আত্মোপলব্ধি ও মানবতার সেবা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’, এটি একজন সাধকের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত৷ মানুষের কাজ করা উচিত, আর কাজ করার সময়ে মনে রাখা দরকার, সে যা কিছুই করছে তা আত্মমোক্ষের জন্যে৷

যদি কেউ ভাবে পৃথিবী চুলোয় যাক্, আর আত্মমোক্ষের জন্যে সে কেবল সাধনা করতে থাকে, তাকে কি আমরা খুবই স্বার্থপর বলব না যদি কেউ মানবতার সেবা না করে, আর মানবতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রেখে কেবল আত্মমোক্ষের জন্যে সাধনায় রত থাকে, তখন তার আধ্যাত্মিক পিপাসা থাকা সত্ত্বেও তাকে আমরা স্বার্থান্বেষী বলব৷ তাই বলা হয়েছে, ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’–এটাই জীবনের উদ্দেশ্য৷ নিজের অস্তিত্বরক্ষার জন্যে তুমি পৃথিবী থেকে অনেক সেবা নাও যা তোমার ফিরিয়ে দেওয়া দরকার, তা না হলে তোমার ঋণ বাড়তে থাকবে৷ আর তোমার মাথার ওপর যদি বিরাট একটা ঋণের বোঝা থাকে তাহলে মরার সময় কী হবে না সুদসহ ঋণ শোধ করার জন্যে তোমাকে আবার জন্ম নিতে হবে৷

তুমি পৃথিবী থেকে সেবা নিচ্ছ, তাই পৃথিবীকে কিছু না–দেওয়ার কথা তুমি ভাবতে পার না আজ তুমি যা নিচ্ছ তার চেয়ে বেশী কিছু যদি দিয়েও দাও তাহলে তুমি তার সুদ পেয়ে যাবে৷ তুমি সুদ নেবে কিনা এটা অবশ্য তোমার ব্যষ্টিগত অধিকার, কিন্তু ঋণশোধের ব্যাপারে চিন্তা করার তোমার কোন বৈয়ষ্টিক অধিকার নেই৷ শোধ তোমাকে করতেই হবে৷ মনে রেখ, তুমি জগতকে সেবা করার জন্যে এসেছ–পৃথিবীকে সেবা করার জন্যেও ও আত্মমোক্ষার্থে সাধনা করার জন্যে৷ কিন্তু যারা কেবল নিজের মুক্তির জন্যে সাধনা করে আর সমাজসেবা থেকে দূরে থাকে, তারা সাধনা থেকে কিছু লাভ করতে পার না৷ এই দু’টো জিনিস একে অন্যের ওপর চির–নির্ভরশীল৷

মানুষ হওয়ার মানে কী এক পুরাতন ধারণা অনুসারে, মানুষ এক বিচারশীল পশু৷ আমাদের দর্শনে মানুষকে পশু বলে মনে করা হয় না৷ তাদের বিচারশীল পশু বলব কেন কেবল প্রাণ থাকলেই যে পশু হবে তার কোন মানে নেই৷ ‘জান’ (প্রাণ) যার আছে তাকে ফার্সীতে ‘জানবর’ বলে৷ ফার্সীতে অনেক প্রত্যয় আছে যেমন, দার, বর, গর ইত্যাদি৷ উদাহরণস্বরূপ, যারা দর–কষাকষি (সওদা) করে তাদের বলে ‘সওদাগর’ যাদের জান বা প্রাণ আছে তাদের বলা হয় ‘জানদার’ (জীবিত সত্তা) যারা হামলা চালায় তাদের বলে ‘হামলাবর’, যাদু যে দেখায় সে যাদুগর৷ তা, ‘জান’–এর অস্তিত্ব মানুষকে ‘জানদার’ করে কিন্তু কেবল ‘জানদার’ হওয়ার গুণে সে জানোয়ার হয়ে যায় না৷ এই তথাকথিত সারকথায় ‘মানুষ বিচারশীল পশু’, এই বক্তব্য আমি সমর্থন করি না৷

আমরা বলি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ জীবনের একটা আদর্শ থাকা দরকার, আর চলা যখন আদর্শমুখী হয় তখনই তাকে আমরা মানুষ বলব৷ যার কোন আদর্শ নেই, আদর্শের প্রতি চলমানতা নেই, সে মানুষের মত দেখতে হলেও আমরা তাকে মানুষ বলতে পারি না৷ দেখতে মানুষের মত হওয়াটাই মানুষের মাপকাঠি নয়৷ বস্তুতঃ অনেক মানুষের মধ্যে আমরা পশুর চেয়েও বেশী পাশবীয় গুণ দেখতে পাই৷ পশুরা বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করে না৷ তারা (শিকার ছাড়া) নির্দোষকে আঘাত করে না৷ তাই যেখানে কোন আদর্শ নেই সেখানে মানুষ পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়৷ তাই মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