শিরোনামে লিখিত বিষয়ের ওপর প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর বিভিন্ন পুস্তকে যা বলেছেন, সেগুলিকে সংকলিত করে’ তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট প্রাউটিষ্ট আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত৷
বুদ্ধির অপব্যবহার করে’ শোষণ নানা যুগে নানা ভাবে হয়েছে৷ বর্তমান যুগে কীভাবে হচ্ছে তার কয়েকটা চিত্র এঁকেছেন দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷
বিশ্বের সর্বত্রই একটা জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক শোষণ করছে৷ অর্থনৈতিক ভিত্তিতে শোষণ করতে গেলে দু’প্রকারে করা যায়৷ একটা হ’ল–মানস–র্থনৈতিক শোষণ আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে–পলিটিকো–ইকনমিক্ শোষণ৷ যেখানে পলিটিকো–ইকনমিক শোষণ চলছে, সেখানে তার সঙ্গে যদি মানস–র্থনৈতিক যুক্ত হয় তো সোণায় সোহাগা৷
যেখানে শক্তির বলে, জড়শক্তির বলে হয় তা পলিটিকো–ইকনমিক শোষণ৷ কিন্তু যেখানে জড়শক্তির বলে হচ্ছে না, বুদ্ধির বলে, চালাকির দ্বারা হচ্ছে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানস–র্থনৈতিক শোষণ৷
যেখানে অর্থনৈতিক শোষণ রয়েছে, তার পশ্চাৎপটে অবশ্যই রয়েছে মানসিক শোষণ৷ তারও পশ্চাৎ ভূমিতে রয়েছে মনের মধ্যে হীনম্মন্যতা নুন্দ্রন্দ্বব্জন্প্সব্জ ন্তুপ্সপ্পহ্মপ্তন্দ্বপ্ তৈরী করবার এক নিরলস ও শঠতা পূর্ণ প্রয়াস৷
শোষক যাকে শোষণ করতে চায় তার মনে ফিয়ার–কমপ্লেক্সের সূচিকা প্রয়োগ নুন্দন্দ্বন্তুব্ধগ্গ করে’ দেয়৷ তার মনে এই ভাবটা জাগিয়ে দেয়–‘তুই ছোট, আমি বড়’৷ এই ফিয়ার–কমপ্লেক্স ইনজেক্ট করার ফলেই তথাকথিত ছোট জাতেরা নিজেদের সত্যিই ছোট মনে করে, স্বভাবগত ভাবেই করে–কারণ যুগ যুগ ধরে’ ভীতম্মন্যতায় ভুগে ভুগে ওদের মানসিকতাই ওই রকম হয়ে গেছে৷ আর যারা অন্যের মনে ফিয়ার–কমপ্লেক্স ইন্জেক্ট করে তারা পরোক্ষভাবে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইনজেক্ট করে অন্যদের ওপর, আর নিজেদের মনে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইনজেক্ট করে৷ এই করে’ গ্যাপটা দেয় বাড়িয়ে৷ সমাজের কাঠামোটা যায় ভেঙ্গে৷ এই সূচিকা প্রয়োগ নুন্দন্দ্বন্তুব্ধগ্গ করার ফলে মানসিক শোষণ ওইখানেই হয়ে গেল, ও তাকে ভিত্তি করে’ অন্যান্য স্তরে শোষণের সুবিধা হয়ে গেল৷
এই হীনম্মন্যতা তৈরীর একটা উদাহরণ–অনেক জায়গায় সাইনবোর্ড–এ বড় করে লেখা থাকে এমন একটা ভাষায় যে ভাষা স্থানীয় ভাষাই নয়৷ সাইন বোর্ড থাকে স্থানীয় জনসাধারণকে বোঝাবার জন্যে যে কোন্ জিনিসটা কী৷ এই লেখাটা যদি শাসক–শোষকের ভাষায় থাকে, আর শাসিত–শোষিতের ভাষায় না থাকে, অথবা থাকলেও শাসকের ভাষার চরণতলে কৃপাধন্য হিসেবে থাকে তাহলে শাসিত–শোষিতের মনে নিজের ভাষা ও আত্মপরিচিতি সম্বন্ধে ইন্ফিরিওরিটি কমপ্লেক্স জাগবে৷ যেই ইনফিরিওরিটি কম্প্লেক্স্ এলো, তখন তার ওপর মানসিক শোষণ চলতে থাকলো, ও তাকে ভিত্তি করে’ অন্যান্য স্তরে শোষণের সুবিধা হয়ে গেল৷
