(মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর শব্দ চয়নিকা–২৬ খণ্ড গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে ‘নারীর মর্যাদা’ বিষয়ক অনেক কিছুই বলেছেন৷ ওই গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ সংকলিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ –সম্পাদক)
সুপ্রাচীনকালে যখন পৃথিবীর সর্বত্র মাতৃগত কুল–ব্যবস্থা ছিল, ছিল মাতৃগত দায়াধিকার ব্যবস্থাও, সেই সময় মানুষ মাতার পরিচয়ে নিজের পরিচয় দিত৷ পিতৃপরিচয় অনেকেরই থাকত না৷ যাদের থাকত, সেটাও খুব গৌণ জিনিস বলে গণ্য করা হ’ত৷ সেই সময়কার মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে মাতা–মাতামহীর নামে নিজের পরিচয় দিত৷ কারও মাতা বা মাতামহী সদ্বংশজাতা, শিক্ষিতা ও প্রশংসনীয় স্বভাবের হলে লোকে তাঁর কথা বলতে গৌরব বোধ করত৷ (‘‘কৌঞ্জ’’, শব্দচয়নিকা’, ‘৯ম পর্ব)
গৃহকন্যা ঃ কন্ যৎ টা৷ ‘কন্’ ধাতুর একটি অর্থ হ’ল আদরের ছোট জিনিস৷ ‘কন্যা’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হ’ল আদরের ছোট মানুষটি৷ সে যুগে সমাজে মেয়ের ছিল দারুণ আদর৷ লোকে নিজের মেয়ের গৌরবে আদিখ্যেতা করে বেড়াত৷ মেয়েকে সব সময় সাজিয়ে–গুজিয়ে ভালমন্দ খাইয়ে রাখত, ভাবত ক’দিনই বা আমাদের সংসারে থাকবে৷ আবার তো পরের ঘরে চলে যাবে৷ প্রাক্–মাহাভারতীয় যুগে মেয়ের বিয়ে দেওয়া তেমন কোন বোঝা ছিল না৷ তাই মেয়ের জন্যে আদর একটুও টোল খেত না৷
(‘‘গৃহকন্যা’’, ‘শব্দচয়নিকা’, ২৬শ খণ্ড)
বৌদ্ধতন্ত্রে বজ্রযানে প্রথমে ভাবকলা উদ্ভূত হয়েছিল যে নারীর প্রাথমিক পরিচয় তার ভগিনীত্বে নয়, তার বধূত্বে নয়, তার দুহিতৃত্বে নয়–তার মাতৃকা রূপে৷ এর কারণস্বরূপ বজ্রযানী তান্ত্রিকেরা বলতেন, শিশু তার জন্মের পরক্ষণেই প্রথমে যে নারীকে দেখে সে নারীকে সে ভগিনী হিসেবে দেখেনা, বধূ হিসেবেও দেখে না, দুহিতারূপেও দেখে না–দেখে মাতৃরূপে৷ তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেয়স্কৃতিতে সেই নারীর প্রাথমিক পরিচয় হ’ল সে মাতা.... নারীর শেষ পরিচয়ও হ’ল সে মাতা, কারণ শিশুর কাছে প্রথমে সে মাতৃরূপে আবির্ভূত হয় আর জীবনে পূর্ণত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে মাতৃরূপে সমাজে পরিচিতি গ্রহণ করে৷ বজ্রযানী তন্ত্র এই মূল ভাব বা মূল মন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এই বজ্রযান তন্ত্র বাঙলার মাটিতে এসেছিল আজ থেকে ১৭০০ বছর পূর্বে৷ সেদিনকার সেই বজ্রযানী–ভাবপ্রেষিত্ বাঙালী নারীমাত্রকেই মাতৃভাবে গ্রহণ করেছিল৷ বাংলায় ‘মেয়ে’ শব্দটি আসছে ‘মাতৃকা’ শব্দ থেকে (মাতৃকা ঞ্ছমাত্তিআঞ্ছমাইয়াঞ্ছ৷ তোমরা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে, পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে অনেক মানুষ আজও মেয়েকে ‘মাইয়া’ বলে থাকেন)৷ শুধু তা–ই নয়, সেকালের বজ্রযানী বাঙালী সমাজ ঠিক করেছিলেন–অন্য কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলে তাঁরা সকল নারীকেই মা বলে সম্বোধন করবেন–যেমন ঠাকুরমা, দিদিমা, কাকীমা, খুড়ীমা, জ্যেঠাইমা, পিসিমা, মাসিমা, বউমা প্রভৃতি৷ বাঙলার সামাজিকতা বা সামাজিক বিধিটা বজ্রযান বৌদ্ধসংশ্লিষ্ট৷ এটা ভাবতে অদ্ভূত লাগে, যে বজ্রযান কঠোর সাধনা মার্গের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাতে এই কোমল মাতৃভাব এল কি করে! এই সেই বজ্রযান যে বলেছে–‘‘নরাঃ বজ্রধরাকারাঃ যোষিতা বজ্রযোষিতা’’৷
এই বজ্রযান তান্ত্রিকতা–প্রেষিত বাঙলার মানুষ যেমন সেকালের রাজপত্নীকে বলত রাণী–মা, গুরুপত্নীকে বলত গুরু–মা, পু–বধূকে বলত বধূমাতা বা বউ–মা, তেমনি সেকালের বজ্রযানী সমাজ মিত্রপত্নীকেও ‘মা’ বলে সম্বোধন করত৷ পত্নীমাতাকে অর্থাৎ শ্বাশুড়ীকে তো এখনও মা বলা হয়৷ নিজের মাকে তো মা বলবেই৷ যে দেশের অন্ন–জলে, রূপে, রসে, প্রাণপ্রবাহে, পয়োধারায় সে পুষ্ট সে দেশকে সে যদি মা বলে সম্বোধন করে তাতে কোন বৈয়াকরণিক ত্রুটি হয়না, ইতিহাস অশুচি হয় না, মহাভারতও অশুদ্ধ হয় না৷ নিজের মেয়েকেও তো স্নেহসিক্ত পিতা কোলে নিয়ে মা বলেই আদর করেন অথচ সবাই জানে ওই ছোট খুকুটি তাঁর মা নয়–তাঁর দুহিতা৷ যদি কোন জীবের পয়োপানে কেউ পুষ্ট হয় তবে সেই জীবকে মা বলে সম্বোধন করাতে এমন কি দোষ হয়! তাহলে কি সেই জীবটি তার মা হয়ে গেল! তাকে মায়ের সম্মান দেওয়া হচ্ছে এই মাত্র৷ তবে হ্যাঁ, কেবল গোরুর দুধই মানুষ খায় না–উট, ছাগল, মোষের দুধও মানুষ খায়৷ সম্মান দিতে গেলে তাই উষ্ট্রী, ছাগলী বা মহিষীকেও সম্মান দিতে হয়৷ তবে গো–মাতাকে নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি বা আদিখ্যেতা করাটা ভাল নয়, কারণ তা হাসির খোরাক যোগাবে, আর যদি কেউ মনে করেন গো–মাতাকে তেল, সিঁদুর দিয়ে পূজো করব আর মহিষ–মাতাকে হত্যা করে তার রক্তে স্নান করে উৎসবে মাতব, তবে তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করছেন৷ তাঁদের মনোভাব সমর্থনযোগ্যও নয়৷ (‘‘কৌমার’’, ‘শব্দচয়নিকা, ৯ম পর্ব)