ভারতের ইতিহাসে মদালসা এক মহান চরিত্র৷ তিনি তার পুত্রের জন্যে দু’টি উপদেশ রেখে গিয়েছিলেন৷ প্রথম উপদেশ ছিল---জীবনে সব রকম সঙ্গই পরিত্যাগ করবে৷ যদি একান্তই তা না পার, তবে সৎসঙ্গ করবে৷ দ্বিতীয়টা ছিল---জীবনে সর্বপ্রকার কামনা বাসনাই ত্যাগ করবে৷ যদি একাস্তই তা না পার, তবে কেবল মোক্ষের বাসনা রাখবে৷
হিন্দুশাস্ত্র তথা অন্যান্য শাস্ত্রেও এই ধরনের বাসনার সমর্থন আছে৷ পরমপুরুষের কাছে কোন জিনিস চাইতে নেই৷ মনে কোনপ্রকার বাসনা না রেখেই পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে যেতে হয়৷ যদি একান্তই কেউ তা না পারে, সেক্ষেত্রে পরমপুরুষের কাছে এই প্রার্থনাই করতে হয়, ‘‘হে পরমপুরুষ, তুমি কৃপা করে আমার বুদ্ধিকে শুভের পথে পরিচালিত করো---আমার বুদ্ধিকে শুভের সাথে সংযুক্ত করে দাও’’৷ গায়ত্রী মন্ত্রে এটাই বলা হয়েছে৷ এটা হ’ল ঋগ্বেদের ‘সবিতৃঋক’৷
‘‘ওঁং ভূ ভূবঃ স্বঃ ওঁং তৎসবিতুর্বরেণ্যম৷
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁম্’’৷৷
‘‘আমি পরমপুরুষের দিব্যজ্যোতির ধ্যান করি যাতে তিনি আমার বুদ্ধিকে, আমার মেধাকে সৎপথে পরিচালনা করেন৷’’ পরমপুরুষ সব কিছুর নিয়ন্তা, তিনি চাইলে অনায়াসেই আমাদের বুদ্ধিকে কল্যাণের পথে পরিচালনা করতে পারেন৷ মনের মধ্যে এই ধরনের আশা রেখেই এই প্রকার প্রার্থনা করা হয়েছে৷
বরেণ্যম্-পূজনীয়ং ভর্গঃ-জ্যোতি ধীমহি -বয়ম্ ধ্যানম্ কুর্ম্ম, আমরা ধ্যান করি, নো, ধিয়ো-অস্মাকং ধিয়ঃ আমাদের বুদ্ধি, প্রচোদয়াৎ---সংবিধানং করোতু, সৎপথি পরিচালনং করোতু, সৎপথে পরিচালিত করুন অনেন কারণেন বয়ং ধ্যানং কুর্ম্মঃ, এই হেতু আমরা ধ্যান করি অর্থাৎ পরমপিতার দিব্যজোতির ধ্যান করি৷ আমি সেই পরমপুরুষের যিনি ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ আদি সমস্ত লোকের সবিতা (‘সবিতা’ মানে পিতা, স্রষ্টা)---সেই সবিতার দিব্য জ্যোতির ধ্যান করছি৷ কেন? - না, তিনি যখন সব কিছুর সবিতা, সব কিছুর পরিচালক, তিনিই যখন আমার এই ছোট্ট শরীরটার, ছোট্ট মনটার স্রষ্টা, তখন তিনি যদি কৃপা করেন, তাহলে আমার বুদ্ধিকে তিনি নিশ্চয়ই সৎপথে চালাতে পারবেন, তাই তার ধ্যান করছি আর বলছি, ‘ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’---আমাদের বুদ্ধিকে তুমি সৎপথে পরিচালিত করো, সৎপথে চালাও ৷ পরমপুরুষের কাছে চাইতে নেই কিছুই, কিন্তু যদি না চেয়ে থাকতে না পারা যায়, তাহলে একটা জিনিসই চাইতে হয়--- তা হ’ল ‘আমার বুদ্ধিটাকে ঠিক পথে চালাও’৷
মানুষের মধ্যে যত হানাহানি, যত হিংসা-সন্দেহ, সব কিছুর পিছনে রয়েছে ওই বুদ্ধির দোষ৷ বুদ্ধি সৎপথে চলছে না --- বুদ্ধি শুভের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই এই সমস্ত ব্যাপার হয়ে চলেছে৷ এখন মানুষের মনের পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ অবস্থার চাপ সৃষ্টি করে আমরা দুর্নীতি-পরায়ণ মানুষকে, শোষককে বা অন্যান্য সমাজবিরোধী শক্তিকে কতকটা সংযত করে রাখতে পারি কিন্তু তাতে স্থায়ী কাজ হয় না৷ আমাদের এই সামূহিক প্রচেষ্টা তো চলতেই থাকবে---অশেষভাবেই চলতে থাকবে৷
আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অশেষভাবে চলতে থাকবে মানুষের মধ্যে শুভ বুদ্ধি জাগানোর প্রয়াস যাতে মানুষ সৎপথে চলে, যাতে মানুষ তার বুদ্ধিটাকে শুভের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে৷ একটাতে কাজ হবে না, দু’টোই এক সাথে চলবে৷ একটা হ’ল সাময়িক বাবস্থা, আর অপরটা স্থায়ী৷ যারা পরমপুরুষের কাছে এই শুভ ৰুদ্ধির প্রার্থনা জানায় তাদের উন্নতি হবেই, উন্নতি হতেই হবে৷ কিন্তু যারা তা প্রার্থনা করে নি, এখনও করছে না বা করার চিন্তাও করছে না, তাদেরও প্রেরণা যোগাতে হবে যাতে করে মানুষ তাদের বুদ্ধিকে শুভের সাথে সংযুক্ত করে রাখে৷ এটাই সমাজধর্ম৷ আমরা যদি তা না করি, ৰুঝতে হবে সমাজধর্মে বিকৃতি এসেছে৷ তাই ধর্মপ্রচার সামাজিক কর্তব্য৷ সকলকেই এ বিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে৷ এটা কারুর একার দায়িত্ব নয়৷ সকল সৎ মানুষের এটা সামূহিক কর্তব্য৷ বেদের একটা শ্লোকে বলা হয়েছে
‘‘য একোহবর্র্ণে বহুধাশক্তিযোগাদ্
বর্ণাননেকান্ নিহিতার্র্থে দধাতি৷
বি চৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ স দেবঃ
স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনত্তুণ’’৷৷
যখন কিছুই ছিল না, যখন এই বর্ণময় বিশ্বের সৃষ্টি হয় নি, তখনও এই অবর্ণ সত্তা ছিলেন৷ তিনি আছেন ও ভবিষ্যতেও থাকবেন৷ তিনি তার বহুবিধ শক্তির দ্বারা এই বর্ণময় জগৎ সৃষ্টি করেছেন৷ সৃষ্টির আদিতে তিনি একক ছিলেন৷ সৃষ্টির অন্তেও তিনি একাই থাকবেন৷
আমরা পরমপুরুষের কাছে কী জন্যে চাইব? ব্যষ্টিগত ভাবে অথবা সমষ্টিগত ভাবে যার যা প্রয়োজন, তিনি তো আগে থেকেই তা’ জানেন৷ তিনি ওতোযোগে প্রতিটি ব্যষ্টির সাথে যুক্ত আছেন৷ তিনি সকলের মধ্যে থেকে’ সকলকে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন৷ মানুষ তার নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে যতটুকু জানে, পরমপুরুষ তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন৷ কাজেই যে সত্তা তোমার স্বার্থের কথা তোমার চেয়ে অনেক বেশী জানেন তার কাছে তুমি কী-ই বা চাইবে? তোমার চাইবার কিছু নেই৷ কারণ, তুমি নিজের জন্যে যতটা ভাব তিনি তোমার জন্যে তার চেয়ে বেশী ভাবেন৷ তুমি নিজেকে যতটা ৰোঝ তিনি তার চেয়ে অনেক বেশী ৰোঝেন৷
তথাপি যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে বলা উচিত, ‘স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনত্তুণ’ তিনি যেন আমাদের বুদ্ধিকে শুভের সঙ্গে সংযুক্ত রাখেন৷ কারণ, যে মুহূর্তে আমরা তাকে ভুলে যাই, আমরা তার থেকে দুরে সরে যাই, আমরা মানুষের শরীরে পশু হয়ে যাই, আর যে মুহূর্তে আমরা তার কথা ভাবি, মানুষের শরীরে অতিমানব হয়ে যাই৷ তাই তার কাছে এই প্রার্থনাই জানাই, কখনও যেন তাকে না ভুলি অর্থাৎ সব সময় শুভের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে চলি৷ তিনি যেন আমাদের মধ্যে ‘ধ্রবা স্মৃতি’ জাগিয়ে দেন৷ ‘স্মৃতি’ মানে মনে রাখা৷ ‘ধ্রুবা স্মৃতি’ মানে সব সময় মনে রাখা৷ সব সময়ের জন্য একটি জিনিসকেই মনে রাখতে হবে---সেই পরমপুরুষকে৷ তাতে হবে কী? আমাদের বুদ্ধি সব সময় শুভ ভাবনা নিয়ে থাকবে, সব সময়েই শুভের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকবে---এটাই মানুষের একমাত্র প্রার্থনা হওয়া উচিত৷ ১১নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা