‘‘আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে
দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে৷’’
পৌরাণিক কথানুযায়ী আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে বাংলায় সগর নামে এক রাজা ছিলেন৷ আজ যাকে বাংলার বদ্বীপ বলি অর্থাৎ ইংরেজ আমলের মুর্শিদাবাদের পূর্বাংশ (পশ্চিমাংশ রাঢ়), নদীয়া (বর্ত্তমান কুষ্ঠিয়া সহ), যশোর (বর্ত্তমান বনগ্রাম সমেত), ২৪ পরগণা, খুলনা, ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলা নিয়ে হচ্ছে বাংলার বদ্বীপ বা ডেলটা (স্তুন্দ্বপ্তব্ধ্ত্র) বা বাগড়ি বা সমতট৷ এই সমতটের রাজা সগর ছিলেন বিরাট এক প্রভাবশালী রাজা৷ বঙ্গোপসাগরে ছিল তাঁর এক বিরাট নৌবাহিনী৷ বঙ্গোপসাগরে সর্বজনস্বীকৃত তাঁর প্রতিপত্তির দরুণ, সগর কর্ত্তৃক অধিকৃত এই অর্থে সগরূষ্ণ করে ‘সাগর’–যার মানে হচ্ছে সগর রাজার দ্বারা শাসিত জলাশয়৷ সগর রাজার পূর্বে বাংলায় পশ্চিম দেশ থেকে আগত ও উত্তর ভারতীয় আর্যদের কোন প্রভাব ছিল না৷ বাংলা ভাষায় বৈদিক ভাষার কোন প্রভাবই ছিলনা–মূলতঃ অষ্ট্রিক, কিছুটা মঙ্গোলীয় প্রভাবযুক্ত বাংলার ভাষা ছিল সংস্কৃত৷ এই সংস্কৃতের জন্ম হয়েছিল রাঢ়ে৷
সমতট যখন সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত হয়েছিল সেই প্রাচীন যুগে জঙ্গলাকীর্ণ নবসৃষ্ট সমতট (বাগুড়ি ঃ মঙ্গোলীয় ‘বাগুড়ি’ শব্দের অর্থ হল জলোত্থিত ছোট ছোট দ্বীপ৷ এই ‘বাগুড়ি’ শব্দ থেকে বাংলায় ‘বাগড়ি’ শব্দ এসেছে৷ প্রাচীন বাংলায় ‘গুড়ি’ বা ‘গুলি’ মানে সমূহ৷ যেমন ‘‘ছেলেগুলি খেলছে অনেকগুলি ময়নাপাখী রয়েছে ইত্যর্থে ময়নাগুড়ি৷ এই বাগুড়ি বা বাগড়িকে রাঢ়ীয় সংস্কৃতে নাম দেওয়া হয় সমতট)৷ বলা বাহুল্য মাত্র, অষ্ট্রিক ভাষা ও সেই সময়কার মঙ্গোলীয় তদ্ভব বাংলা ছিল বাংলার নিজস্ব ভাষা৷ বৈদিকের মত এরা বহিরাগত ছিল না৷ যাই হোক, বাংলার ইতিহাসের আদিম যুগের এই সগর রাজাই প্রথম আর্য প্রভাবকে প্রতিহত করেছিলেন যেমন পরবর্ত্তীকালে এই প্রভাবকে প্রতিহত করেছিলেন রাঢ়ের রাজা শশাঙ্ক৷
রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী রামের পূর্বপুরুষ রঘুর সঙ্গে সগর রাজার তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল৷
‘‘আমাদেরই সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে,
দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে৷’’
