প্রত্যেক বস্তুর নিজের নিজের ধর্ম আছে, নিজস্ব স্বাভাবিক লক্ষণ আছে৷ সেই লক্ষণ দেখেই মানুষ সংশ্লিষ্ট বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হয়, তার নামকরণ করে৷ প্রত্যেক সত্তার, প্রত্যেক জীবের নিজের নিজের ধর্মে অটুট থাকা শ্রেয়স্কর৷
সোণা ও লোহার নিজেদের পৃথক পৃথক ধর্ম আছে৷ ঠিক তেমনি মানুষেরও নিজের ধর্ম আছে৷ মানুষ যদি নিজের ধর্ম থেকে, মানব ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় তবে তাকে মানুষ বলব না৷ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার নিজের ধর্মেই নিহিত৷ তাই তার পক্ষে স্বধর্মে সুদৃঢ় থাকাই বাঞ্ছনীয়৷
মানুষ যদি দেখে যে পশুর মত জীবন যাপন করাতে তার লাভ বেশী, মানুষের মত বাঁচতে গিয়ে তাকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হচ্ছে, তবুও তাকে মানুষের মতই জীবন যাপন করতে হবে৷ কষ্ট হলেও মানবতাকে খুইয়ে বসলে চলবে না৷
এখানে স্ব–ধর্মের অর্থ মানব ধর্ম আর পর–ধর্মের অর্থ হ’ল যা মানব ধর্ম নয়৷ স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকে মৃত্যুবরণও শ্রেয়, কিন্তু পশুর ধর্ম মানুষের পক্ষে ভয়াবহ৷ মানুষ সব সময় মানব ধর্মে অটুট থাকবে–এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব৷ একথা ক্ষণিকের জন্যেও মানুষকে ভুললে চলবে না৷
শ্রীকৃষ্ণ এই কথাটাই বলেছেন যে মানুষ সর্বদাই মানবতায় প্রতিষ্ঠিত থাকুক, অধিষ্ঠিত থাকুক৷ এই মানবতার জন্যেই সে বাঁচুক আর এই মানবতার জন্যেই সে প্রয়োজন হলে মৃত্যুকেও বরণ করুক৷ এটাই মানুষের জীবনে সব চেয়ে বড় কথা৷ ধর্মের জন্যে মৃত্যুকে বরণ করাও বরং ভাল৷ সুখপ্রাপ্তির জন্যে পশু ধর্ম অর্থাৎ পরধর্ম গ্রহণ করা কোন প্রকারেই সমর্থনযোগ্য নয়৷
* * *
ধর্মের সম্বন্ধে বলা হয় যে ‘‘ধর্মঃ স ন যত্র ন সত্যমস্তি’’৷ ধর্ম সত্যের ওপর আধারিত, কুটিলতার ওপর আধারিত নয় সত্যতার ওপর আধারিত৷ সত্য কী? সত্যের একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে–‘পরহিতার্থং বাঙ্মনসো যথার্থত্বং সত্যম্’’৷ অন্যের হিতের জন্যে মন ও বাক্যের দ্বারা যা করা হবে, যা করতে থাকবে তাকেই সত্য বলব৷ এই যে ‘‘পরহিতার্থং বাঙ্মনসো যথার্থত্বং সত্যম্’’–এই ধরনের আচরণ কে করতে পারে এটাও দেখতে হবে যে সত্যের আর কোন তাৎপর্য আছে কিনা৷ ‘‘সদ্ভাবাৎ সত্যং’ অর্থাৎ পরমপুরুষের জন্যে যে সত্যিকারের প্রেম–পরমপুরুষের জন্যে যার হূদয়ে যথার্থ প্রেম রয়েছে, সে–ই প্রেমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তার দ্বারাই পরোপকার হতে পারে৷ নইলে পরোপকার হতে