সমাজে এমন কিছু সুবিধাবাদী লোক থাকে যাদের স্বভাবই হ’ল মানুষকে শোষণ করা কিন্তু প্রকাশ্যে তারা সে কথা বলে না৷ বরং তারা মানুষকে কু–যুক্তি দেখিয়ে বলে–প্রকৃতি বা পরমাত্মার বিধানই এই যে সমাজের কিছু মানুষ চির অবহেলিত থাকুক৷ তারা জীবনভর শুধু অমানসিক পরিশ্রম করে যাক, আর সীমিত সংখ্যক লোক প্রাচুর্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করুক৷ এটাও ভাবজড়তা (Dogma)৷ যাঁরা বুদ্ধিমান, যাঁরা ধার্মিক তাঁরা অবশ্যই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করবেন তথা আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন, কারণ মানুষের স্বাধীন বুদ্ধিকে যা কিছু অবরুদ্ধ করে তা’ মানুষের বুদ্ধির মুক্তিকেও সুদূরপরাহত করে৷
সামাজিক ক্ষেত্রেও ঘটেছিল অনুরূপ ব্যাপার৷ যেমন কিছু লোক আগে থেকেই ঘোষণা করে দিয়েছিল যে নারী জাতি আধ্যাত্মিক মুক্তির অধিকারী নয়৷ নারীকে মুক্তি পেতে গেলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে হবে৷ এতো সৃষ্টিছাড়া কথা৷ প্রতিটি মানুষই পরমপুরুষের সন্তান–কেউ পু–, কেউ কন্যা৷ পরমপুরুষ কখনও কি এমন বিধান দিতে পারেন যে কেবল তাঁর পু–দের মুক্তি মোক্ষের অধিকারী থাকবে, কন্যাদের থাকবে না? এ তো অদ্ভুত অস্বাভাবিক কথা৷ এ তো একেবারেই দুষ্টামি৷ যাই হোক, মানুষের মাথায় এই ধরণের কু–যুক্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ নারী সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক অধিকারই নাই–এই ধরণের কথা শুণিয়ে তাঁদের বুদ্ধির বিকাশকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল৷ তাদের বুদ্ধির মুক্তিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল৷ এইভাবে নারী সমাজের আধ্যাত্মিক প্রগতি, সামাজিক উন্নতি পৃথিবীর অনেক দেশেই দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে৷ একদিকে অশুভ শক্তিরা চাইছে যে তাদের প্রবর্ত্তিত ভাবজড়তার প্রতিষ্ঠা হোক, অপরদিকে পরমপুরুষ চাইছেন মানুষের বুদ্ধির সর্বাত্মক বিকাশ হোক৷ তাই আমি তোমাদের আহ্বান জানিয়ে বলি, এই ভাবজড়তার বিরুদ্ধে তোমরা এক নিরবচ্ছিন্ন আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাও৷ জয় তোমাদের হবেই৷ (‘‘বুদ্ধির মুক্তি’’, ‘অভিমত’, ৪থ খণ্ড)
আজ ভগবান বুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই৷ তোমরা জান, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল৷ ভারতের ইতিহাসে ভগবান বুদ্ধ হচ্ছেন প্রথম মানুুষ যিনি সে যুগের ভাবজড়তার (Dogma) বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রাম চালিয়েছিলেন৷ ভাবজড়তা জিনিসটা কী ভাবজড়তা হ’ল একটা বিশেষ আইডিয়া যার চারদিকে একটা সীমানাজ্ঞাপক রেখা এঁকে দিয়ে বলা হয় যে এই রেখাটা দেশ–কাল–পাত্রনুযায়্ অপরিবর্তনীয়৷ কেউ এই সীমারেখার বাইরে যেতে পারবে না৷ তাই এই ভাবজড়তা মানুষের বৌদ্ধিকতাকে, বৌদ্ধিক স্বাধীনতাকে দারুণভাবে ব্যাহত করে৷ মধ্য আমেরিকায় ধর্মমহাচক্রের দিনগুলোতে এই ভাবজড়তার ওপরে আমি বিস্তারিত ভাবেই আলোচনা করেছিলুম৷ সেখানকার আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ভাবজড়তা ও মানব মনীষা’ (Dogma and human intellect)৷ ভগবান বুদ্ধই সর্বপ্রথম মানুষ যিনি তৎকালীন সমাজের প্রচলিত ভাবজড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন৷ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে সভ্য মানব সমাজে বুদ্ধদেবের বিদ্রোহ সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ছিল৷ ডগমার প্রতিশব্দ আমি করেছি ‘ভাবজড়তা’ অর্থাৎ ভাবভূমিতে জড়তায় যেখানে চলার পথ, অগ্রগতির পথ একেবারেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে, এমনকি মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়৷ পৃথিবীতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন মতবাদ ন্ব্দপ্পব্দগ্গ প্রচলিত রয়েছে সেগুলোও এক ধরণের ভাবজড়তা৷ তোমরা ওই সমস্ত ভাবজড়তার বাইরে একটা পা–ও রাখতে পার না৷
কার্ল মার্ক্স যা বলে গেছেন তোমাকে তা–ই মানতে হবে–এটা কেমন ধরণের কথা হ’ল৷ মার্ক্স যা বলে গেছেন তা ঠিক হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে৷ সে বিষয়ে চিন্তা করার স্বাধীনতা তোমার থাকবে না কেন? রেলিজন বা উপধর্ম সম্বন্ধীয় যে মতবাদ সেটাও এক ধরণের ভাবজড়তা৷ মানুষকে শেখানো হয়, ‘‘শাস্ত্রে আছে, তাই এটা তোমাকে মানতেই হবে’’৷ অর্থাৎ তোমার যে স্বাধীন বিদ্যা–বুদ্ধি তা বিসর্জন দিতে হবে৷ তোমাকে মেনে নিতে হবে যে রেলিজনের ব্যাপারে তর্কের প্রশ্ণই ওঠে না৷ এ কেমন ধারা যুক্তি৷ তাহলে কি মানব মনীষার অগ্রগতি চিরতরে রুদ্ধ হবে? মানুষের বৌদ্ধিক অগ্রগতির ওপর কি চিরকালের জন্যে সীলমোহর এঁটে দেব যাতে সে আর এগিয়ে না চলতে পারে
এই যে ভাবজড়তা, এর বিরুদ্ধে মানুষকে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলতে হবে৷ তবেই মানবতার প্রগতি সম্ভব৷ তোমরা লক্ষ্য করে থাকবে, যেখানে যুক্তি নেই সেখানেই এই ধরণের ভাবজড়তার প্রচারকেরা নিজের নামে বা নিজের দায়িত্বে ওই সমস্ত অযৌক্তিক মতবাদের প্রচার করেন না৷ চালাকির পথ ধরে বলেন, ‘‘এটা পরমাত্মার আদেশ কাল রাত্রে স্বপ্ণে পরমাত্মা আমাকে এই ধরণের একটা পয়গম বা এ ধরণের আদেশ দিয়ে গেছেন’’৷ নিজের নাম দিয়ে মতবাদকে প্রচার করেন না কারণ তাতে অন্যেরা অনেক অপ্রীতিকর প্রশ্ণ তুলবে–বেশ, তাহলে বোঝাও, ব্যাখ্যা করো, কেন এটা মানব, কেন ওটা মানব না৷ তাই প্রশ্ণোত্তরের ঝুটঝামেলা থেকে বাঁচবার জন্যে সে সোজা পরমাত্মার নাম নিত৷ বলত, ‘‘পরমাত্মা আমাকে এই রকমের নির্দেশ দিয়ে গেছেন’’৷