আর্যরা বাংলার মাটিতে শিকড় গাড়তে পারেনি৷ রাঢ় পেরিয়ে তাঁরা আর সমতটে আসতে পারেনি৷ রাঢ় ছিল তাদের কাছে দুর্ভেদ্য দুর্গসদৃশ৷ এইজন্যে ভয়ে তারা রাঢ়কে নাম দিয়েছিল বর্জ্যভূমি বা বীরিত ভূমি৷ অনুমিত হয় এই বর্জ্যভূমি বা বীরিতভূমি থেকে ‘বীরভূম’ নাম এসেছিল৷ অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও আছে৷ এই সগর রাজার সেনাবাহিনীতে ছিলেন মুখ্যতঃ অষ্ট্রিক বর্গীয় যোদ্ধারা৷ এক্ষেত্রে স্মর্ত্তব্য এই যে বাংলার মানুষ অষ্ট্রিকো–মঙ্গলো–নিগ্র্ গোষ্ঠীভুক্ত৷ লড়াই করেছিল মুখ্যতঃ অষ্ট্রিক প্রভাবযুক্ত বঙ্গরক্তধারী শ্যামবর্ণ তরুণ–তরুণীরা৷ পরবর্ত্তীকালে আর্য প্রভাবে যাদের হাঁড়ি, ডোম, বাউরী, কোঁড়া, মুণ্ডা, খেড়িয়া, মালপাহাড়ী প্রভৃতি নামে কিছুটা অবজ্ঞা করা হত.....ভ্রুকুটি দেখানো হত৷ এদের মধ্যে কোলেরা ছিল যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ৷ এই কোলেরা আর্যদের কিছুটা সমীহ করে চলত৷ রাজা সগর কোলেদের বাংলার সেনাবাহিনীতে ক্ষত্রিয়শক্তিরূপে স্বীকার করতে অস্বীকৃত হন....এতে কোলেদের সামূহিক পাতিত্য ঘটে৷ রাঢ়ের কোথাও কোথাও (যেমন বর্দ্ধমানে) এই কোলেদের উত্তরপুরুষেরা ‘কোঁড়া’ নামে পরিচিত৷
আজও বাংলার মানুষ গঙ্গাসাগরতটের জন্যে ‘সাগর’ শব্দ ব্যবহার করেন৷ ‘‘এই সাগুড়িটা সাগরে গিয়ে কিনেছি৷’’ –সাগুড়ি হচ্ছে গঙ্গাসাগরে লব্ধ এক ধরণের কাংস্যপাত্র৷ শাদা রঙের মধ্যম–দীর্ঘ মাঝারি–ঝাল এক রকমের লঙ্কা যা গঙ্গাসাগর এলাকায় নোনা মাটিতে জন্মায় তাকে সাগুড়ি লঙ্কা বলা হয়৷ বাংলার সাধারণ মানুষ ‘সমুদ্র’ শব্দটির ব্যবহার কমই করেন–করেন ‘সাগর’ শব্দটির ব্যবহার৷ শব্দটি লৌকিক সংস্কৃত–বৈদিক নয়৷ ‘সগর’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে যিনি সব কিছু গ্রাস করার সামর্থ্য রাখেন৷
‘দুলিক’ / কচ্ছপ
প্রাচীন বাংলার সৈনিকদের একাংশ এই রণপায়ে চড়ে লড়াই করত৷ তাদের পরিধানে থাকত হাঁটুর ওপরে মালকোঁচা করে পরা একটা ধুতি, গায়ে ছোট আকারের ফতুয়া যাতে কাপড়ের বোতাম লাগানো থাকত, মাথায় বাঁধা থাকত বড় আকারের অর্থাৎ প্রমাণ সাইজের একটা গামছা যে গামছা তারা যুদ্ধকালে স্নানের সময়ও ব্যবহার করত, কোমরে বাঁধা থাকত লম্বা সাইজের হালকা খাঁড়া বা দাও বা রামদাও, সামনে পেছনে বাঁধা থাকত ঢ়াল৷ ঢ়ালগুলি তৈরী হত সাধারণতঃ বড় আকারের কচ্ছপের খোলাকে পাতলা লোহার আবরণীতে মুড়ে৷ সংস্কৃতে ‘দুলিক’ মানে কচ্ছপ৷ এই ‘দুলিক’ প্রাচীন বাংলায় হয়ে গেল ‘দুলি’৷ বাংলার যে সকল স্থান থেকে বড় বড় আকারের কচ্ছপ পাওয়া যেত সেই স্থানগুলিকে সেকালের বাংলায় বলা হত আনিদুলিয়া বা আন্দুলিয়া বা আন্দুল৷ তোমরা খোঁজ নিয়ে দেখবে বাংলার অনেক অংশেই এই আন্দুল, আন্দুুলিয়া নামে গ্রাম আছে৷ আর সেই গ্রামটি কোন না কোন জীবন্ত বা মরা নদীর নিকট অবস্থিত৷
যাই হোক সেকালকার বাংলার পদাতিক সৈন্যদের এই ছিল সাজসজ্জা৷ আমি ছোটবেলায় গল্প শুণেছি, বর্দ্ধমান জেলার নিকটবর্ত্তী গ্রামের ডাকাতেরা এই রণপায়ে চড়ে পূর্বদিকে কলকাতার উপকণ্ঠ ও পশ্চিম দিকে রাণীগঞ্জ আসানসোল পর্যন্ত ডাকাতি করতে যেত৷ এই রণপা (রণে ব্যবহূত বিশেষ ধরণের পা)–এরও একটি ভাল নাম হচ্ছে ‘কোদণ্ড’৷ (শব্দ চয়নিকা)