বর্তমান যুগ ও মানবিক মূল্য
বর্তমান যুগে জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয় অর্থ দিয়ে৷ ‘‘যস্যাস্তি বিত্তম্ সঃ নরঃ কুলিনঃ সঃ পন্ডিতঃস শ্রুতবান্ গুণজ্ঞঃ স এব বত্তা স চ দর্শনীয়ঃ৷ সর্বে গুণাঃ কাঞ্চনমাশ্রয়ন্তি৷৷’’
যার কাছে বিত্ত রয়েছে তারইসমস্ত গুণ৷ তারই সমস্ত সম্মান৷ কাঞ্চন -কৌলীন্য লাভ না করে আজকের যুগে সম্মান আশা করা যায় না৷ বাকী সমস্ত শ্রেণীর বিত্তহীন মানুষকে জীবিকা সংগ্রহের জন্যে বিত্তবানদের স্তাবকতা করতে হয় মানবিক মূল্য এখানে এক কাণাকড়িও নেই ৷ মানুষ এখন শুধু অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার ছাড়া কিছু নয়৷ বিত্তবানেরা রজতচক্রের জোরে কিনে রেখে দিয়েছে সকলের মাথাকে৷ নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ-পুর্তির জন্যে এরা নিজেদের সমস্ত মানবীয় মূল্যকে তো বিসর্জন দিয়েছেই,সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অপর সকলের জীবন নিয়ে শকুনির মতো এরা পাশা খেলা শুরু করেছে ৷ একে একে সবকিছু হারিয়ে দু’মুঠো অন্ন জোটানের জন্যে সাই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে ৷ আজকের মানুষের জীবন বেদ হয়ে দাঁড়িয়েছে---‘‘ঘোলা জলে নেমে পানা ঠেলে নিতি ওঁ গঙ্গেতি প্রাতঃস্নান বিগত-স্পৃহ পাকস্থলিতে যেন তেন দু’টো অন্নদান৷’’ আর যারা সমাজের উচচস্তরে বসে রয়েছে তারা লাভ ক্ষতি টানাটানি অতি সূক্ষ্ম ভগ্ণ-অংশভাগ,কলহ-সংশয়ে ব্যস্ত,মানুষের দিকে তাকানোর স্পৃহা তাদের নেই, বরং এই স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তারা মানুষের হাড় চিবেবায়৷ রক্ত শুষে পান করে৷ এতে অপরের প্রতি সহানুভূতি, দয়া-মমতার কোন সুযোগ নেই, সবাই নিজের তল্পি ধতে ব্যস্ত৷ বাইরে বেরুলে ষ্টেশনে বাজারে শত শত ভিখারীর মেলা, রাস্তার ধারে সারি বেঁধে আছে কুষ্ঠরোগীর দল অর্ধনগ্ণ অবস্থায় তার ভিক্ষাপাত্র জীবিকা সংগ্রহের একমাত্র উপকরণ নিয়ে৷ কেউ তাচিছল্য ভরে একটা পয়সা ছুঁড়ে দিলে তার ভাগ্য৷ অন্ধবৃদ্ধ সারা দিন বসে থাকে পুলের কোণে, পায়ের শব্দ পেলেই কাতর স্বরে ভিক্ষাপাত্র তুলে ধরে৷ কিন্তু তাদের সেই ক্রন্দন, কারুরই কর্ণে প্রবেশ করে না৷ অথচ আরেক দিকে বিলাসবহুল গৃহের কোণে সমাজের গণ্যমান্য ব্যষ্টিদের আপ্যায়িত করার জন্যে খাদ্যের প্রাচুর্য মানুষের সভ্যতাকে উপহাস করছে৷
আজকের মানুষ শ্রদ্ধা করে তাঁদেরও---যাঁরা সমাজের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন৷Rank বা পদকেই মানুষ মাহাত্ম্য দেয়৷ রেলমন্ত্রী এলে তার জন্যে ষ্টেশন মাষ্টার কত না ব্যবস্থা করেন কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের অসুবিধাগুলোর দিকে একদিনও চোখ মেলে ডাক্তার আবশ্যকতা অনুভব করেন না৷ প্রথম শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্যে বাংলোর পর বাংলো তৈরী হয়৷ কিন্তু বস্তী এলাকা-র বাসিন্দাদের মাথা গোঁজবার ঠাঁই পর্যন্ত নেই৷ একথা বল না যে বড়বড় ইমারতের প্রয়োজন নেই কিন্তুমানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্বই সর্বপ্রথম৷ ‘‘মানুষের জন্যে অন্নের দরকার৷ থালাও দরকার একথা মানি৷ কিন্তু গরীবের ভাগ্যে অন্ন যেখানে যথেষ্ট মিলিতেছে না সেখানে থালা সম্বেন্ধে একটু কষাকষি করা দরকার৷ যখন দেখিব ভারত জুড়িয়া অন্নসত্র খোলা হইয়াছে তখন অন্নপূর্ণার কাছে সোণার থালা দাবী করিবার দিন আসিবে৷’’
