‘ভগবান’ শব্দের তাৎপর্য

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

দ্বিতীয় গুণটা হ’ল প্রতাপ administration অর্থাৎ শাসন আছে৷ সবাই ভালবেসে হোক, ভয়েই হোক, তাঁকে মানবে৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবাই পরমপুরুষকে মানছে৷ কেন মানছে? – না, না মেনে উপায় নেই৷ তার ভয়ে বায়ু বয়ে চলেছে৷ ভয় না থাকলে হাওয়া হয়তো বলত, খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নিই৷ সংস্কৃতে হাওয়ার অপর নাম ‘অনিল’৷ সংস্কৃত ‘নিল’ মানে স্থির, স্থাণু, একটা জায়গায় যা স্থির হয়ে বসে আছে  আর ‘অনিল’ মানে যা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে নেই৷ পরমপুরুষের প্রতাপ আছে, ঐশ্বর্য আছে – দু’টো গুণ হ’ল৷ ‘‘ভীষাস্মাদ্ বায়ুঃ পবতে’’ অর্থাৎ তাঁর ভয়ে হাওয়া ছুটে বেড়াচ্ছে৷ ভাবছে, দু’টো চোখ আমার পিছনে রয়েছে৷ ‘‘ভীষোদেতি সূর্যঃ’’ অর্থাৎ তাঁর ভয়ে সূর্য ঠিক সময়ে উদিত হচ্ছে৷ আজ রবিবার, একটু দেরীতে উঠব – এমন কথা বলার জো নেই, ঠিক সময়ে উঠতে হবে৷ ‘‘ভীষাস্মাদগ্ণিশ্চেন্দ্রশ্’’৷ তাঁর ভয়ে অগ্ণি, ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ – সবাই আপন আপন কাজ করে চলেছে৷

আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে৷ তা’ না হলে পরমপুরুষ অসন্তুষ্ট হবেন৷ ‘ইন্দ্র’ শব্দের অনেকগুলো মানে আছে৷ একটা মানে হ’ল বড়, শ্রেষ্ঠ৷ ‘ইন্দ্র’ শব্দের আরেকটা অর্থ হ’ল শাল গাছ৷ শাল গাছ খুব উঁচু উঁচু হয়ে থাকে৷ সংস্কৃতে শাল গাছকেও ‘ইন্দ্র’ বলে৷ বাঁকুড়া জেলায় শাল গাছ খুব আছে৷ তাই সেখানকার একটা জায়গার নাম ‘ইন্দ্রপুর’ বা ‘ইন্দপুর’ অর্থাৎ যেখানে বড় বড় শালগাছ জন্মায়৷ যেমন বড় কূপকে বলে ‘ইন্দ্রকূপ’, প্রাকৃতে ‘ইন্দ্রউ’, পুরোনো ৰাঙলায় ‘ইন্দরউ’, বর্ত্তমান ৰাঙলায় ‘ইন্দারা’, বিহারের গ্রাম্য ভাষায় ‘ইনারা’ – সবই ওই ‘ইন্দ্রকূপ’ থেকে এসেছে৷ ইন্দ্রের আরেকটা মানে হ’ল এনার্জি –– ight energy, sound energy, electric energy ইত্যাদি৷ এদের স্বভাব আমরা জানি বলে কাজে লাগাতে পারি৷ এনার্জিগুলো বিধিনির্দিষ্ট একই রকম স্বভাব অনুযায়ী চলে, চলতে বাধ্য হয় কারণ পরমপুরুষের ভয়৷ ‘মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ’ অর্থাৎ মৃত্যু যথাকালে জীবের কাছে উপস্থিত হয়৷ এই জন্যে পরমপুরুষের একটা নাম হ’ল ‘ভীষণ’৷

‘ভগ’ শব্দের একটা মানে সব রকমের ঐশ্বর্য্য, অলৌকিক শক্তি occult power)€ দ্বিতীয় মানে হ’ল প্রতাপ, দাপট৷ খাঁটি ৰাঙলা হ’ল ‘দাপট’, সংস্কৃত হ’ল ‘প্রতাপ’৷

