আগম ও নিগম

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

এটা সর্ববাদী সম্মত সত্য যে তন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন সদাশিব৷ সাধকদের সুবিধার জন্যে সদাশিব ও পাবর্তী কী করেছিলেন পার্বতী প্রশ্ণ করতেন, সাধারণ মানুষের মনে যে সমস্ত প্রশ্ণ উঠতে পারে ওই সমস্ত প্রশ্ণ করতেন৷ আর সদাশিব প্রশ্ণের উত্তর দিতেন৷ পার্বতীর প্রশ্ণ ছিল জ্ঞানাত্মক তথা পরিপ্রশ্ণাত্মক ৷ একে বলা হয় নিগম আর শিবের উত্তরকে বলা হয় আগম৷

‘‘আগতং শিববক্তেভ্যো গতং চ গিরিজা শ্রুতৌ৷

মতং চ বাসুদেবস্য তস্মাৎ আগম উচ্যতে৷৷’’

অর্থাৎ শিবের মুখ থেকে নির্গত হয়ে পার্বতীর কর্ণে প্রবেশ করছে অর্থাৎ পার্বতী শুণছেন৷ আর এই মত পরমপুরুষের, বাসুদেবের৷ এই কারণে একে বলা হয় আগম৷ আগতম এর প্রথম অক্ষর ‘আ’, ‘গতম’–এর প্রথম অক্ষর ‘গ’ ও মতম’ এর প্রথম অক্ষর ‘ম’৷ এই নিয়ে ‘আগম’ শব্দ তৈরী হয়েছে৷ সাধকদের সুবিধার জন্যেই এই প্রশ্ণোত্তর৷

পার্বতীর একটা প্রশ্ণ ছিল, এই যে তিন কাল–অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ–এই তিন কালের মধ্যে মানুষের জন্যে, সাধকের জন্যে সব থেকে মূল্যবান কাল কোনটা৷ অতীত মানে যা হয়ে গেছে৷ ভবিষ্যৎ মানে যা হবে৷ এর মাঝে যে চলমান স্তর, একটা গতিশীল স্তর রয়েছে–সেটা কী –না, আমরা যতটুকু সময় অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্বন্ধ স্থাপন করি করতে পারি–এই সম্বন্ধকরণের অবস্থাটুকুকেই সময় টিকেই বলা হয় বর্তমান৷ আমি বলছি, তোমরা শুণছ৷ যখন আমি বলছি, ঠিক তখনি তোমরা শুণছ না৷ একটু সময় পরে তোমরা শুণছ৷ তোমার কাছ পর্যন্ত বাতাস পৌঁছতে যতটা সময় লাগে, অতটা সময় পরে তোমরা শুণছ৷ আর যখন তোমরা শুণছ, ঠিক ওই মুহূর্তে আমি বলছি না৷ আমি যে বলছি, তা তোমাদের জন্যে ভবিষ্যৎ৷ আর তোমরা যখন শুণছ, সেটা আমার জন্যে অতীত৷

কিন্তু অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে আমরা এই যে লোক দেখানো সম্বন্ধ স্থাপন করে নিচ্ছি অর্থাৎ আমি ভাবছি যে আমি বলছি আর তোমরা সঙ্গে সঙ্গে শুণে নিচ্ছ, আর তোমরা ভাবছ যে বাবা বলছেন আর তোমরা সঙ্গে সঙ্গেই শুণছ–একেই বলে বর্তমান৷ এই যে বর্তমান কাল–এর মূল্য সবচেয়ে বেশী৷ তাই এই প্রশ্ণ করা হয়েছি যে কোন্ কাল মানুষের জন্যে সবচেয়ে মূল্যবান৷

