এবার বলতে হয় পার্বতীর কথা৷ ‘পার্বতী’ শব্দটার মানে কী কেউ হয়তো বলবেন ‘পর্বতস্য দুহিতা’, ‘পর্বতস্য কন্যা’ ইত্যর্থে পার্বতী (ষষ্ঠী তৎপুরুষ) অর্থাৎ পাহাড়ের মেয়ে৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, পঞ্চভূতাত্মক শরীরে কোন নারী কি পাহাড়ের মেয়ে হতে পারে কোন নদীকে বরং পাহাড়ের মেয়ে বললেও বলতে পারি৷ কোন নারীকে পাহাড়ের মেয়ে বলতে পারি কি সে তো বলতে পারি না৷ সুতরাং ‘পর্বতস্য কন্যা ইত্যর্থে পার্বতী’ নন, ‘পর্বতদেশীয়া কন্যা ইত্যর্থে পার্বতী’ (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়) অর্থাৎ পাহাড়ী দেশের মেয়ে, পাহাড়ী মেয়ে ইত্যর্থে পার্বতী–পাহাড়ে যে মেয়ের বাস৷ তা’ এখন অনেকেই বলেন, পার্বতী হিমালয়ের মেয়ে৷ হিমালয়ের মেয়ে, মানে পিতা হিমালয় সে অর্থে নয়, হিমালয়বাসিনী মেয়ে৷
এই যে পার্বতী ইনি ছিলেন গৌরী অর্থাৎ গৌরবর্ণা অর্থাৎ আর্যকন্যা৷ সে কালের ভারতে প্রাচীন অধিবাসী (অষ্ট্রিকো–মঙ্গলো–নিগ্র্) আর বহিরাগত আর্যদের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভাল ছিল না৷ আর্যরা ভারতের এই মূল বাসিন্দাদের কখনো অসুর, কখনো দানব, কখনো দাস, কখনো শূদ্র বলে সম্বোধন করতেন৷
আর্যরা এঁদের নিজেদের সমাজে নেননি, নিজেদের সমাজে অপাঙ্ক্তেয় বলে গণ্য করতেন৷ কিন্তু এই যে অষ্ট্রিকো–মঙ্গলো–নিগ্র্ রক্তসঞ্জাত ভারতের প্রাচীন মানুষ তাদেরও সভ্যতা ছিল, সংস্কৃতি ছিল তারা উন্নত জীব ছিল, তাদেরও তন্ত্র ছিল, তাদেরও চিকিৎসা–বিজ্ঞান ছিল৷ আর বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে তাদের চলেছিল দীর্ঘকালব্যাপী সংঘর্ষ৷ এই আর্যের কন্যা, হিমালয়বাসী আর্যরাজা দক্ষের কন্যা ছিলেন গৌরী৷
গৌরীর সঙ্গে শিবের বিবাহে অনেকে ভেবেছিল যে আর্য আর আর্যেতর ভারতবাসীর মধ্যে একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠবে৷ বিবাহের পূর্বে গৌরী শিবের জন্যে যখন আরাধনা করেছিলেন তখন তিনি অরণ্যচারিণী শবরকন্যার (অনার্য) মতই পোষাক পরতেন, কাঠি দিয়ে হলুদ পাতা গেঁথে গেঁথে তাকেই বস্ত্ররূপে ব্যবহার করতেন৷ পর্ণের সংস্কৃত ভাষায় যে ক’টি অর্থ আছে তার একটি হ’ল হলুদ পাতা৷ তাই সে সময়ে লোকে গৌরীর নামকরণ করেছিল ‘পর্ণশবরী’৷
পরবর্ত্তীকালে আরাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্তির পরে লোকে গৌরীকে অনুরোধ করেছিল, ‘‘এবার আপনি পর্ণবস্ত্র ত্যাগ করে শাটীবস্ত্র (শাড়ী) পরলেন তখন লোকে তাঁর নাম দিলে ‘অপর্ণা’৷ দুঃখের বিষয় , শিব–গৌরীর বিবাহের পরেও আর্য–নার্যের সম্পর্ক নিকটতর হতে পারে নি৷ সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল আর আর্যরা ও গৌরীর পিতা দক্ষ ক্রমাগত শিবের নিন্দা করে চলেছিলেন ও শেষ পর্যন্ত শিবকে অপমান করবার জন্যে শিববর্জিত একটি যজ্ঞ অর্থাৎ শিবকে নিমন্ত্রণ না–করা একটি যজ্ঞ করেছিলেন৷ আর সেই যজ্ঞস্থলে শিবের নিন্দা সহ্য করতে না পেরে পার্বতী আত্মদাহ করেছিলেন, আত্মত্যাগ করেছিলেন৷
‘ক্ষান্ত হও গো পিতা শিবনিন্দা আর সহে না,
কুবের যার ভাণ্ডারী ব্রহ্মা–বিষ্ণু দ্বারের দ্বারী৷
আমিও তাঁর আজ্ঞাকারী জেনেও কি তা জান না৷’’
‘‘যাঁর আস্তিত্বিক ঐশ্বর্যের দ্যুতি কুবেরের ভাণ্ডারের মণিমাণিক্যের জেল্লাকেও হার মানিয়ে দেয়, যাঁর অপূর্ব সর্জনশক্তি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেও হার মানিয়ে দেয়, যাঁর অলোকসামান্য বাৎসল্য স্বয়ং সংরক্ষণকর্ত্তাকেও হার মানিয়ে দেয়, যাঁর বাৎসল্যের স্নেহচ্ছায়ায় শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তু উদ্ভিদেরাও নির্ভয়ে বসবাস করে আমি সেই সদাশিবেরই অনুগামিনী–একথা কি তুমি জান না তুমি নিশ্চয়ই জান৷ আমি আর শিবনিন্দা সহ্য করতে পারছি না৷ তুমি ক্ষান্ত হও....হে পিতঃ (দক্ষ), তুমি ক্ষান্ত হও৷’’