ইংরেজীতে কথা বলতে না পারলে মূর্খ মনে করা হয়৷ ইংরেজীতে যখন বলতে পারছে না তখন ও মূর্খ৷ অথচ সে মানুষটা হয়তো সংসৃক্তে বিরাট পণ্ডিত৷ এটাও এই ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইনজেক্ট করার পরিণতি৷ এই ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইনজেক্ট করে’ দেওয়ার মানেই হ’ল তার ওপর মানসিক শোষণ চালানো৷
মানসিক শোষণ দ্বিভৌমিক৷ কখনো কেবল মানসিক স্তরেই হয়, আবার কখনও আধা–মানসিক, আধা অন্যান্য ভূমিতেও অর্থাৎ মানসিক শোষণের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ভূমিতে শোষণ চলে–অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংসৃক্তিক, রেলিজন–সবেতেই৷
মানস–রাজনৈতিক শোষণে (psycho-political) অথবা রাজনৈতিক স্তরের শোষণে, একটা জনগোষ্ঠী আরেকটা জনগোষ্ঠীর ওপর সবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে৷ তাদের পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে যে ওই শোষিত জনগোষ্ঠী বা শোষিত দেশ (এখানে দেশের চেয়েও জনগোষ্ঠী বড়কথা)–ওই ভূমিটাকে আমি কাঁচামালের যোগানদার হিসেবে নোব কাঁচামাল তৈরী হবে আমার এক্তিয়ারের মধ্যে, আর শোষিত ভূমিটাকে আমার তৈরী মালের বাজার হিসাবে পাবো৷ যে সমস্ত জনগোষ্ঠী আর্থিক দিক থেকে অনুন্নত, তারা শক্তিশালী জনগোষ্ঠী অথবা শক্তিশালী দেশের কাছে মাথা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়–হয় শক্তির অভাবের জন্যে, ভীতম্মন্যতার ফলে, অথবা আর্থিক অনটনের ফলে৷ আর দ্বিতীয় স্তরে তারা তাদের ভূমিকে বা জনগোষ্ঠীকে কাঁচামালের যোগানদার হিসেবে, ও মাল কেনবার বাজার হিসেবে দেখতে পায়৷ অর্থাৎ তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়৷
মানস–র্থনৈতিক ও মানসিক স্তরেও পঙ্গু করার আর একটা পথ হচ্ছে সাংসৃক্তিক শোষণ৷ যে জনগোষ্ঠী অন্যকে শোষণ করতে চায় সে অন্যের স্থানিক অভিব্যক্তিগুলোকে নষ্ট করে’ দিতে চায়৷ জোর করে’ একের ওপরে অন্যের ভাষা চাপায়, জোর করে’ একের ওপরে অন্যের পোষাক চাপায়, অন্যের চিন্তাধারা চাপায়৷ এইভাবে মানসিক দিক দিয়ে তাদের পঙ্গু করে’ দিয়ে শোষণের আরো সুবিধা করে’ নেয়৷ সংসৃক্তিক জীবনে এইভাবে চলে শোষণ৷
মানুষের মন নীচের দিকে যত সহজে যায়, ওপরের দিকে তত তাড়াতাড়ি ওঠে না৷ সুতরাং খারাপ সিনেমা, খারাপ নাটক–অর্থবলে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে তাদের চারিত্রিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়, মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়৷ আর এই মানসিক পঙ্গু মানুষগুলো শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে যূথবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে পারে না৷
পলিটিকো–ইকনমিক শোষণের বলি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এককালে ছিল, এখনও অনেক দেশ রয়েছে শুধু দেশ কেন, জনগোষ্ঠীও৷ অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে (সে পলিটিকো–ইকনমিক হোক আর মানস–র্থনৈতিক হোক) মানুষকে বাঁচাতে গেলে তাদের মধ্যে সচেতনতা (consciousness) আনতে হবে৷ সচেতনতা না আনলে তারা মানস–র্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতে পারবেই না, পলিটিকো–ইকোনমিক শোষণের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারবে না৷
