানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, /আচ্ছা হনুমান, তুমি তো বড় ভক্ত৷ তুমি জান যে নারায়ণ ও রামের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই, তবু তুমি সর্বদাই রামের নাম নাও, কদাপি ভুলেও নারায়ণের নাম নাও না৷ যদিও রাম ও নারায়ণ মূলগত ভাবে একই সত্তা, তবু তুমি এমনটি কর কেন?*
হ্যাঁ, নারায়ণ ও রাম তত্ত্বতঃ একই সত্তা৷ কেবল নামেই তফাৎ৷ ‘নারায়ণ’ একটি সংস্কৃত শব্দ৷ নার অয়ন করে সন্ধিবন্ধ শব্দ হ’ল ‘নারায়ণ’৷ সংস্কৃত ‘নার’ শব্দের তিনটি মানে৷ একটি মানে হ’ল জল দ্বিতীয় মানে হ’ল পরমা প্রকৃতি, আর তৃতীয় মানে হ’ল ভক্তি৷ নার + ড = নারদ মানে যিনি জীবকুলে নার অর্থাৎ ভক্তি বিতরণ করেন৷ এখানে ‘নারদ’ শব্দের ‘নার’ মানে ভক্তি৷ ‘নার’ শব্দের আরও দুটো মানে বলেছি জল ও পরমা প্রকৃতি৷ ‘অয়ন’ মানে আশ্রয়৷ শিবায়ন মানে শিবের আশ্রয়৷ রামায়ণ মানে রামের যেটা আশ্রয় অর্থাৎ এমন একখানা গ্রন্থ যাতে রামকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ ‘অয়ন’ মানে আশ্রয়৷ নারায়ণ মানে নার অর্থাৎ পরমা প্রকৃতির আশ্রয়৷ এখানে পরমা প্রকৃতির আশ্রয় কে? –না, পরমপুরুষ৷ তাই নারায়ণ মানে পরমপুরুষ – Cosmic Consciousness, Supreme Cognition৷
এখন ‘রাম’ শব্দের অর্থ কী? একটি মানে হ’ল ‘রমন্তে যোগিনঃ যস্মিন্* অর্থাৎ ‘রাম’ হলেন এমনই এক সত্তা যাকে যোগীরা তাঁদের মানসাধ্যাত্মিক আভোগ (Psycho-spiritual Pabulum) হিসেবে গ্রহণ করেন, মানসাধ্যাত্মিক আনন্দের উৎস বলে মনে করেন৷ এখন এই যে যোগীদের মানসাধ্যাত্মিক আনন্দের উৎস, ইনি কে? –না, পরমপুরুষ৷ তাই ‘রাম’ মানে পরমপুরুষ বা নারায়ণ৷ রাম শব্দের অপর মানে হ’ল–‘রতি মহীধরঃ রামঃ*৷ ‘রাতি’ শব্দের আদ্যক্ষর ‘রা’ আর ‘মহীধরঃ’ শব্দে প্রথম বর্ণ হ’ল ‘ম’৷ বিশ্বের সবচেয়ে জ্যোতিষ্মান সত্তা হ’ল রাম যিনি অপরকেও তারই মত জ্যোতিষ্মান করে তোলেন৷ তাঁর জ্যোতিতে অন্যান্য সত্তারাও জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে৷ চাঁদ তার দীপ্তি পেয়ে থাকে পৃথিবী থেকে৷ পৃথিবী জ্যোতি পেয়ে থাকে সূর্য থেকে আর সূর্য আলো পেয়ে থাকে পরমপুরুষের কাছ থেকে৷ তাই পরমপুরুষ হলেন এমন এক সত্তা যিনি অপরকে তাঁর মত প্রোজ্জ্বল করে তোলেন৷ কে সেই প্রোজ্জ্বল সত্তা?