সেই আত্মত্যাগের পর ভারতে আর্য ও আর্যেতর মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভাল হয়ে গড়ে উঠেছিল৷ এখন লোকে যে পৌরাণিক দেবীকে দুর্গা বলে মনে করে সেই পৌরাণিক দেবীর সঙ্গে গৌরী বা পার্বতীর কোন সম্পর্ক নেই৷
(‘‘শিবের প্রভাব’’, ‘নমঃ শিবায় শান্তায়’)
‘গিরিভূঃ’ শব্দটি যদি স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহূত হয় (বানানের সঙ্গে একটি বিসর্গ অবশ্যই যোগ করবে), সেক্ষেত্রে ‘গিরিভূঃ’ বলতে বোঝায় পর্বততনয়া পার্বতীকে৷ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দক্ষ–প্রসূতির কন্যা সতী দক্ষযজ্ঞে আত্মাহুতি দেবার পর হিমালয় মেনকার কন্যা পার্বতী বা গৌরী রূপে জন্মগ্রহণ করেন ও কঠোর তপস্যার পরিণামস্বরূপ তিনি শিবকে পুনর্বার পতিরূপে লাভ করেন৷ এবার তিনি পর্বতাত্মজা...তাই ‘গিরিভূঃ’৷
কথিত আছে আর্যদের সমাজে নারীর কিছুটা সম্মান থাকলেও পূর্ণ সম্মান ছিল না৷ কিন্তু সেকালকার অনার্য–ভারতীয় সমাজে (দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক গোষ্ঠীয়) নারীর স্থান ছিল পুরুষের সমান...পাশাপাশি৷ শিব চেয়েছিলেন সমগ্র ভারতে আর্য–নার্য নির্বিশেষে নারীর যা’ প্রাপ্য তা’ নারীকে দেওয়া হোক্৷ উন্নাসিক আর্যদের অনেকেই তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন, কিছুসংখ্যক মানুষ অবশ্য তাঁকে সমর্থনও করেছিলেন৷ পার্বতী ছিলেন নারীর অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অগ্রগণ্যা৷ সে যুগে সংস্কৃতে স্ত্রীবাচক শব্দের প্রথমার একবচনে সম্নানজনক বিসর্গ (অঃ/অ(হ)/অ(র)/অ(স্)ঃ বিসর্গ বলতে এই প্রতিটি রূপকেই বোঝায়) ব্যবহার করা হ’ত না৷ পার্বতী কিন্তু নিজের পরিচয় দেবার সময় নিজের নামের সঙ্গে বিসর্গ যুক্ত করে উচ্চারণ করতেন নিজের সম্মানবোধকে প্রকট করবার জন্যে৷ সেই থেকে নাকি ‘গিরিভূঃ’ বানানটিতে বিসর্গ উচ্চারণ স্বীকৃত হয়েছে৷ কথাটা সত্য হোক বা না হোক, ‘গিরিভূঃ’ বানানে যদি বিসর্গ রাখি তাতে আপত্তির কোন কারণ থাকতে পারে না৷
(‘‘গিরিভূঃ’’, ‘শব্দ–চয়নিকা’, ১৩শ পর্ব)
‘‘আত্মজ্ঞানমিদং দেবি পরং মোক্ষৈকসাধনম্ঙ্গ
সুকৃতৈর্মানবো ভূত্বা জ্ঞানীচেন্মোক্ষমাপ্ণুয়া’’
প্রাচীনকালে মানুষের পরিপ্রশ্ণের প্রতিভূ ছিলেন পার্বতীঙ্গ মানব মনের যা কিছু চিরন্তন জিজ্ঞাসা, তা মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে পার্বতী সদাশিবকে জিজ্ঞাসা করতেনঙ্গ সদাশিবের উত্তরগুলো তো ছিল সর্বকালের নয়নাভিরাম রত্নঙ্গ কিন্তু পার্বতীর প্রশ্ণগুলো এতই সুন্দর যে প্রশ্ণ শুণে যে কোন বিদগ্ধ মানব ভাববেন, সত্যিই তো, এটা আমারও মনের প্রশ্ণঙ্গ তাই পার্বতীর প্রশ্ণগুলোও সযত্নে সাজিয়ে রাখবার মত জিনিসঙ্গ পার্বতীর এই মূল্যবান প্রশ্ণগুলোর মিলিত নাম নিগম শাস্ত্রঙ্গ এই নিগম শাস্ত্র একটি উন্নত মানের পরিপ্রশ্ণের সমাহারঙ্গ শিবের উত্তরগুলো যদিও দার্শনিক দ্যুতিতে দীপ্তিমান, তবু তার বৈবহারিক মূল্য দার্শনিক মূল্যকেও ছাপিয়ে উঠেছেঙ্গ আরও ভাল করে ৰললে ৰলতে হয়, শিবের দার্শনিক ব্যাখ্যা বৈবহারিক মূল্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
পার্বতীর প্রশ্ণ নিগম আর শিবের উত্তর আগম–এই দুইকে তন্ত্রে হংসের দু’টি পক্ষ ৰলে বর্ণনা করা হয়েছেঙ্গ যেমন, এক পক্ষযুক্ত পাখী উড়তে পারে না তন্ত্রও তেমনি আগম–নিগম দুইকে নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণঙ্গ একটিকে বাদ দিলে তন্ত্রের মূল সত্তা আহত তথা ব্যাহত হয়ে পড়ে।
(‘‘শিবোপদেশ’’–৯ ‘নমঃ শিবায় শান্তায়’)