জ্ঞানভিক্ষু
প্রাউট–প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ বিজ্ঞানের ওপরও বহু অমূল্য পুস্তক রচনা করেছেন, যা কলকাতা, ঢাকা, কল্যাণী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অধ্যাপক সহ বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানী গুণীজনের দ্বারা বহুল প্রশংসিত৷ তাঁর রচিত ‘প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞানে’ (৩ খণ্ড) তিনি বহু প্রচলিত অনেক বাংলা বানানের ভুলত্রুটি বা অর্থবিচ্যুতি দেখিয়ে সে সবের সংস্কার সাধনেও সচেষ্ট হয়েছেন৷ এ ধরনের কিছু বাংলা বানান সম্পর্কে তাঁর অভিমত তাঁর ভাষাতেই প্রকাশ করা হচ্ছে ঃ
জাদুগর
‘গর’ প্রত্যয়যুক্ত ফারসী শব্দ ‘সওদাগর’ অর্থাৎ যিনি সওদা বোঝেন৷ ‘জাদুগর’ অর্থে যিনি জাদু জানেন, বোঝেন৷ এখানে বলে রাখা ভাল যে কেউ কেউ ‘জাদুগর’ বানানের পরিবর্ত্তে ‘যাদুকর’ এইরকম বানান লেখেন৷ তাঁরা শব্দটিকে ‘যাদু’ শব্দের উত্তর কৃ অল্ করে দেখাতে চান৷ কিন্তু তা ঠিক নয়৷ ‘জাদু’ ফারসী শব্দ৷ ‘জাদু’ জানেন, বোঝেন এই অর্থে ফারসী প্রত্যয় ‘গর’ যুক্ত হয়ে হয়েছে ‘জাদুগর’৷ তাই ‘যাদুকর’ বানানের টিকি থেকে ন্যাজের ডগা পর্যন্ত ভুল৷ ‘জাদুগর’ শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘বাজিকর’৷ ‘কর’ সংস্কৃত প্রত্যয়৷ ফারসীতে ‘কর’ প্রত্যয় নেই৷ ‘কার’ বলে যে শব্দটি রয়েছে তা প্রত্যয় নয়৷ ‘কার’ মানে ফারসীতে ‘কাজ’৷ ‘জাদু’ শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘বাজি’ বা ‘ভোজবাজি’, খাঁটি বাংলায় ‘ভেল্কি’৷ প্রাচীন ভারতে রাজা ভোজদেব ও তাঁর স্ত্রী ভানুমতী জাদুবিদ্যায় অভিজ্ঞ ছিলেন৷ তাই থেকেই ‘ভোজবাজি’, ‘ভানুমতী কা খেল’ প্রভৃতি শব্দ আসছে৷
ন্যাজ
অনেকে ‘ন্যাজ’ না বলে বলে ‘লেজ’ বা ‘ল্যাজ’৷ কিন্তু সেটা ঠিক নয়৷ সংস্কৃত ‘ন্যুব্জ’ থেকে ভাষাতত্ত্বের বিশেষ নিয়মে ‘ন্যাজ’ হতে পারে, ‘লেজ’ বা ‘ল্যাজ’ হতে পারে না৷ কেননা মূল শব্দের বানানে দন্ত্য ‘ন’ রয়েছে৷ তার বিবর্ত্তিত রূপে ‘ল’ আসবে কোত্থেকে? শব্দটা ‘লাঙ্গুল’ থেকেও আসে নি কারণ লাঙ্গুল–এ ‘জ’ অক্ষরটি নেই৷ এমনকি ‘দ’–ও নেই৷ অনেক সময় ‘দ’ বিবর্ত্তিত হয়ে ‘জ’ হয়ে যায়৷ ‘লাঙ্গুল’–এর তদ্ভব বাংলা শব্দ ‘নেঙ্গুন’৷ এই শব্দটি আমি বীরভূমের গ্রামে শুণেছি.......একটি ছড়ায় ঃ ‘‘ছুতোরে কাঠ কাটে/বগাতে নেঙ্গুন নাড়ে৷’’
গোরু
‘গম্’ ধাতু করণে ‘ডি’ প্রত্যয় করে ‘গো’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে যার ভাবারূূার্থ হচ্ছে যে বেশীর ভাগ সময় চলে থাকে৷ যোগারূূার্থে ‘গো’ মানে গোরু, ‘গো’ মানে ইন্দ্রিয়, ‘গো’ মানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, ‘গো’ অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাঁর লীলাভাসে উদ্ভাসিত তিনি ‘গোবিন্দ’৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে যিনি পালন করে চলেছেন এই অর্থে পরমপুরুষের আর একটি নাম ‘গোপাল’৷ ‘গো’ মানে ইন্দ্রিয়৷ দেহাধারে এই ইন্দ্রিয় যার শক্তিতে প্রকাশিত এই অর্থেও তিনি গোবিন্দ৷ আবার ঠিক দেহাধারে ইন্দ্রিয় সমূহের যিনি পালক এই অর্থেও তিনি গোপাল, যেখানে গোধন অর্থাৎ ক্যাট্ল প্রতিপালিত হয়, তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটে তা হ’ল গোকুল৷ এই ‘গো’ শব্দ স্ত্রীলিঙ্গে ‘গবী’ রূপ পরিগ্রহ করেছে৷ ‘গো’ শব্দের সঙ্গে ‘রুক্’ প্রত্যয় করে আমরা ‘গোরু’ শব্দ পাচ্ছি৷ গো+রুক = গোরুক>গোরুঅ>গোরু৷ কেউ কেউ ‘গরু’ লিখে থাকেন৷ সেটা ভুল৷ ‘গো’ দিতেই হবে৷