শ্রীমদ্ভাগবত গীতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে ৰলেছিলুম,
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷’’
এখানে ‘যদা যদা’ কথার মানে কী? এখানে ‘যদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে যথোপযুক্ত কালে, ঠিক সময়ে৷ তোমরা জান যে প্রত্যেকটি কাজের জন্যে, প্রত্যেক কর্তব্যের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় থাকে, মাহেন্দ্রক্ষণ থাকে৷ সেটাই সেই বিশেষ কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে উপযুক্ত সময়৷ বিভিন্ন ধরণের ফল-ফসল লাগাবার জন্যে একটা বিশেষ সময় থাকে আবার পাকা ফসল ঘরে তোলবার জন্যেও একটা বিশেষ সময় থাকে৷ সেই বিশেষ সময়টাই বিশেষ ধরণের কাজের জন্যে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত সময় ৰলে গণ্য হয়৷
আলোচ্য শ্লোকটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘‘ভো ভারত, যদা যদা ধর্মস্য গ্লানিঃ ভবতি চ অধর্মস্য অভ্যুত্থানম্ ভবতি তদা অহম্ আত্মানং সৃজামি’’৷ যখনই ধর্মের পতন হয় আর অধর্মের শাসন বা রাজ্যপাট চলে সেই বিশেষ সময়ে বিশেষ মুহূর্তে আমি নিজেকে পুনরায় প্রকটিত করি৷
এখন এই যে উচিত ও সব চেয়ে উপযুক্ত সময় সেটা কখন? তোমরা জান যে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কোন শক্তি, কোন অভিব্যক্তি অথবা কোন বস্তুই সরলরৈখিক গতিতে এগিয়ে চলে না৷ এই গতিটা সর্বদাই স্পন্দমান (Pulsative) তথা সঙ্কোচ-বিকাশী Systalic) অর্থাৎ গতি ও বিরতি, গতি ও বিরতি এই ক্রমে এগিয়ে চলে৷ আমাদের বৈয়ষ্টিক ও সামুহিক গতির পর বিরতির অবস্থায় যাবতীয় আবিলতা- আবর্জনা, যাবতীয় সামাজিক আধি-ব্যাধি একত্রিত ও পুঞ্জীভূত হয়ে চলার গতিকে বিড়ম্বিত করে দেয়,অগ্রগতির গতিকে বিঘ্নিত করে দেয়৷
আমাদের সামাজিক জীবনেও এরকম ছোট ছোট গতি ও বিরতির পর্যায় আসে৷ সামূহিক জীবনে ৰহু দিন পর পর এমনকি হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বৎসর পরেও এরকম বিরতির অবস্থা আসে৷ যখন সাধারণভাবে সামূহিক জীবনে গতির বিরতির অবস্থা আসে,মহাপুরুষেরা, বড় বড় ব্যষ্টিত্বসম্পন্ন মানুষেরা এসে সেই বিরতির পর্যায়ে পুঞ্জীভূত আবর্জনাকে সরিয়ে দিয়ে সমাজদেহে ব্যাপক শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে থাকেন ও গতিহীন সমাজে পুনরায় গতির সঞ্চার করে থাকেন৷ এই মহান পুরুষদের উদ্দেশ্যে আমাদের দর্শনে (আনন্দমার্গ দর্শনে) ‘সদ্বিপ্র’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে৷ কিন্তু দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হবার পর এমন এমন বিরতির অবস্থা আসে যখন চতুর্দিক থেকে বিশাল পরিমাণ অপবিত্র জঞ্জাল স্তুপীকৃত হয়ে ওঠে৷ এমনকি সেই সব সদ্বিপ্রদের পক্ষেও সেই পর্বত প্রমাণ সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে৷ সেই সময় সেই সব মহান মানুষদের সাহায্যার্থে পরমপুরুষের পক্ষে কিছু করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে৷ এই শ্লোকটিতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে সমাজের অবস্থা যখন বদ্ধ পঙ্কিল জলাশয়ের মত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সেই সময়ে, সমাজকে উপযুক্ত পথপ্রদর্শনের জন্যে আমি আবির্ভূত হই৷ ,
