মানুষ, প্রকৃতি ও ঔষধ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ভেষজ প্রলেপ

কিন্তু মানুষের ও জীবের ঔষধের সন্ধান এই উপবাস, সূর্য্যালোক, জল, বায়ু বা মৃত্তিকাতে সীমিত থাকেনি৷ প্রাথমিক স্তরে মানুষ যে ঔষধের আবিষ্কার করেছিল তা ছিল বিভিন্ন গাছ–গাছড়া ও তাদের ছাল–মূলের বহিঃপ্রয়োগ৷ সেকালের মানুষ ওই সক্ষ জিনিসকে দাঁতে চিক্ষিয়ে রোগাক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিত বা ঘষত৷ এই প্রলেপ ছিল মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম ঔষধ৷

ভেষজ দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ প্রয়োগ ঃ এই প্রলেপ যেখানে বাইরে কাজ করত না, তখন তাকে শরীরের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার দরকার হ’ত৷ মানুষ তা চর্বন করে বা গলাধঃকরণ করে ঔষধরূপে ব্যবহার করত৷ এটাই ছিল মানুষের ইতিহাসে ঔষধ ব্যবহারের দ্বিতীয় চরণ৷

বটিকা

এমন অনেক ঔষধ ছিল যা বিশেষ বিশেষ ঋতুতে পাওয়া যেত–বার মাস লভ্য ছিল না৷ সেইগুলিকে মানুষ নির্দিষ্ট ঋতুতে যথারীতি সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখত৷ কোথাও বা সেগুলিকে জলের সহযোগে ক্ষটিকা রূপে রক্ষা করত, কোথাও বা সাধারণ ভাবে শুকিয়ে রেখে দিত৷ এই ক্ষটিকা বা ত্ব্প্তন্দ্বব্ধ বা হ্মন্প্তপ্ত রূপে সংরক্ষিত ঔষধ ছিল মানুষের জীবনে ঔষধ ব্যবহারের আরও পরেরকার স্তর৷

মলম

যেখানে ঔষধ কেবল বাহ্যিক প্রলেপেও কাজ দেয় না, চামড়ার ওপরে বা স্নায়ুর ওপরে ঘর্ষণের প্রয়োজন হয়, চামড়ার ছিদ্রের ভিতর দিয়ে শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানোর দরকার পড়ে, সেই মর্দনীয় ঔষধ মানুষ আবিষ্কার করেছিল আরও কিছু পরে৷ এই ম্যাসাজ বা মালিশ আরও পরেরকার আবিষ্কৃত ঔষধ৷

তরল ঔষধ ঃ যেখানে মর্দনীয় ঔষধে বিষক্রিয়া আছে সেগুলিকে বাইরে ব্যবহার করা ছাড়া উপায় ছিল না৷ কিন্তু যেগুলির বিষক্রিয়া নেই সেইগুলিকে মানুষ তরল করে জল বা অন্যান্য তরল বস্তু সহযোগে তরল ঔষধরূপে ব্যবহার করতে শিখল৷

অবলেহ

যে সকল মর্দনীয় ঔষধ শরীরের অভ্যন্তরে গ্রহণ করলে অল্পমাত্রায় হলে বিষক্রিয়া হয় না, কিন্তু অধিক মাত্রায় গ্রহণ করলে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেগুলি যাতে স্নায়ুতন্তুর সাহায্যে যথাযথভাবে কাজ করতে পারে তাই সেগুলিকে মানুষ চেটে বা লেহন করে ব্যবহার করতে শিখল৷ এই ঔষধগুলিকে অনেকক্ষণ ধরে জিবে চেটে তারপর গলাধঃকরণ করত৷ অল্প পরিমাণ হওয়ায় এতে কোন দোষ থাকে না, বরং গুণটা ষোল আনাই পাওয়া যায়৷ এই জাতীয় ঔষধকে ‘অবলেহ’ ক্ষলা হয়৷

অনুপান

মানুষ এমনও কিছু ঔষধ আবিষ্কার করল যা বিশেষ বিশেষ বস্তুর সহযোগে বিশেষ বিশেষ প্রকারের গুণসম্পন্ন হয়ে উঠত৷ অর্থাৎ একই ঔষধ ‘ক’ নামক বস্তুর সহযোগে হয়ে উঠল শিরঃপীড়ার ঔষধ, ‘খ’ নামক বস্তুর সহযোগে হ’ল উদরাময়ের ঔষধ, ‘গ’ নামক বস্তুর সহযোগে হ’ল শ্বাসরোগের ঔষধ৷ সেক্ষেত্রে ওই ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ নামধেয় বস্তুগুলিকে মানুষ নাম দিল ‘অনুপান’ অর্থাৎ অনুপানভেদে একই বস্তুতে বিভিন্ন ঔষধীয় গুণ যে রয়েছে তা আবিষ্কার করে ঔষধ রূপে মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করে দিল৷

আসব

মানুষ অভিজ্ঞতায় দেখল যে কোন কোন রোগে রোগীর প্রাণশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে৷ সে অবস্থায় ঔষধের সঙ্গে কিছুটা সুরাসারীয় গুণ থাকলে তবেই তা কার্যকর হয়৷ তখন মানুষ ওই সকল ঔষধ প্রস্তুতের সময় সেগুলোকে গেঁজিয়ে নিয়ে তারপর তাকে ঔষধের নানা রূপ দিতে থাকত৷ এই ধরণের গেঁজিয়ে তৈরী করা ঔষধকে ক্ষলে ঔষধীয় ‘আসব’ (‘আসব’ মানে সুরাসার বা এ্যালকোহল, যেমন দ্রাক্ষাসব)৷

অরিষ্ট

যে ক্ষেত্রে মানুষ দেখল ঔষধে সুরাসারীয় গুণের প্রয়োজন আছে কিন্তু সুরাসারীয় দোষ রাখলে ফল বিপরীত হবে, সেক্ষেত্রে তারা ঔষধকে আসবের পর্যায়ে না রেখে তাতে গুণগত কিছুটা ভিন্নতা এনে তাকে ব্যবহার করতে শুরু করল৷ এই ধরনের ঔষধকে তারা নাম দিল ঔষধীয় অরিষ্ট৷ যেমন দ্রাক্ষারিষ্ট, দশমূলারিষ্ট৷

ক্কাথ

কিছু ঔষধীয় গাছগাছড়ায় দেখা গেল যে সামগ্রিকভাবে গাছগাছড়াগুলি যতখানি ঔষধীয় গুণ ধারণে সমর্থ, তাদের জলে সেদ্ধ করে নিলে সেই সেদ্ধ–করা জলে সেই সকল গাছগাছড়ার যে নির্যাস বেরিয়ে আসে সেই নির্যাসের ঔষধীয় গুণ তার চেয়ে বেশী৷ এই নির্যাসকে ক্ষলা হয় ক্কাথ–যেমন খদিরের ক্কাথ (খয়েরের নির্যাস), অশ্বগন্ধার ক্কাথ ও বিভিন্ন ঔষধীয় গাছগাছড়ার ক্কাথ৷ এই ধরনের ক্কাথকে মানুষ ঔষধ রূপে ব্যবহার করতে শুরু করে দিল৷ বিভিন্ন ঔষধীয় গাছগাছড়াকে একত্রে সেদ্ধ করে যে ক্কাথ হয় তা ৰাংলায় সাধারণতঃ ‘পাঁচন’ নামেও পরিচিত৷

 

উৎস

(শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে গৃহীত)