তোমরা জান, যে ললিত-মার্মিক নৃত্যের সাহায্যে কীর্ত্তন করা হয় তা হ’ল বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক ভাবের নৃত্য, আর কৌশিকী হ’ল মানসাধ্যাত্মিক নৃত্য যার সূত্রপাত হয় মানসিক স্তরে ও শেষ পরিণতি আধ্যাত্মিক স্তরে৷ তাণ্ডব শারীরিক-মানসিক আধ্যাত্মিক নৃত্য৷
ললিত-মার্মিকে হাত দু’টিকে ৯০০-র বেশী কোণ তৈরী করে ওপরে রাখতে হয়৷ এতে বোঝা যায় যে এটি একটি মুদ্রা, যা সংস্কৃত শব্দ৷ এই মুদ্রার তাৎপর্য হচ্ছে ‘‘হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমার৷ আমি তোমার, আমি একান্তভাবে তোমার৷’’
জগতের সর্বত্র দেখবে যে দু’টি সত্তার মধ্যে একটি থাকে কর্ত্তৃত্বব্যঞ্জক অবস্থায়, আর অন্যটি সেই প্রথমোক্ত সত্তার নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে৷ এইভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা সত্তাগত সম্বন্ধ থেকে যায়৷ তাহলে পরম সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্ট জগতের সম্পর্কটা কী রকম? তিনি সকলের আপনজন৷ আবার সব সৃষ্ট সত্তাই তার একান্ত ভাবে নিজের৷
এটা হচ্ছে দার্শনিক ব্যাখ্যা৷ কিন্তু ভক্তদের জন্যে ব্যাখ্যাটা এ রকম নয়৷ ভক্তদের তিনটি শ্রেণী আছে৷ তৃতীয় শ্রেণীর ভক্ত বলে---‘‘হে পরমপুরুষ, তুমি তো সকলের৷ আর যেহেতু আমিও এই ‘সকলের’ মধ্যে একটি সত্তা তাই তুমি আমারও৷ যেহেতু আমি সকলের বাইরে নই, তাই আমি অবশ্যই তোমার৷’’ দ্বিতীয় শ্রেণীর ভক্ত বলবে---‘‘না-না-না--এই ধরনের ভাবনা ঠিক নয়৷ তুমি আমার, আর যেহেতু তুমি আমার, তাই তুমি সকলেরও৷’’ এখানে প্রথম কথাটা হচ্ছে-তুমি আমার’’, আর দ্বিতীয় কথা---‘‘যেহেতু তুমি আমার তাই তুমি অন্যেরও’’৷
কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ভক্ত বলবে !---‘‘না-না-না---এই ভাবনাটাও ঠিক নয়৷ তুমি আমার, তুমি কেবলমাত্র আমারই! তোমার আমার সম্বন্ধ একান্ত ব্যষ্টিগত৷ আমি দর্শন জানি না, সাধনা জানি না, আমি শুধু জানি তুমি আমার৷ সম্পর্কের এই অধিক্ষেত্রে আমি কোন তৃতীয় সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করি না৷ এখানে তোমার-আমার সম্পর্কটা সম্পূর্ণভাবে পারস্পরিক৷ আমি অন্যান্য সবকিছু জিনিস অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারি৷ তুমি কিন্তু একশো ভাগই আমার৷’’
আমি আশা করি তোমরা, আমার ছেলেমেয়েরা অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর ভক্ত৷
এই ব্যষ্টিগত সম্বন্ধের ব্যাপারে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক দিক আছে৷ বিশুষ্ক দর্শন শাস্ত্রে পরমপুরুষ হলেন নৈর্ব্যষ্টিক সত্তা৷
দার্শনিক দিক থেকে তিনি এই ব্রহ্মচক্রের প্রাণকেন্দ্র৷ সেই প্রাণকেন্দ্র কখনই ব্যষ্টিগত সত্তা হতে পারেন না৷ কেননা তিনি সব জাগতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাইরে৷ তাই তিনি অবশ্যই নৈর্ব্যষ্টিকসত্তা৷ কাল্টের বা প্রকরণের ক্ষেত্রে তিনি আবার বৈয়ষ্টিক ও নৈর্ব্যষ্টিকের মিশ্ররূপ৷ অর্থাৎ তাঁকে জীবনের ধ্যানজ্ঞান তথা একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর দিকে যখন অগ্রসর হচ্ছি তখন তিনি অবশ্যই ব্যষ্টিগত সত্তা৷ কিন্তু তার সত্তাগত অস্তিত্বকে যখন শুধুমাত্র সৃষ্টির মূল উপাদান বলে ধরছি ও সেইভাবে তাঁকে পেতে চাইছি (দু’টি যেন পৃথক সত্তা), তখন তিনি নৈর্ব্যষ্টিক তত্ত্ব৷ এই জন্যেই আমি বললুম যে কান্টের ক্ষেত্রে তিনি হলেন বৈয়ষ্টিক ও নির্ব্যষ্টিকের মিশ্রিতরূপ৷