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্ণানির্ভবতি ভারত’’৷ এখানে অর্জুনকে সম্বোধন করে কথাগুলো ৰলেছেন কৃষ্ণ৷ এখানে ‘ভারত’ শব্দের অর্থ অর্জুন৷ সংস্কৃতে ‘ভারত’ শব্দটি দুটি মূল ধাতু মিলিত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে--ভূ- ধাতু ও ‘তন’ ধাতু৷ ‘ভৃ’ ধাতুর অর্থ ভরণ-পোষণ করা৷ আর ‘তন’ ধাতুর অর্থ হ’ল বিস্তারিত করা, বিকশিত করা৷ ‘ভৃ’ ধাতুর উত্তর ‘অল্’ প্রত্যয় করে পাই ‘ভর’ শব্দ যার মানে হ’ল যে ভরণ-পোষণ করে৷ আর ‘তন্’ ধাতুর উত্তর ‘ড’ প্রত্যয় যোগে ‘ত’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়৷ ‘ত’ মানে বিস্তারিত বা বিকশিত করতে যে সহায়তা করে৷ সুতরাং ‘ভরত’ শব্দের অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে মানুষের ভরণ-পোষণ তথা সর্বাত্মক উন্নতিতে সহায়তা করে৷ ‘ভরত’ শব্দের উত্তর ‘অণ্’ প্রত্যয় যোগে পাই ‘ভারত’ শব্দ৷ ‘‘ভারত’’ শব্দের অর্থ ভরত সম্বন্ধিত বা রাজা৷
আমাদের এই দেশের নাম ‘ভারতবর্ষ’৷ সংস্কৃতে ‘বর্ষ’ শব্দের তিনটি অর্থ, বর্ষ মানে বর্ষা (rains), ২) ‘বর্ষ’ মানে বৎসর year, যেমন ১৯৯৬-৯৭ সাল, ৩) ‘বর্ষ’ মানে দেশ (country)৷ ভারতবর্ষ মানে এমন দেশ যা জনগণের ভরণ-পোষণ তথা সর্বাত্মক বিকাশে চরম সহায়তা করে৷ যে ভূখন্ডকে বিশেষভাবে চিহ্ণিত করা যায়, যার চারিদিকের সীমানা নির্দেশ করা যায় তাকে বলে বর্ষ৷ এখানে ‘ভারত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাজা৷ অর্জুন ছিলেন রাজবংশজাত ও সেই সঙ্গে তৎকালীন ভারতবর্ষের জনগণের ভরণ-পোষণ তথা সর্বাত্মক বিকাশমূলক কাজে সহায়তা করা ছিল যার কর্তব্য৷ তাই জন-প্রতিনিধি অর্জুনকে সম্বোধন করতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘ভারত’ শব্দ প্রয়োগ করেছেন৷ তিনি বলছেন, যখনই ধর্মের অধোগতি দেখা দেয় ও অধর্মের প্রাধান্য দেখা দেয় সেই পরিস্থিতিতে ব্যষ্টিত্বসম্পন্ন সদ্বিপ্রও প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবিলায় অসমর্থ হয়ে পড়ে৷ সেইরকম পরিস্থিতিতে আমার আবির্ভাব ছাড়া গত্যন্তর থাকে না৷ তাই ৰলছেন ‘‘তদাত্মানম সৃজাম্যহম্’’৷
যেহেতু এখানে ৰলা হয়েছে, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত’---যখন ধর্মজগতে গ্লানি বা ধর্মহানি ঘটে, স্বভাবতই সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন, ধর্ম জিনিসটা কী? সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম অর্থে চারটি পর্যায়বাচক শব্দ রয়েছে---‘ধৃতি’, ‘ধরণম্’ ‘ধারণা’ ও ‘ধর্ম’৷ ‘ধৃ’ ধাতুর উত্তর ‘ক্তিন্’ প্রত্যয় করে ‘ধৃতি’ শব্দ নিষ্পন্ন৷ ধৃতি মানে যা কোন বস্তুকে ধারণ করে অর্থাৎ ধর্তা৷ তোমার সমস্ত শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়াগুলো ধর্মের দ্বারাই ধৃত তথা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে৷ এই অন্তর্নিহিত স্বভাব বা গুণের জন্যে পশুর ধর্ম ও মানুষের ধর্ম পৃথক পৃথক হয়ে থাকে৷ তাই প্রতিটি সত্তারই নিজের নিজের ধর্ম পালন করা উচিত৷ কোন পরিস্থিতিতেই মানুষ তথা জৈব বা অজৈব সত্তার নির্দিষ্ট ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়৷ (বাঙ্গালোর, ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯)