কাঁটাল

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি নাম-করা ফল৷ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘কণ্টকীফলম’ থেকে অর্থাৎ যে ফলের গায়ে কাঁটা আছে৷ ফল শব্দে ‘ল’ অন্তস্থ ল (lra)৷ তাই স্বাভাবিক নিয়মে ‘কাঁটাল’-এর ‘ল’ অন্তঃস্থ ‘ল’ ‘হওয়া’ উচিত কিন্তু আসলে তা নয়৷উত্তর ভারতের সব কয়টি ভাষাতেই একে আদি ‘ল’-এর মত উচ্চারণ করা হয়৷ তাই লেখবার সময় আদি ‘ল’(la) দিয়ে লেখাই সঙ্গত৷ যা সংস্কৃত তৎসম নয় ও যার উচ্চারণও আদি ‘ল’ (la)-এর মত তাকে জোর করে অন্তঃস্থ-‘ল’ (lra) ব্যবহার করতে যাৰ কেন? তবে অনেকে ভূল করে কাঁটালকে ‘কাঁঠাল’ লেখেন৷ ৰাংলা ভাষায় কিন্তু এই ভুল বানান ‘কাঁঠাল’ লেখার প্রথা অনেকদিনের ‘পুরোনো’ ৰাংলা হেঁয়ালিতে আছে---

‘‘কাঁসারির ‘সারি’ ছাড়া পাঁঠার ছাড়া ‘পা’৷

 লবঙ্গের ‘বঙ্গ’ ছাড়া কিনে আনগে তা৷৷’’

এখানে উত্তরটা হয়ে দাঁড়ায় ‘কাঁঠাল’৷ একটু আগে ৰললুম এই ৰানানটা ভূল৷ ‘কণ্টক’ শব্দ থেকে ‘কাঁটা’ শব্দ এসেছে৷ তাই ‘কাঠাল’-এ ‘ঠ’ আসৰে কোন সপ্ত লোকের সুদূর মহাকাশ থেকে? ‘কাঁটাল’কে অসমীয়া ভাষায় ৰলা হয় ‘কটাল’/‘কঠাল’, হিন্দীতে ‘কটল’৷ কাঁটাল ৰলতে কাঁচা ও পাকা (এঁচড় ও পাকা কাঁটাল) দুইকেই বোঝায় কিন্তু সংস্কৃত ‘পনস’ মানে পাকা কাঁটাল৷ ওড়িয়া, মারাঠী ও মধ্যপ্রদেশের কোন কোন অংশে কাঁটালকে পনস ৰলা হয়ে থাকে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪৭ প্রজাতির ‘কাঁটাল’ পাওয়া যায়৷

কাঁটাল ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না৷ কিন্তু গ্রীষ্ম প্রধান দেশে উর্বর জমিতে তো বটেই, কিছুটা অনুর্বর জমিতেও কাঁটাল ভালই জন্মায়৷ ত্রিপুরায় ও পশ্চিম রাঢের অধর্ব পার্বত্য ভূমিতে যেমন কাঁটাল প্রচুর জন্মায় তেমনি অসম, উত্তর বাঙলা, নদীয়া, বর্দ্ধমানের উর্বর সমতল ভূমিতেও কাঁটালের প্রাচুর্য৷ কাঁটাল মাটির বিচার ৰড় একটা করে না৷ কাঁটাল একটি পুষ্টিকর খাদ্য৷ তবে কিছুটা দুষ্পাচ্য৷ কাঁটালের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল এই যে ‘নাগলিঙ্গম’ গাছের মত কাঁটাল গাছেও শিকড়ে, কাণ্ডে, শাখায়, উপশাখায় ফলন ধরে৷ প্রাচীন অষ্ট্রিক বাঙলায় ৰড় ফুলকে ৰলা হত ‘মোচা’ (কলার ফুল ৰড়, তাই তাকে মোচা ৰলা হয়) আর ছোট ফুলকে ৰলা হত ‘মুচি’৷ নারকোলের ফুলের মত কাঁটাল ফুলকেও বাঙলায় মুচি ৰলা হয়৷ কাঁচা কাঁটাল (যাকে ৰাঙলায় এঁচড় ৰলা হয়) গুণগত বিচারে মাংসের সমান, অথচ মাংসের তামসিক দোষ এতে নেই৷ ৰাঙলার অনেক মানুষ তাই কাঁচা কাঁটালকে গাছপাঁঠা ৰলে থাকেন৷