পারে না৷ মানুষ অনেক সময় পরহিতের নামে কপটাচারী (হিপোক্রাইট) হয়ে যায় বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম হয়ে যায়৷ বাইরে এক রকম ও ভেতরে অন্য রকম–একই মানুষের এই যে দুই রূপ এটা একটা মানসিক ব্যাধি, একটা বড় রকমের মানসিক রোগ৷ বাইরে এক রকমের আচরণ করতে থাকা ও মনে মনে অন্য রকম চিন্তা করা–এটা একটা রোগ৷ এই জন্যে যার মধ্যে পরমপুরুষের জন্যে সত্যিকারের ভালবাসা নেই, তার দ্বারা পরহিত হতে পারে না৷ বরং পরহিত করতে যাওয়া ভণ্ডামির নামান্তর৷ মানুষকে সত্যের পথে চলতে হবে, ভড়ং করলে চলবে না৷ তাই তোমরা মনে রাখবে–সত্যের পথ ধরে তোমরা অতীতে চলেছ, এখনও চলছো, ভবিষ্যতেও চলবে৷ এর জন্যে কত কষ্ট করতে হয়েছে, কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমরাই জয়যুক্ত হলে৷ আর পাপীদের অবস্থাটা হ’ল কেমন?–না, অন্ধকারের পাখী যেমন গর্তে সেঁদিয়ে যায় ওদের অবস্থাও ঠিক তেমনি৷ তোমরা সত্যের পথে রয়েছ, আর সত্যের পথেই চলতে থাকবে, তাই তোমাদেরই জয় হবে ও জয় হচ্ছেও৷ তাই সত্যের পথে থেক, ধর্মের পথে থেক, জয় তো তোমাদের পকেটে রয়েছে৷ জয়ের জন্যে চিন্তা করবার কোন কারণ নেই৷ জীবনের কোন অবস্থাতেই ঘাবড়ে যেও না৷ এর আগেও বাধা–বিপত্তি কত এসেছে তোমরা তাতে তো ঘাবড়াওনি৷ তাই আবার বলি, ভয় তোমাদের দেখে ঘাবড়ে যাবে৷ তোমরা ঘাবড়াবে না৷
* * *
যাঁরা সাধক, তাঁরা সেই ধর্মের পথটিই বেছে নেন৷ নিছক পণ্ডিতদের দ্বারা কিছু হবার নয়৷ তাঁদের দ্বারা কেবল সমস্যাই বাড়তে থাকে–সমস্যার সমাধন তাঁরা করতে পারবেন না৷ তোমরা প্র্যাকটিক্যাল (বৈবহারিক) মানুষ হও, নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা কর, ভাল ভাল কাজ কর আর পরমপুরুষকে আপন করে নাও৷ পরমপুরুষ যেন তোমাদের নিজের জিনিস হয়ে যান, তিনি যেন তোমাদের নিজস্ব সম্পদ হয়ে যান৷ পণ্ডিতের পরমপুরুষ পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকেন, সাধকের পরমপুরুষ হূদয়ে অধিষ্ঠিত থাকেন৷ পুস্তক দূরের জিনিস, হূদয় খুবই কাছের জিনিস, তাই পরমপুরুষকে আপনার হূদয়ে রাখ৷ পুস্তক থেকে পরমপুরুষকে কেড়ে নিয়ে তাকে তোমার নিজের হূদয়–সিংহাসনে বসাও৷ এই হ’ল ধর্ম৷ ধর্মের পথ ধরে চলতে থাক দেখবে তোমাদের সমুদয় অস্তিত্ব আনন্দোচ্ছ্বল হয়ে উঠবে৷
আমাদের এই পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন সমস্যাও থাকবে পরমপুরুষের কৃপায় তার সমাধানও হয়ে যাবে৷ তাই কোন পরিস্থিতিতেই ঘাবড়াবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না৷ জয় তোমাদের হবেই৷ জয় তোমাদের হতেই হবে৷