কিন্তু মুখে শোষণের বিরুদ্ধে কথা বললেও যারা কাজের দ্বারা শোষণকে সমর্থন করে–‘বাক সর্বস্ব বিপ্লবী’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে’ দিয়ে শ্রী সরকার বলেছেন, যারা শোষণ করছে, প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে, তারা শোষিতদের কেবল যে শোষণই করে তা নয়–শাসনও করে৷ কারণ শাসন কাজ অব্যাহত থাকলে শোষণ ভালোভাবে চলে৷ আর যারা পরোক্ষভাবে করে, তারা নিজেরা শাসন করে না–শাসকদের অর্থ বলে ক্রয় করে’ নেয়৷ আর এই অর্থবলে ক্রয় করার পরিণামটা হয়–শাসককুল যাদের অর্থে ক্রীত হচ্ছে তাদেরই মনোরঞ্জন করে, তাদের টাকায় নির্বাচনে জয়ী হয়, আর মুখে তারা আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তলে তলে এই জিনিসটাকে সমর্থন করে৷ এরা বাকসর্বস্ব বিপ্লবী প্সন্তুত্রপ্ত ব্জন্দ্ব্লপ্সপ্তব্ভব্ধ৷ এরা শোষণের বিরুদ্ধে মুখে বড় বড় কথা বলবে, আর কার্যক্ষেত্রে তলে তলে সেইটাই করে’ যাবে৷ এর চেয়ে কিছুটা ভাল হ’ল রিফর্মিষ্ট–যারা বলে ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে করা যাক৷ কিন্তু তাদের মতলব থাকে যাতে শোষণের রথ অব্যাহত থাকে৷ রিফর্মিষ্টরা কার্যক্ষেত্রে সমাজের কল্যাণ চায় না–তারা একটু উনিশ–বিশ করে প্রতিষ্ঠা বজায় রাখতে চায়৷ সমাজের কল্যাণ নয়, বরং সমাজের ত্রুটিগুলোকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়৷ তাদের পাকে–প্রকারে জিইয়ে রাখতে চায়৷
এই জন্যেই তিনি বারবার মানুষের মধ্যে চেতনা আনার কথা বলেছেন৷ মানুষের মধ্যে চেতনা এনে দাও, জ্ঞানাঞ্জন–শলাকায় তাদের চোখ খুলে দাও৷ তারা বুঝতে শিখুক, কেন, কোথায় কী হচ্ছে৷
সাংসৃক্তিক জীবনে শোষণ যেটা করা হয় অসংসৃক্তির মাধ্যমে, সেই অসংসৃক্তির বিরুদ্ধে প্রতিটি সৎ, প্রতিটি ধার্মিক, প্রতিটি বিচারশীল মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ সেই সঙ্গে অন্যকেও একাজে প্রেরণা জোগাতে হবে৷ তা না হ’লে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ মানুষ রাজনৈতিক শক্তির জন্যে লড়াই করে’ গেল, সামাজিক মুক্তির জন্যে লড়াই করে’ গেল, অথচ যদি সাংসৃক্তিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়, তাহলে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে৷ তা হবে ভস্মে ঘৃতাহুতির সামিল৷ যদি কারো মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে, সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না৷ অসংসৃক্তির বোঝায় যার ঘাড়–পিঠ ভেঙ্গে দুমড়ে গেছে, সে কি মাথা উঁচু করে’ জীবনে অন্য কোনো ভূমিতে সংগ্রাম করতে পারবে? কিছুতেই পারবে না৷ তাই অসংসৃক্তির হাত থেকে নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা প্রতিটি বিচারশীল মানুষের অবশ্য কর্ত্তব্য৷
সেই কর্ত্তব্য অনুযায়ী সমস্ত ধরণের শোষণের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে৷