(১) প্রাচীনকাল থেকেই ‘দ’ শব্দটি নানান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ বেদের একটি আখ্যায়িকায় আছে, পরস্পর সংঘর্ষরত দেবতা, দানব ও মানুষেরা একবার দেখলে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জ্যোচিষ্মান পুরুষ৷ নীচের দিকে তাকিয়ে তার আদি-অন্ত দেখা যায় না! ওপরের দিকে তাকিয়েও আদি-অন্ত দেখা যায় না এ যেন জ্যোতিঃর একটি ঘনীভূত রূপ৷ তারা সবাই করজোড়ে তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ প্রাপ্তির আশায় দাঁড়িয়ে রইল৷ সেই বিরাট পুরুষ তাদের উদ্দেশে কেবল ‘দ’ শব্দটি উচ্চারণ করে অন্তর্হিত হলেন৷
সেকালে দেবতাদের মধ্যে ছিল চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও পানাসক্তি৷ তাঁরা ভাবলেন ‘দ’ (দম + ড) মানে দমন করা অর্থাৎ নিজেকে নিয়মের বশে আনা---নিজের প্রবৃত্তিকে পোষ মানানো ‘দম্’ ধাতুর অর্থ পোষ মানানো, বশে আনা to tame, to subdue.
প্রাচীন সংস্কৃতে ‘আসব’ ও ‘অরিষ্ট’ দুই-ই আসলে গ্যাঁজানো মদ৷ এমন কি চোলাই-করা মৃতসঞ্জীবনী সুধা/সুরা যা আয়ুর্বেদে ঔষধ রূপে ব্যবহৃত তারও উদ্ভুতি ৰেশী প্রাচীনকালে নয়৷ তার সৃষ্টি সম্বন্ধেও গল্পে ৰলা হয়েছে---
‘‘দেবাসুরৈর্যুদ্ধকালে শুক্রেণ পরিনির্ম্মিতম্৷’’
অর্থাৎ দেবাসুরদের যখন লড়াই চলছিল তখন অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য প্রথম মৃতসঞ্জীবনী তৈরী করিয়েছিলেন ও অসুরদের তা পান করিয়ে তাদের মধ্যে লড়াইয়ে উৎসাহ সঞ্চার করে দিয়েছিলেন৷ এরপর থেকে দেবতারা আত্মসংযমের অভ্যাস করলেন ও সাধন-ভজন শিখলেন--শিখলেন তাঁদের গুরু বৃহস্পতির কাছ থেকে৷
অসুরেরা ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির৷ এমনিতে তারা তপশ্চর্যা, সাধন-ভজন কিছু কিছু করত-রুদ্ররূপে পরমপুরুষের আরাধনাও করত যে রুদ্র পরবর্ত্তীকালে শিবত্বে পর্যবসিত হয়েছিলেন৷
অসুররা ভাবল, বিরাট পুরুষ চান আমরা দুঃখার্ত্ত মানুষের দুঃখ নিরসন করি৷ আমাদের প্রাচুর্যের অংশ তাদেরও দিই৷ তাই তারা ‘দ’ (দ + ড = দ) মানে, ধরে নিলে, দান করো৷ তারপর থেকেই অসুরেরা যেমন দু’হাতে সম্পদ আহরণ করত তেমনি তা দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষের মধ্যে বিলিয়েও দিত৷ কোন কোন অসুরের দান-প্রাচুর্যের কথা নিয়ে পুরাণ লিখিতও হয়েছিল৷ ‘‘অতিদানে বলীর্বদ্ধঃ’’ (অতিরিক্ত দান করার জন্যে অসুররাজ মহাৰলীকে পাতালে যেতে হয়েছিল)৷
মানুষেরা ভাবলে, পরমপুরুষ বলতে চাইছেন---মানুষ, তোমরা ৰড় স্বার্থপর, সব কিছুকেই স্বার্থের চশমায় দেখে থাক৷ যেখানে স্বার্থ নেই তার ধারেকাছেও মাড়াও না, আর যেখানে স্বার্থ আছে সেখানে আস্তাকুড়ের পচা মাছের আঁশের ওপর মাছির মত ভন ভন কর৷ তাই পরমপুরুষ মানুষকে ৰলতে চাইছেন---মানুষ, তোমার হৃদয়কে বৃহত্তর করো---স্বার্থচেতনার ঊধের্ব ওঠো৷ তাই তারা ধরে নিলে, ‘দ’ (দ + ড = দ) মানে ‘দয়া করো’৷ সেই থেকে মানুষ জীবে দয়াকে অন্যতম সাধনা ৰলে মেনে নিয়েছিল৷ তাহলে তোমার বুঝলে, ‘দ’-এর তিনটি মানে প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে---(১) দম + ড = দ যার ভাবারূড়ার্থ হল আত্মসংযম করা৷ ‘দম্+‘ক্ত’ করে পাই. ‘দান্ত’ শব্দটি৷ তেমনি ’’শম ধাতু থেকে পাচ্ছি শান্ত’’৷ যিনি শমন করেন এই অর্থে যম ও শিব দুই-ই হয়৷ যোগারুঢ়ার্থে ‘দ’ মানে দেবতা৷ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ‘দ’ অর্থে শিব ও যম (মৃত্যু-দেবতা-প্লুটো)৷ ‘দা+‘ড’ করে পাই ‘দ’---ভাবারুঢ়ার্থে যে দান করে৷ যেমন যে ৰর দান করে সে ৰরদ, যে বারি দান করে সে বারিদ, যে সুখ দান করে সে সুখদ, যে জল দান করে সে জলদ, স্ত্রীলিঙ্গে ‘জলদা’ (‘‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’’), যোগারাঢ়ার্থে ‘দ’ বলতে অসুরকে বোঝায়৷ আর ‘দয়্’ ধাতু+ ‘ড’ করে যে ‘দ’ শব্দ পাচ্ছি ভাবারুঢ়ার্থে তা সদয় ব্যষ্টিকে ৰোঝায় আর যোগারুঢ়ার্থে ‘দ’ মানে মানুষকে ৰোঝায়৷
দয়াধর্ম ঠিকমত শেখাবার জন্যে মানুষদেরও গুরুর প্রয়োজন ছিল৷ দেবগুরু বৃহস্পতি ও অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের মত মানুষদের তেমন কোন গুরু ছিল না৷ তাই মানুষেরা প্রায়ই দয়াধর্মের পথ থেকে ভ্রষ্ট হত৷ পরবর্ত্তীকালে তারা শিবকে তাদের গুরু রূপে মেনে নিয়েছিল৷ দেবগুরু বৃহস্পতি ও অসুরগুরু শুক্রাচার্যের অনুগামীরাও শিবকে তাদের গুরু রূপে মেনে নেওয়ায় মহাসৃষ্টিতে শিব চিরভাস্বর হয়ে গেলেন৷ সেকালে দেবগুরু বৃহস্পতির সম্মানার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রহের নাম দেওয়া হয়েছিল বৃহস্পতি, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রহের নাম দেওয়া হয়েছিল শুক্রগ্রহ৷ সপ্তাহকে ৰলা হত শিবসপ্তাহ৷ এখন আর ‘সপ্তাহ’ শব্দের সঙ্গে ‘শিব’ শব্দের সংযুক্তি নেই৷ ---শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের লঘুনিরক্ত গ্রন্থ থেকে