তৃতীয় গুণটা হ’ল ‘যশ’৷ যখন কোন গুণ প্রকাশ্যে বলা হয় তাকে বলা হয় ‘যশ’৷ প্রকাশ্যে না বলা হলে ‘যশ’ বলা হবে না৷ সেটা যদি ছন্দোৰদ্ধভাবে বলা হয় তখন হয়ে যাবে যশোকীর্ত্তন৷ সেটা উচ্চারিত হবে হ্রস্ব ভাবে নয় – দীর্ঘ বা প্লুত ভাবে, যাতে অন্যেরা শুণতে পায়৷ কীর্ত্তন মনে মনে হয় না৷ যশ আবার দু’রকমের –– একটা ধনাত্মক (positive), আরেকটা ঋণাত্মক (negative)৷ কারুর যদি তুমি খুব জোরে নিন্দা কর সেটাও যশ.... ঋণাত্মক যশ৷ ‘ভগ’ শব্দের তৃতীয় মানে হ’ল ‘যশ’৷ সেটা ধনাত্মক, ঋণাত্মক দুই–ই৷ কারণ যখনই ঈশ্বরীয় বিভূতি বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়েছে তখনই দেখা গেছে মানুষের একটা গোষ্ঠী পক্ষে, আরেকটা গোষ্ঠী বিপক্ষে৷ কৃষ্ণের বিপক্ষে কংস, রামের বিপক্ষে রাবণ৷ অদ্ভুত একটা ভাষাতাত্ত্বিক বা পলিটিক্সের নিয়ম যে এ পক্ষের যে আদি অক্ষর, ও পক্ষেরও সেই একই আদি অক্ষর৷

রামায়ণে একটা গল্প আছে৷ হনুমান গেছল রাবণের অন্তঃপুরে ব্রাহ্মণের বেশে রাবণের মৃত্যুবাণটা আনতে৷ তখন নারীরা বললে – ঠাকুরমশাই, এই যে রাম–রাবণের যুদ্ধ চলছে এতে কে জিতবে? তার জবাবে হনুমান লাফ দিয়ে পালাতে পালাতে বললে   – যে জিতবে তার নামের প্রথম অক্ষর ‘রা’৷ ওরা ভাবল, রাবণ জিতে যাবে৷ এদিকে প্রতিপক্ষেরও প্রথম অক্ষর ‘রা’৷ তেমনি যশ বলতে ধনাত্মক যশ, ঋণাত্মক যশ দুই–ই ৰোঝায়৷ যখন পৃথিবীতে কোন ৰৃহৎ আদর্শ আসবে তখনই এটা ঘটবে৷ The entire intellectuality, the entire world opinion will be polarised. পোলারাইজেশন হ’ল না, বিষুবে ঘোরাফেরা করছে, তখন ৰুঝবে বড় কিছু একটা নয়, এটা একটা সাধারণ জিনিস, রঙচঙ করে এসেছে৷ এটা সোণা বা রূপা নয়, এটা সোণালী বা রূপালী রাংতা৷ আর যখন দেখবে পোলারাইজেশন হয়েছে, ধ্রুবীকরণ হয়েছে, তখন ৰুঝবে একটা সাংঘাতিক রকমের কিছু এসেছে৷