‘ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং৷
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোয়মগ্ণিঃ৷
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি৷৷’
পরমপুরুষই হলেন সর্বাপেক্ষা জ্যোতির্ময় সত্তা৷ ‘রাতি মহীধরঃ’ মানে সেই পরমপুরুষ–অন্য কেউ না৷ ‘রাম’ শব্দের তৃতীয় মানে হ’ল ‘রাবণস্য মরণম্ রামঃ’৷ ‘রাবণস্য’ শব্দের আদ্যক্ষর হ’ল ‘রা’ আর ‘মরণম্’ শব্দের আদ্যক্ষর হ’ল ‘ম’৷ তাই ‘রাম’ মানে সেই সত্তা যার চাপে রাবণের মৃত্যু হয়৷ ‘রাবণ’ শব্দের মানে হ’ল দুষ্ট মন, অধোগামী মন যা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঊর্দ্ধ, অধঃ, ঈশান, নৈঋত, অগ্ণি ও বায়ু এই দশ দিকেই কাজ করে চলেছে৷ মানুষের যা কিছু দুষ্প্রবৃত্তি যা এই দশ দিকে ছুটে চলে তারই সামূহিক নাম রাবণ৷ রৌ + অণ = রাবণ অর্থাৎ যার প্রবণতা হ’ল নরকের পথে চলা৷ এই রাবণের মৃত্যুর বীজ কোথায় নিহিত? এই দশানন দৈত্যের কোথায় মৃত্যু? মানুষ যখন রামের শরণ নেয় তখনই রাবণের মৃত্যু৷ তাই ‘রাবণস্য মরণম্’ মানে রাম৷ যে মানুষ রামের অর্থাৎ পরমপুরুষের শরণ নেয় সে অবশ্যই রাবণকে নিধন করতে পারে৷ তাই ‘রাবণস্য মরণম্’ মানে পরমপুরুষ৷ তাই রাম ও নারায়ণে কোন মৌল পার্থক্য নেই৷ তবুও /হে হনুমান, তুমি সর্বদাই কেবল রামেরই নাম নাও, কদাপি নারায়ণের নাম নাও না৷ এ কেমনতর ব্যাপার*৷ উত্তরে হনুমান বলছেন ঃ–
‘শ্রীনাথে জানকীনাথে চাভেদঃ পরমাত্মনি৷
তথাপি মম সর্বস্বঃ রামঃ কমললোচনঃ৷৷’
যখন সর্বাধিক আন্তরিকতা নিয়ে কোন বিষয়ের দিকে এগিয়ে যাও তখন মনের যাবতীয় বৃত্তিকে একটা বিশেষ বিন্দুতে সংহত করতে হয়৷ আর সেই সংহত বা একীভূত বিন্দুস্থ অহংবোধকে অদ্বিতীয় সত্তার দিকে চালিয়ে দিতে হয়৷ তাই হনুমান বলছেন, /শ্রীনাথে জানকীনাথে*৷ ‘শ্রী’ শব্দের যোগরূরার্থ হ’ল লক্ষ্মী ধনের দেবতা এর ভাবরূরার্থ হ’ল রজোগুণী শক্তি যা প্রভূত শক্তিসম্পন্ন৷
সংস্কৃত ভাষায় প্রত্যেকটি শব্দের দু ধরনের মানে–একটি ভাবরূরার্থ, অপরটি যোগরূরার্থ৷ ভাবরূরার্থ মানে ব্যুৎপত্তিগত মানে, যোগরূরার্থ মানে ব্যবহার সিদ্ধ মানে৷ ধর, একটা শব্দ ‘পঞ্চানন’৷ ‘পঞ্চানন’ মানে পাঁচটি মুখযুক্ত সত্তা৷ এটি হ’ল ভাবরূরার্থ, কিন্তু মানুষ ‘পঞ্চানন’ শব্দ ব্যবহার করে শিবের জন্যে৷ এটা হ’ল যোগরূরার্থ৷ আবার ধর, ‘নিল’, ‘অনিল’৷ ‘নিল’ মানে স্থির, ‘নীল’ মানে নীল রঙ ত্ব্প্তব্ভন্দ্ব ন্তুপ্সপ্তপ্সব্ভব্জগ্গ্’ ‘অনিল’ মানে যা স্থির নয়, যা ছুটে চলেছে, বয়ে চলেছে৷ এটা ভাবরূরার্থ৷ যোগরূরার্থ হবে বায়ু৷ বায়ু এক মুহূর্ত্ত অচঞ্চল বা স্থির হয়ে থাকে না৷ তাই এর নাম ‘অনিল’৷ এটা হ’ল যোগরূরার্থ, ভাবরূরার্থ হ’ল যা স্থির নয়৷