কিন্তু ভক্তির ক্ষেত্রে তিনি একান্ত ব্যষ্টিগত সত্তা৷ তিনি শুধুমাত্র আমার৷ তিনি আমার পরমপিতা, তিনি কোন দ্বিতীয় সত্তা নন, (আমার ও তাঁর মধ্যে কোন মূলগত পার্থক্য নেই)৷ নৈর্ব্যষ্টিক সত্তার সঙ্গে কোন রকম ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে না৷ সেই ধরনের সত্তাকে ভালবাসাই যায় না৷ ভালবাসার জন্যে দরকার হয় এক বৈয়ষ্টিক সত্তা৷
তাই ভক্তিভাবের ব্যাপারে সম্বন্ধটা যেহেতু সম্পূর্ণ ব্যষ্টিগত তাই সৃষ্টির ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে দার্শনিকের ও অন্যান্যদের ব্যাখ্যা থেকে পৃথক হবে৷ একজন দার্শনিককে এই সৃষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি উপযুক্ত উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না৷ দার্শনিক বলবেন---‘‘হয়তো এটা তাঁর ভাবনা হয়তো বা এটা তাঁর উদ্দেশ্য’’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ উত্তরটা হবে ভাসা ভাসা, সুনির্দিষ্ট কিছু নয়৷ আর একজন কর্মবাদীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারবেন না৷ তিনি বলবেন--‘‘এই বিশ্বে অনেক রকমের অভিব্যক্তি আছে৷ বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ, শব্দতরঙ্গ, রূপতন্মাত্র---এই সবের সামবায়িক রূপ এই বিশ্ব’’... ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু একজন আধ্যাত্মবাদীকে বা ভক্তকে এই উত্তর তার সন্তুষ্টি বিধান করতে পারে না৷ ভক্ত বলবে এর উত্তর খুব সোজা---‘‘সৃষ্টির পূর্বে আমার পরমপুরুষ এ মহাবিশ্বে সম্পূর্ণ একলা ছিলেন৷ পাঞ্চভৌতিক তত্ত্বের অভাবে তার অন্য কিছু দেখার বা করার ছিল না৷ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায়৷ ধর, তুমি একটি গ্রামের একটি ঘরে একদম একাকী আছ৷ তখন তোমার মানসিক অবস্থা কেমনধারা হবে বলতো? একটা অপ্রকৃতিস্থ মানুষ তথা উন্মাদের মতই হবে কিনা৷ তাই মহাবিশ্বে তিনি সম্পূর্ণ একা ছিলেন৷ ভাবতো তখন তার অবস্থা কি রকম ছিল? তাই একাকীত্বের এই দুঃসহ কষ্ট থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে তিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করলেন৷’’ এই হবে ভক্তের সোজাসাপটা জবাব৷
‘‘স বা এষ তদা দ্রষ্টা ন পশ্যদ্দৃশ্যমেকরাট্৷
মে নে সন্তমিবাত্মানং সুপ্তশক্তিরসুপ্তদৃক্৷৷
এই সৃষ্টি তার পারমার্থিক দেহের বিভিন্ন অংশ মাত্র৷ তাই আমি বলি এই জগতে কেউ পাপী নয়৷ সকলেই তাঁর প্রিয় সন্তান৷ তোমরা অতীতকে ভুলে যাও, আর নোতুনভাবে জীবন শুরু কর৷ এই মহত্তম ভাবনাকে সর্বদা স্মরণে রেখে চলবে---তুমি সেই পরমপুরুষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ (ফিয়েস, সুইজারল্যাণ্ড, ১১ই মে,১৯৭৯, সন্ধ্যা)