‘‘ভূমা–বৃত্তিগত ভারসাম্য’’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহূত হয় কেবলমাত্র ভূমার ক্ষেত্রে, জীবের ক্ষেত্রে নয় । বৃত্তি মনের আভোগ, তারা মনের ভাবাবেগসম্পন্ন অভিব্যক্তি । এই বৃত্তিসমূহের ফলশ্রুতি হচ্ছে নির্দিষ্ট মনের সংস্কার । সংস্কারের মধ্যে আছে সংবেগ যার অন্তর্নিহিত শক্তি জীবদেহকে সেইদিকে প্রচালিত করে । এই সংস্কার পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত সব কর্মের মূল কারণ যা জীবদেহকে ভোগ করতেই হবে । তাই সৎকর্মের মাধ্যমে সৎ সংস্কার তৈরী করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে । কিন্তু সংস্কার ভোগের সে৷ সে৷ এও সতর্ক থাকতে হবে যাতে সেই সময়ে অন্য সংস্কার তৈরী হয়ে না যায় ।
বৃত্তির তিনটি দিক
সংস্কার সঞ্জাত বৃত্তি তিন প্রকারের–জাগতিক ইচ্ছা, মানসিক প্রেষণা আর আধ্যাত্মিক এষণা । শেষেরটি ভাল বা মন্দ কোনো সংস্কার তৈরী করে না এখানে আছে একটি সাম্যাবস্থা । মানসিক প্রেষণা সঞ্জাত বৃত্তি উন্নতিমূলক বা অধোগতিমূলক দুই–ই হতে পারে । যদি প্রবণতা সূক্ষ্মতর স্তরের দিকে থাকে, বৃত্তি হবে উন্নতিমূলক, আর যদি তা স্থূল স্তরের প্রতি থাকে তা হবে অধোগতিমূলক ।
বৃত্তিগত ভারসাম্য (equilibriun) কেবলমাত্র ভূমাসত্তারই বৈশিষ্ট্য, কেননা তাঁর মধ্যেই সবকিছু আছে, কোন কিছু তাঁর বাইরে নেই । তাই তা অনুপহত (unassailed) থাকে । কিন্তু জীবের আছে একটি বাহ্যিক জগত, আর তাই সেই জগত থেকে আসা বিভিন্ন তর৷ তাকে প্রভাবিত করে, ফলস্বরূপ মনে এক অসাম্যাবস্থা তৈরী হয় ।
আগেই বলেছি জীবমনের আভোগ হচ্ছে বৃত্তি, তাই এই বৃত্তির অভাবে তার অস্তিত্ব থাকতেই পারে না । জীবের মানসদেহে বাহ্যিক জগত থেকে আসা যা কিছুর প্রতিফলন হচ্ছে সেটাই তার মনের বৃত্তি যা তার মনের আভোগ । তাই বাহ্যিক জগতের আন্তরিক প্রক্ষেপণই হচ্ছে মানসিক আভোগ । কিন্তু ভূমার ক্ষেত্রে কোনকিছুই বাহ্যিক নয়, সবকিছু ভূমার মধ্যে, আর তাই ভূমার কোনো আভোগের প্রয়োজন নেই । জীব আর ভূমার মধ্যে এই হচ্ছে মূলগত পার্থক্য । তাছাড়া, ভূমামন যা তৈরী করে তা নোতুন কিন্তু জীবমনের সৃষ্ট সবকিছু শুধুমাত্র বাহ্যিক জাগতিকতার প্রতিফলন । সত্যি কথা বলতে কী ভূমার ক্ষেত্রে বৃত্তি বলে কোনো শব্দ ব্যবহার করা যায় না, সবকিছুই ভূমার সংকল্প । এই সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব তাঁর সংকল্প ।
ভূমা বৃত্তিগত ভারসাম্যের (equilibriun) মধ্যে একটা চিরস্থায়ী গুণসাম্য (equipoise) বজায় থাকে, যদিও তা নিরন্তর কার্যান্বিত হচ্ছে এই তিনটি স্তরের মধ্যে । ভূমার মানসদেহে উৎপন্ন তর৷ সবকিছুর সৃষ্টি করছে, যার ৰীজমন্ত্র হচ্ছে ‘অ’ । সৃষ্টি–বৈচিত্র্যের জন্যে এই তরে৷র মধ্যে সংঘর্ষ ও সমিতির কারণে শব্দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আবার সংৰদ্ধতাও আসছে, আর এইভাবে ব্যঞ্জনবর্ণ তৈরী হচ্ছে । লাতিন ভাষারও বিভিন্ন ব্যঞ্জনবর্ণ তারই রূপ ।
ভূমাদেহে সৃষ্ট এই ‘ব্যঞ্জন’–এর প্রথম বর্ণ হচ্ছে ‘ক’ এই ‘ক’ একটি ৰীজমন্ত্র । তাই এই বিশ্ব তৈরী হয়েছে ‘ক’–এর দ্বারা । ‘ক–দেব’–কে সেবা করার অর্থ সব মহাজাগতিক অভিব্যক্তির সেবা করা । সেইজন্যে যে সমগ্র জাগতিক অভিব্যক্তিকে সেবা করে আর রক্ষণাবেক্ষণ করে তাকে বলা হয় ‘কাপালিক’ ।