এই প্রশ্ণে শিবের উত্তর ছিল–

‘‘বর্ত্তমানেষু বর্ত্তেত’’– Present Tense is the most important tense –বর্তমান কাল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ৷ এর মানে এই নয় যে, ভূত আর ভবিষ্যতের কোনো মূল্য নেই৷ অতীতের মূল্য এটাই যে তুমি অতীত থেকে প্রেরণা লাভ করবে৷ অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সমস্ত বড় বড় কাজ করেছেন, আমরা তা থেকে প্রেরণা লাভ করি, তাই অতীতেরও মূল্য আছে৷ অতীতের পর ভবিষ্যৎ৷ অতীতে আমরা যে ভুল করেছি, বর্তমানেও আমরা যে ভুল করেছি, সে ভুল শোধরানোর জন্যে আমরা প্ল্যান–প্রোগ্রাম তৈরী করে’ এগিয়ে চলব৷ অগ্রগতির পথ ধরে হাঁটব৷ এই কারণে ভবিষ্যতেরও মূল্য আছে৷ একজন চারাগাছ লাগায়, ওই গাছে যখন ফল ধরবে, ওই মানুষটি হয়তো তার আগে মারা যাবে৷ তার উত্তর পুরুষ–দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম হয়তো ওই গাছের ফল ভোগ করবে৷ এসব আমরা ভবিষ্যতের জন্যে করি৷ কিন্তু শিববাক্য অনুসারে বর্তমান কালই সবচেয়ে মূল্যবান–‘বর্তমানেষু বর্তেত’৷ মানুষের মধ্যে যা কিছু ৰুদ্ধি, শক্তি বা মেধা কাজ করছে–সবই বর্তমান কালে৷ আজ একটা মানুষের মধ্যে যে শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে, ৰুদ্ধি আছে, তার সদুপযোগ যদি না করি, তাহলে কিছু দিন পরে, যখন সেই শক্তি থাকবে না, ওই ৰুদ্ধি থাকবে না, তখন সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে৷ তখন তার মনে হবে, যখন সুদিন ছিল, যখন কাজ করবার শক্তি ছিল–তখন কিছু করিনি৷ আজ অনুশোচনা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই৷ তাই শিবের উপদেশ–বর্তমানকে অবহেলা করা উচিত নয়৷

পাঞ্চভৌতিক জগতে যে সমস্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, ভাল ভাল কাজ করার যে সুযোগ তুমি পাচ্ছ, যদি তুমি তাকে কাজে না লাগালে, তাহলে ভবিষ্যতে অনুতাপ করতে হবে৷ মনে কর, একজন বিদ্বান মানুষ, সে তার জ্ঞান দিয়ে সমাজের অনেক সেবা করতে পারে৷ বৃদ্ধ হয়ে গেলে তার সে শক্তি থাকবে না, তখন সে তার জ্ঞান দিয়ে সমাজের সেবা করতে পারবে না৷ আজ যে ৰুদ্ধিজীবী, হতে পারে তার মস্তিষ্কের বিকৃতি হয়ে গেল, সে পাগল হয়ে গেল৷ তখন সে তো তার ৰুদ্ধি দিয়ে সমাজের কাজ করতে পারবে না! তাই যতদিন পর্যন্ত ৰুদ্ধি আছে, মেধা আছে, বিদ্যা আছে– তার পূর্ণ সদুপযোগ হওয়া উচিত৷ এটাই শিবের উপদেশ৷ এটাই মূল্যবান শিববাক্য৷ কেবল এটাই নয়–এর চেয়েও বড় কথা, তুমি মানুষের শরীর পেয়েছ, মানুষের মন পেয়েছে৷ জন্তু জানোয়ারদেরও শরীর আছে, মন আছে৷ কিন্তু তাদের শরীরের যে গ্রন্থিসংস্থান –ওই সব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের (Hormone) যে স্বভাব তা মানুষের মত নয়৷ তারা মানুষের থেকে অনেক কম উন্নত (less developed) মানুষের মনে অনেক ধরনের বৃত্তি রয়েছে৷ ওই সমস্ত বৃত্তিগুলিকে যদি ঠিক পথে পরিচালনা করা যায়, তাহলে কত কিছু না করা যায়৷ এই মানুষের শরীরেই মানুষ দেবতা হতে পারে৷ আজকে মানুষের যে ৰুদ্ধি আছে, সেই ৰুদ্ধিকে যদি সৎপথে–রচনাত্মক কাজে লাগানো হয়–তাহলে সমাজের কত না উপকার হবে! পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে আসবে৷