কাঁটাল গাছ আঁৰগাছের তুলনায় কিছুটা ছোট হয়৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সকল দেশেই প্রচুর পরিমাণে কাঁটাল জন্মায় ও তা জন্মায় বিভিন্ন প্রজাতির৷ মালয় বর্গীয় ভাষাগুলিতে ও ফিলিপিনসএ কাঁটালকে ‘লঙ্কা’ ৰলা হয়৷ লঙ্কার অজস্র গুণের কথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ লোকই জানেন৷ একটু চেষ্টা করলে কাঁটাল থেকে উন্নতমানের এ্যালকোহল পাওয়া যেতে পারে যা ঔষধ-শিল্পে কাজে লাগবে৷ কাঁটালের বীজ আলুর চেয়েও অনেক বেশী পুষ্টিকর ও সুস্বাদু৷ ভারতে আলু আসবার আগে পর্যন্ত ভারতের মানুষ কাঁটাল বীজকেই মুখ্য তরকারী রূপে ব্যবহার করত৷ এখনও খাদ্য হিসেবে কাঁটাল বীজের ব্যবহার আছে৷ সাধারণ ইংরেজীতে কাঁটালকে ৰলা হয় ‘জ্যাকফ্রুট’৷

কাঁটাল সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্ত কিন্তু ভিন্ন গোত্রীয় গাছ হচ্ছে ‘রুটিফলন’ যার সংস্কৃত নাম ‘পনসিকা’৷ এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফল৷ তবে শ্রীলঙ্কা ও কেরলেও যথেষ্ট পরিমাণে জন্মায়৷ এই রুটিফল ও পনসিকাও কাঁচায় এঁচড়ের মত তরকারী রেঁধে ও পাকায় ফলন হিসেবে খাওয়া হয়৷ রুটিফল কাঁটালের চেয়ে বেশী পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হলেও পাকা অবস্থায় ফলটি অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত৷ তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকেরা মজা করে ৰলে থাকেন যে নাক ৰন্ধ করে যদি ‘রুটিফল’ খাই মনে হবে স্বর্গে আছি আর নাক খুলে যদি রুটিফল খাই মনে হবে নরকের মাঝখানটিতে বসে আছি৷ রুটিফলকে ইংরেজীতে ‘ব্রেডফ্রুট’ ৰলা হয়৷

ভারতে মোটামুটি বিচারে খাজা (যার কোয়াগুলি কিছুটা ঝরঝরে), নেয়ো বা গলা (যার কোয়াগুলি নরম ও অত্যন্ত রসযুক্ত), মিশেল (যা আংশিক খাজা, আংশিক নেয়ো), পদ্মরাজ, লাল কাঁটাল, বারমেসে কাঁটাল, শীতের কাঁটাল, ধুমো কাঁটাল প্রভৃতি অনেকগুলি শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়৷ গুণগত বিচারে মোটমুটিভাবে সব কাঁটালই প্রায় এক৷ রুটিফলের পাতার সঙ্গে কাঁটালের পাতার লেশমাত্র মিল নেই৷ রুটিফলের পাতা অতি ৰৃহৎ ও দেখতে কতকটা রেড়ির পাতার মত৷ ক্ষণার বচনে ৰলা হয়েছে---

‘‘আঘনে যদি না হয় বৃষ্টি৷

তবে না হয় কাঁটালের সৃষ্টি৷৷’’

কথাটা হয়তো ক্ষণার সময়ে ঠিকই ছিল৷ কিন্তু আজকাল অগ্রাণে বৃষ্টি হোক বা না হোক, কাঁটাল ঠিক ফলে৷ একটু আগেই ৰলছিলুম যে কাঁটাল গাছ আঁৰগাছের চেয়ে কিছুটা ছোট হয়৷ ৰাংলা মাপের এক বিঘা (ৰাঙলায় তিন বিঘা সাড়ে পাঁচ কাঠায় এক একর) জমিতে যেখানে ১৬টি ৰড় জাতের আঁৰগাছ লাগানো যায় সেখানে কাঁটাল লাগানো যায় ১৮টির মত৷ তবে হ্যাঁ, মেঘলন্ঠন প্রজাতির আঁৰগাছ ২০টির মতও লাগানো যেতে পারে৷