তিনটে বর্ণ আছে শ, র, ঈ৷ ‘শ’ ধ্বনিটি হ’ল রজোগুণের বীজমন্ত্র, ‘র’ ধ্বনি ‘এনার্জি’ বা শক্তির বীজমন্ত্র, আর ‘ঈ’ হ’ল স্ত্রীলিঙ্গবাচক–/স্ত্রিয়াম্ ঙীষ্*৷ তাই যার মধ্যে রজোগুণ আছে, যার মধ্যে শক্তি বা কর্মচঞ্চলতার অভিব্যক্তি আছে, যা স্ত্রীবাচক তাই ‘শ্রী’৷ বিশ্বের সবাই রজোগুণী কর্মদ্যোতনায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবন কাটাতে চায়৷ তাই প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দ ব্যবহারের প্রথা প্রচলিত আছে৷ ‘শ্রীনাথ’ মানে শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীর পতি অর্থাৎ নারায়ণ, জানকীনাথ মানে জানকী অর্থাৎ সীতার পতি রামচন্দ্র৷ ‘সীতা’ শব্দ আসছে ‘সী’ ধাতু থেকে৷ ‘সী’ মানে চর্চা করা, ট্রা*র বা হলাকর্ষণ দ্বারা জমিকে উর্বর করে তোলা৷ ‘সী’ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন ‘সীতা’ মানে উত্তমরূপে চর্চিত ভ্রন্দ্বপ্তপ্ত–ন্তুব্ভ ভূমি অর্থাৎ যতদূর সম্ভব উর্বর করে তোলা৷ এখন এই যে চর্চার দ্বারা উৎকর্ষসাধন এটা আসছে কোত্থেকে? কার কাছ থেকে এই চর্চার সমর্থন বা প্রেরণা আসছে? –না, পরমপুরুষের কাছ থেকে৷ যাই হোক, এই শ্রীনাথ বা জানকীনাথ মানে হ’ল পরমপুরুষ৷ তাহলে শ্রীনাথ ও জানকীনাথের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই৷ হনুমান সেটা জানেন৷ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীনাথ ও জানকীনাথে কোন প্রকার মৌলিক পার্থক্য নেই৷
/তথাপি মম সর্বস্বঃ রামঃ কমললোচনঃ*৷ তাই মনের সমস্ত বৃত্তিকে সেই এক ও অদ্বিতীয় সত্তার দিকে চালিয়ে দিতে হবে, কেবল নিজের ইষ্টমন্ত্রের দিকে মন রেখে৷ অন্য কোন দ্বিতীয় মন্ত্রের দিকে নয়৷ তাই হনুমান বলছেন, ‘এই জন্যে আমি সব সময় কেবল রামের নামই নিই–নারায়ণের নয়৷ এমনকি নারায়ণকে আমি জানিও না৷
তাই প্রতিটি সাধকের নিজের নিজের ইষ্টমন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত৷ জগতে কেবল একটি মন্ত্রই আছে, আর তা হ’ল তার নিজের ইষ্টমন্ত্র....এছাড়া আর কোন মন্ত্র নেই৷
(পটনা, ২৫শে সেপ্ঢেম্বর ১৯৭৮)