ওঁঙ্কারের সৃষ্টি ও অভিব্যক্তি
ভূমা মানসদেহের তর৷ এই বিশ্বকে সৃষ্টি করেছে, আর তা করা হয়েছে ভূমা প্রকৃতির (Creative Principle) সহায়তায় । প্রকৃতির ক্রিয়াশীলতার প্রথম স্তরে সৃষ্ট হয় ‘ৰোধিচিত্ত’ । স্বরবর্ণের জড়ীভূত অবস্থাই হচ্ছে ব্যঞ্জনবর্ণ যা ভূমা প্রকৃতির ক্রিয়াশীলতার ফলশ্রুতি । যখন ভূমা প্রকৃতি পরমসত্তার ওপরে প্রতিফলিত হচ্ছে তখন তৈরী হচ্ছে জ্যোতি । জীব আর ভূমা দুইয়ের ক্ষেত্রে এই জ্যোতির অস্তিত্ব থাকবেই । জীবের ক্ষেত্রে এটা ব্যষ্টিগত জ্যোতি । আর মহাজাগতিক ক্ষেত্রে এটা ব্রহ্মজ্যোতি যা সর্বত্র বিদ্যমান । যখন সাধক সেই জ্যোতিস্বরূপকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় তখন সে সমগ্র মহাবিশ্বকে দেখে একটি জ্যোতিপুঞ্জ রূপে ।
যখন ভূমা প্রকৃতি ভূমাসত্তার মধ্যে স্পন্দন উৎপন্ন করে তখন শব্দও তৈরী হয়, আর সেই শব্দই হচ্ছে ওঁঙ্কার । ৰৌদ্ধতন্ত্রে একে অভিহিত করা হয়েছে ‘প্রভাস্বর শূন্যতা’ নামে । এটাকে বলা হচ্ছে ‘শূন্য’ কারণ এখানে জাগতিকতার কোনো অস্তিত্ব নেই, আর সেই কারণে মানসিক অভিব্যক্তিও হয় না, এখানে থাকে কেবল আধ্যাত্মিকতা । সেইজন্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন, ৰৌদ্ধদের ‘শূন্য’ ব্রহ্মবাদীদের ‘ব্রহ্ম’ ।
ক–বৃত্তিগত পরম লক্ষ্য
জীবমন যখন প্রকৃতির সহায়তায় বাহ্যিক জগতের দিকে অগ্রসর হয়, তাকে বলা হয় ‘প্রবৃত্তি’, আর যখন তা জাগতিক থেকে মানসিক আর মানসিক থেকে আধ্যাত্মিকের দিকে থাকে, তাকে বলা হয় ‘নিবৃত্তি’ আর যখন পূর্ণ সাম্যাবস্থা থাকে তা ‘সংবৃত্তি–ৰোধিচিত্ত’ যা জীবের লক্ষ্য হতে পারে না । পরম লক্ষ্যই জীবের একমাত্র লক্ষ্য ।
জীবমনের প্রবণতা হয় প্রবৃত্তি নয় নিবৃত্তির দ্বারা প্রচালিত হয়, তা ‘সংবৃত্তি’ হতে পারে না, কারণ জীবসত্তার মধ্যে আছে অন্তর্নিহিত গতিশীলতা । এইজন্যে বেদ মানুষকে বলছে ‘এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো’, কেননা গতিশীলতাই জীবন । যে আধ্যাত্মিক অন্ধকারে ডুবে আছে তার জন্যে সেটা ‘কলিযুগ’ যার মধ্যে নিদ্রা থেকে জেগে ওঠবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে, সেটা ‘দ্বাপর যুগ’ যে উঠে দাঁড়িয়ছে সেটা ‘ত্রেতাযুগ’ আর যে আধ্যাত্মিক পথে চলা শুরু করে দিয়েছে সেটা ‘সত্যযুগ’ মানুষের স্বভাবের মধ্যেই যেহেতু গতিশীলতা নিহিত রয়েছে তাই জীবের ক্ষেত্রে ‘সংবৃত্তি’ সম্ভবপর নয় মানুষকে ‘প্রবৃত্তি’ অথবা ‘নিবৃত্তির’–র পথ নিতেই হবে ।
নিবৃত্তির পথ অ–বৃত্তিগত, আর তার অন্তিম বিন্দু হচ্ছে অ–বৃত্তিগত পরম লক্ষ্য যা মানবতার চরম ও পরম লক্ষ্য তা প্রাপ্ত হতে গেলে সাধককে মনকে প্রত্যাহূত করে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে, তারপর সেই বিন্দুস্থ ‘‘আমি’’ ব্রহ্মসমূদ্রে লীন হয়ে যাবে, যা পরম লক্ষ্য যখন এই মিলন সম্ভবপর হয় তখন ভূমা প্রকৃতির সহায়তার আর প্রয়োজন হয় না ৰোধিচিত্তে অভিব্যক্ত জ্যোতির অস্তিত্ব সেখানে থাকে না এটা হচ্ছে ‘নিষ্কল’ ৰ্রহ্মের অবস্থা সবকিছুকে তাঁর মধ্যে মিলেমিশে একাকার হতেই হবে, আর সেটাই পরম লক্ষ্য তিনি পরম সৃষ্টিকর্ত্তা আর আমরা সকলে তাঁর সৃষ্ট সন্তান । তিনিই পরম লক্ষ্য