চতুর্থ গুণটা হ’ল ‘শ্রী’৷ ‘শ্রী’ শব্দটা আসছে ‘শ’, ‘র’, ‘ঈ’ যোগ করে৷ ‘শ’ হ’ল রজোগুণের ৰীজমন্ত্র যার দৌলতে মানুষ ছোটাছুটি করে, শক্তি প্রদর্শন করে, বিদ্যা–ৰুদ্ধির প্রদর্শন করে৷ সব কিছু করে ‘শ’–এর সাহায্যে অর্থাৎ রজোগুণের অভিপ্রকাশের দ্বারা৷ রজোগুণ না থাকলে তার যতই শক্তি থাকুক না কেন, কিছুই করতে পারবে না, হাঁদা গঙ্গারাম হয়ে পৃথিবীর বোঝা হয়ে থেকে যাবে৷ এমন মানুষ তোমরা অনেক পাবে যাদের বিদ্যে আছে, ৰুদ্ধি আছে, শক্তি আছে কিন্তু জরদগব – কোন কাজটি করবার নয়৷ এমন অনেক লোক দেখতে পাবে যাদের নড়তে–চড়তেই বার মাস৷ কোন কাজের নয় তারা৷ তাদের ‘শ’–এর অভাব আছে৷

আর ‘র’ হ’ল এনার্জির ৰীজমন্ত্র৷ এনার্জি – যার সম্বন্ধে আগে ৰলেছি৷ সংস্কৃতে ‘ইন্দ্র মানে এনার্জি যেমন লাইট, সাউন্ড, ইলেক্ট্রিক ইত্যাদি৷ ‘শ’ অর্থাৎ রজোগুণী বৃত্তি, আর ‘র’ অর্থাৎ এনার্জির যোগান যেখানে আছে সেখানেই কাজ হবে৷ অনেকের অনেক কিছু করবার ইচ্ছে থাকে, সামর্থ্য নেই সাধ ছিল, সাধ্য ছিল না সেখানে ‘র’ এর অভাব৷ যেখানে ‘শ’ আছে, আর ‘র’–ও আছে – হয়ে গেল ‘শ্র’ স্ত্রিয়াম্ ‘ঙীষ্’ করে হয়ে গেল ‘শ্রী’৷ It is the legacy of India to prefix ‘shrii’ before one’s name because everybody wants it. সবাই শ্রী চায়, তাই নামের আগে ‘শ্রী’ লিখবার নিয়ম একটা উপসর্গ হিসেবে৷ ‘শ্রী’ মানে হচ্ছে আকর্ষণী শক্তি (charm/fascination)৷ তোমরা দেখেছ, অনেক জিনিস দেখলে তোমরা আকৃষ্ট হয়ে পড়৷ তার মানে সেই জিনিসটার একটা আকর্ষণী শক্তি আছে৷ কিছু লোক দেখবে, ভাষণ–টাসন দিতে পারে না, বিদ্যে–ৰুদ্ধি তেমন বিশেষ নেই কিন্তু খুব জমিয়ে গল্প করতে পারে, লোকে তাকে ঘিরে বসে পড়ে৷ ওটা এক ধরনের শ্রী৷ এমন লোক আছে, গান খুব ভাল জানে না, কিন্তু এমনভাবে গাইবে যে পাঁচ জন ছুটে আসবে৷ এটা হ’ল তার গানের শ্রী৷ সেই লোকটাকে টাইটেল দিতে পারি ‘গীতশ্রী’৷ যার মধ্যে চতুর্থ গুণ হিসেবে শ্রী আছে, charm আছে, fascination  আছে, fascinating faculty আছে – এটা হ’ল ‘ভগ’–এর চার নম্বর গুণ৷

