পণপ্রথা সামাজিক অবিচারের আরেকটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ ‘‘মানুষের সমাজ’’ পুস্তকটিতে বলেছি এই পণপ্রথার কারণ মুখ্যতঃ দু’টি–একটি অর্থনৈতিক ও অপরটি নারী–পুরুষের সংখ্যাগত তারতম্য৷ আর্থিক ব্যাপারে নারীর পুরুষ নির্ভরশীলতা কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অথবা দেশ বিশেষে পুরুষের নারী নির্ভরশীলতা কমে যাবার সাথে সাথে পণপ্রথার উগ্রতা থাকবে না বটে কিন্তু এই কার্যকে ত্বরান্বিত করবার জন্যে তরুণ–তরুণীদের মধ্যে উন্নত আদর্শবাদ প্রচারেরও প্রয়োজন রয়েছে৷ আমাদের ছেলেমেয়েরা চাল, ডাল, নুন, তেল বা গোরু, ছাগল নয় যে তাদের নিয়ে হাটবাজারে দর কষাকষি চলবে৷ (আজকের সমস্যা)
ণ্ণ ণ্ণ ণ্ণ
সামাজিক অবিচারের আরেকটা জ্বলন্ত উদাহরণ হ’ল পণপ্রথা৷ সভ্য সমাজের পক্ষে এটা সত্যিই একটা কলঙ্ক৷ এই ধরণের অবিচারের পেছনের কারণগুলো যদি তলিয়ে দেখা যায়, তাহলে স্পষ্টতঃ দুটো মুখ্য কারণ দেখা যাবে৷ প্রথমতঃ পণপ্রথার উদ্ভবের পেছনে রয়েছে নারী–পুরুষের আয়ের বৈষম্য ৷ কেরলের নায়ার ও ঈড়বা সম্প্রদায়ের মধ্যে মাতৃগত দায়াধিকার ব্যবস্থা প্রচলিত আর এই জন্যেই পুরুষেরা বিবাহে যৌতুক দাবী করেনা৷ অসমের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত৷ ব্রহ্মদেশে যদিও পিতৃগত কুলব্যবস্থার প্রচলন আছে, তথাপি সে দেশের মেয়েরা আর্থিক ব্যাপারে স্বাধীন, তাই সেখানে পুরুষরাই মেয়েদের পণ দিয়ে বিয়ে করে৷
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সমাজে নারী–পুরুষের সংখ্যাগত তারতম্য৷ যদি পুরুষের সংখ্যা বেশী হয় তাহলে নারীরা যৌতুক পাবে আবার নারীর সংখ্যা বেশী হলে পুরুষরা যৌতুক পাবে৷ পঞ্জাবে তুলনামূলক ভাবে পুরুষের সংখ্যা বেশী৷ তাই সেখানে নারী যৌতুক পায়৷ মুসলমানদের মধ্যেও অবস্থা কতকটা অনুরূপ৷ আভিজাত্যের বৃথা অহমিকাও পণপ্রথার অন্যতম কারণ৷ তথাকথিত অভিজাত পরিবারগুলো ভারতে থাকে, আমাদের পরিবার সমাজের বনেদী পরিবার৷ আমাদের তাই মোটা পণ পাবার অধিকার আছে৷ সমাজে প্রাউটের ভাবধারার প্রচার–প্রসার ঘটলে পণপ্রথার অবশ্যই বিলোপ ঘটবে৷
মানুষের মনে কোন ধারণা যখন এমনই বদ্ধমূল হয়ে যায় যে তারা আর সে বিষয়ে কোন প্রকার আলোচনা বা যুক্তিতর্কের ধার ধারে না, সেটাকে বলে গোঁড়ামি৷ বলা হয়ে থাকে রেলিজন বা ধর্মমত জিনিসটা হচ্ছে বিশ্বাসের বস্তু–তাতে যুক্তিতর্কের অবকাশ নেই৷ আমাদের ভারতে এই রকম বহু সংখ্যক ধর্মোন্মাদ লোক রয়েছে৷ অতীতে এই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার দরুণ অসংখ্য সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে গেছে৷ সামান্য একগাছি চুলের জন্যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে–জিনিসটা ভাবতে কত খারাপ লাগে৷ এই ধর্মোন্মাদনা অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে গ্রাহ্যই করেনা, তাছাড়া তারা অন্যের কথায় কর্ণপাত করাকে পাপ বলে মনে করে৷ এক অর্থে তারা পশুর চেয়েও অধম কারণ পশুরা কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পোষণ করে না৷ এ ধরণের ধর্মীয় অভিব্যক্তিতে ভৌম ভাবপ্রবণতাই সুস্পষ্ট৷ মজ্হবী নাগপাশ থেকে মানুষের সরে থাকা উচিত৷ ধর্মীয় ভাবজড়তার পশ্চাতে জাগতিক ভাবনা–চিন্তাই মুখ্য৷ এক সম্প্রদায়ের লোকেরা ভাবে, গোমাংস ভক্ষণে মহাপাপ, তবে ছাগ মাংস, হরিণের মাংস চলতে পারে৷ ভারতীয় হিন্দু রমণীদের সিঁথিতে সিঁদুর ব্যবহার করার রীতি ধর্মীয় ভাবপ্রবণতার অভিব্যক্তি৷ অন্য দেশের মহিলারা এ প্রথা অনুসরণ করেন না৷ ভারতীয় নারীরা যদি এই সিন্দুর ব্যবহার বন্ধ করেন তাতে কিছুই যায় আসে না৷ মানুষের ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে প্রায় সকল রেলিজনই মানুষকে শোষণ করে৷
* * * *
কুকুদ ঃ কুক্ উণ্ দা ড ঞ্চ কুকুদ৷ ‘কুকুদ বলতে বোঝায়, যে কোন কিছুকে তুলে নেয় ও তারপর তা’ দান করে৷ যোগারূূার্থে ‘কুকুদ’ মানে পৌরাণিক মত অনুযায়ী অনুষ্ঠিত বিবাহের সম্প্রদান–কর্ত্তা৷ প্রাচীনকালে বিবাহের নানা রীতি প্রচলিত ছিল–আজও আছে৷ শৈব, গান্ধর্ব, রাক্ষুসী প্রভৃতি নানান রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল–পিঁড়ির উপর সালঙ্কারা কন্যা উপবিষ্টা থাকবে৷ কন্যার অভিভাবক তাকে পিঁড়ি সহ ঊর্ধ্বে তুলে দান করবেন ও বিবাহার্থী তা’ গ্রহণ করবে৷ সম্প্রদান কর্ত্তাকে বলা হত ‘কুকুদ’ অর্থাৎ যিনি তুলে নিয়ে দান করলেন, আর যিনি দান গ্রহণ করলেন তাঁকে বলা হ’ত ‘কোক’ অর্থাৎ যিনি তোলা জিনিস গ্রহণ করলেন৷
এই সম্প্রদান–করা–বিবা আজও উচ্চবর্ণীয় মানুষের মধ্যে কিছুটা প্রচলিত আছে৷ এমন ব্যবস্থা নারীর পক্ষে সম্মানহানিকর৷ নারী কি চাল–ডাল–নুন–তেল যে তাকে তুলে নিয়ে অন্যের হস্তে সমর্পণ করলুম৷ নারী কি মুর্গী না ঢ্যাঁড়শ যে তাকে বস্তাবন্দী করে তুলে নিয়ে আর কাউকে বেচলুম বা দান করলুম? এ ব্যবস্থাটা নারীর পক্ষে অবমাননাকর তো বটেই, এতে মানুষ জাতির মর্যাদাও ভুলুণ্ঠিত হয়৷ মানবতা তথা নব্যমানবতাবাদের মৌল নীতিও এতে লঙিঘত হয়৷ বিশ্বের বিচারশীল মানুষের কাছে আমার অনুরোধ তাঁরা যেন জিনিসটা ভাল করে ভেবে দেখেন ও এই কদর্য প্রথা যাতে রহিত হয় তার জন্যে সচেষ্ট হন৷ আমি তো বলব, মনু এই প্রথাকে সমর্থন করে ভাল কাজ করেন নি৷ ( ‘শব্দ–চয়নিকা’)