আজকের তথাকথিত শিক্ষিত জনেরা শিক্ষার অভিমান নিয়ে অশিক্ষিত মানুষকে ঘৃণা করেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁরা মিশতে পারেন না তাই তারা গ্রামীণ সমাজকে পরিত্যাগ করে’ শহরের বাসিন্দা হতে চান ৷ গ্রামে যাবার প্রশ্ণ উঠলে তাঁরা বলেন, ‘গিয়ে কী করব বলুন, কথা বলার মত একটাও লোক পাই না , সেখানে সমস্ত মূর্খের দল৷’ তাই শুধু শহরের উন্নতির পরিকল্পনা হয় আর গ্রাম থেকে যায় আগের মতই অবহেলিত ৷ রাজনৈতিক নেতারা বোট ভিক্ষার জন্যে সময় পড়লে গ্রামে মাঝে মাঝে আসেন বড় বড় প্রতিশ্রুতির পশরা নিয়ে ৷ তাঁরা সেই সমস্ত নিরীহ গ্রামবাসীদের কাছে শোণান বড় বড় বাঁধ তৈরীর কথা অথচ সেই গ্রামে হয়ত সেচের অভাবে চাষ হয়না৷ তাদের পুল তৈরীর,ইমারত তৈরীর অথবা টেলিভিশন সেট বসাবার পরিকল্পনার চমকপ্রদ বিবরণ দেন কিন্তু সেই গ্রামেই হয়তো ওষধের অভাবে রোগীর মৃত্যু হচেছ৷ খাদ্যের অভাবে মানুষ ভিখারী হচেছ ---এইরূপ মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনের অপূর্তি তার মনুষ্যত্বকে পদে পদে উপহাস করছে৷ অথচ এই গ্রামের মানুষেরাই সমাজের মেরুদন্ড৷ গ্রাম কেন, শহরেই বা সবাই সমান সুযোগ পায় কোথায়? শহরের ড় ড় রাস্তার ফুটপাথগুলো হু মানুষের বাসস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ---‘‘চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে ,তাদের সংখ্যাই শীে, তারাই বাহন৷ তাদের মানুষ হার সময় নেই ৷ দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত৷ সবচেয়ে কম খেয়ে পরে,কম শিখে বাকী সকলের চেয়ে বেশী তাদের পরিশ্রম,সকলের চেয়ে বেশী তাদের অসম্মান, কথায় কথায় তারা উপোস করে মরে, ওপর ওলাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে৷ জীবন যাত্রার জন্যে সবকিছু সুবিধা ,সব থেকে তারা বঞ্চিত৷ তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে৷ ওপরে সবাই আলো পায়,তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে.
এইভাবে মানুষের অবমাননা, মানবিক মূল্যের অবহেলা আজকের এক সামাজিক ব্যাধিতে,পরিণত হয়েছে৷’’মানবিক মূল্যের অবমাননার আর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হ’ল, আজকের বিচার ব্যবস্থা অপরাধী হোক বা না হোক, কেউ ধরা পড়লে তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে ও তার বিচার হবে সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ও উকিলের বাক্চাতুর্যে৷ যার অর্থ আছে সে নামকরা উকিলের সাহায্য নিয়ে আইনের মারপ্যাঁচে প্রকৃত অপরাধী হয়েও নির্দেশ প্রমাণিত হয় আর যার অর্থ নেই সে নির্দেশ হয়েও ড় উকিল রাখতে পারেনি লে জেল খাটে৷ চোর ছাড়া পেয়ে গেলে অপরাধ নিশ্চয়ই কিন্তু নির্দেশকে শাস্তি দেওয়াও মহাপাপ, মানবত্বের কঠোর অবমাননা৷ আজ যত অপরাধ হয় তার এক বিশেষ কারণ হ’ল সৎ মানুষের অভাব৷ সৎ মানুষ ব্যাষ্টিগত জীবনে নীতিবাদকে মেনে চলতে চেষ্টা করে, কিন্তু দারিদ্রের যাতনায় একসময় সেই নীতিকে বির্সজন দিতে বাধ্য হয়৷ তারপর একসময় অপরাধের জন্যে তাকে হয়তো আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, সে যে অভাবের তাড়নায় চুরি করেছে আইনের চোখে তার কোন মূল্য নেই৷ সেই ব্যষ্টি অতঃপর যদি চৌর্যবৃত্তির অপরাধে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়---তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে দেশের আইনের কোন ব্যবস্থা নেই৷ তার ফলে সেই পরিবারের সন্তানেরা হয়তো বাঁচার তাগিদে জীবনের কালো পথ একদিন বেছে নিতে বাধ্য হবে৷ ড় হয়ে ছেলেগুলো হয়তো পকেটমার হবে, হয়তো তারাও একদিন চুরি করবে আর তাদের মা বেচারীকে হয়তো একদিন বেছে নিতে হবে নরকের পথ, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে বরণ করে নিতে হবে কলুষতায় ভরা জঘন্য পাপের জীবন৷ আর ওদের পিতা যখন জেল থেকে ছুটি পাবে তখন সমস্ত সমাজ তাকে ঘৃণা করবে, চোর বলে অপবাদ দেবে, অপমানে অভিমানে সে তখন মরীয়া হয়ে চুরিকেই বরণ করে নেবে তার জীবনের পেশা হিসেবে৷ এই ভাবে কত সৎ পরিবার ধবংস হয়ে যাচেছ দিনে দিনে৷ কেউ এদের মর্মব্যথাকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে সহানুভূতির একটু সান্তনা বাক্যও শোণাবে না৷ কারণ মানুষ তো বড় নয় --- আজ সমাজে বড় হচ্ছে তারা যারা কলোবাজারী করে ধরা পড়লে টাকার জোরে বেকসুর খালাস হয়ে যায়৷ কারণ ‘‘যে যত ভন্ড ধড়িবাজ, আজ সেই তত বলবান৷’’