পঞ্চম গুণ হ’ল ‘জ্ঞান’৷ ‘জ্ঞান’ মানে কী? একটা বই পড়লে, বইটা মনে ধরে রাখলে৷ এটা জ্ঞান নয়৷ Subjectivisation of objectivity – এই হ’ল জ্ঞানের ব্যাখ্যা৷ তুমি আজ পড়ছ, কাল ভুলছ৷ তোমরা যারা এম. এ. পাশ করেছ তাদের এক্ষুণি যদি পরীক্ষায় বসতে বলি, কেউ পাশ করতে পারবে না৷ সব ভুলে গেছ, খেয়ে দেয়ে হজম করে ফেলেছ – তার মানে সত্যিকারের জ্ঞান পাওনি৷ সত্যিকারের জ্ঞান হলে তখনও যা ছিল, আজও তাই থাকবে৷ তা নেই৷ এসেছে, চলে গেছে৷ যা আসে আর যায় তা জ্ঞান নয়৷ স্থায়ীভাবে যা থাকে তা–ই জ্ঞান৷ বাস্তব জগতের পুঁথিপড়া বিদ্যে, লোকের কাছে শোণা বিদ্যে আসে আর যায়৷ এগুলো জ্ঞান নয়৷ তবে এদের মধ্যে যে জিনিসগুলো কল্যাণজনক, স্থায়ী জনকল্যাণের জন্যে শিখেছিল সেগুলোকে বলা হয় বিজ্ঞান৷ পরমপুরুষ সংক্রান্ত জ্ঞানকেও বিজ্ঞান বলি কারণ ওটাও তো জনকল্যাণে লাগবে৷ তাই প্রকৃত জ্ঞান সম্বন্ধে শাস্ত্রে ৰলা হচ্ছে –

    ‘‘আত্মজ্ঞানং বিদুর্জ্ঞানং জ্ঞানান্যন্যানি যানি তু৷

     তানি জ্ঞানাবভাসানি সারস্য নৈব ৰোধনাৎ৷৷’’

নিজেকে জানা বা আত্মজ্ঞানই সত্যিকারের জ্ঞান৷ যেটুকু self-realisation, that is, where the subjectivity and the objectivity coincide, there we say, it is knowledge. There we have reached the pinnacle of knowledge. এটাই হ’ল জ্ঞান৷

ষষ্ঠ গুণ ‘বৈরাগ্য’৷ বি–রণ্জ্  ঘঞ্ প্রত্যয় ক’রে ‘বিরাগ’৷ ‘রণ্জ্’ মানে রঙ লাগানো৷ ‘রণ্জ্’ ধাতুর উত্তর ‘ল্যুট্’ করলে ‘রঞ্জন’ আর ‘রণ্জ্’  ‘ষক্’ প্রত্যয় করলে ‘রজক’ অর্থাৎ যে লোকটা রঞ্জক (রণ্জ্  ণক্) দিয়ে রঙ লাগাচ্ছে৷ ‘রজক’ মানে যে কাপড়ে রঙ লাগায়৷ বি–রণ্জ্ ধাতুর মানে যা রঙ সরিয়ে দেয়৷ রঙকে যা সরিয়ে দেয় তা হ’ল ‘বিরাগ’৷ ভাববাচক বিশেষ্যে ‘বৈরাগ্য’৷ এ পৃথিবীতে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে যে সব বস্তুর পিছনে, যে সব সত্তাগুলোকে মনে ভাবে, চোখে দেখে, তখন তার রঙটাই দেখে৷ অনেক উঁচুতে গাছের ওপর কাল রঙের একটা ফল রয়েছে৷ রঙটাই বলে দেয় যে ওটা কাল জাম৷ রঙ দেখে মানুষের আকর্ষণটা হয়৷ যে সত্তা পৃথিবীর ভিতরে রয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কোন জিনিসের রঙ তাকে টানছে না, কোন রঙ তাকে প্রভাবিত করছে না, কোন জিনিসের রঙ তাকে পরামৃষ্ট করছে না – সেই যে মানুষটার ভাব, সেটা হ’ল বৈরাগ্য আর তিনি বৈরাগী৷

এই যে ছ’টা গুণ বলা হ’ল, এই ছ’টা গুণের মিলিত নাম ‘ভগ’৷ যার এটা আছে  – এই অর্থে ‘ভগ’ শব্দের উত্তর ‘মতুপ্’ প্রত্যয় করে তৈরী হয় ‘ভগবান’ শব্দটা৷ তাহলে ‘ভগ’ শব্দের দু’টো মানেই ৰুঝিয়ে দিলুম৷

১৩ জানুয়ারী ১৯৮০, কলিকাতা