যোগ ও তন্ত্র

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘যোগ ও তন্ত্র’৷ অনেকে জানতে আগ্রহী যে যোগ কী ও তন্ত্র কী, আর এদের মধ্যে মিল ও পার্থক্য কোথায়৷ প্রথমে যোগ নিয়ে আলোচনা করা যাক্৷

সংস্কৃত মূল ধাতু ‘যুন্জ্’৷ এই ‘যুন্জ্’–এর সঙ্গে ‘ঘঞ্’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়৷ অথবা ‘যুজ্’–এর সঙ্গে ‘ঘঞ্’ যুক্ত হয়েও যোগ শব্দ পাওয়া যায়৷ যদি যুজ্  ঘঞ্ ঞ্চ যোগ হয়, সেক্ষেত্রে যোগ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যোগ করা (addition), যেমন ২ ও ২ সংখ্যা মিলে ৪ সংখ্যাটি পাওয়া গেল৷ কিন্তু যদি ‘যুন্জ্’ ধাতুর সঙ্গে ‘ঘঞ্’ যুক্ত হয় তখন ‘যোগ’ শব্দটির অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সংযুক্ত করা বা হওয়া (unification), যেমন, চীনী আর জলের সংযোগে যে বস্তুটি পাওয়া গেল, তা৷ যখন চীনী আর জল একত্রে মিলিয়ে দেওয়া হ’ল তখন তার মধ্যে চীনীর পৃথক অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷ কিন্তু প্রথমটির ক্ষেত্রে ২ ও আর একটি ২–এদের যোগ করা হলেও প্রথম ২ ও দ্বিতীয় ২–এদের পৃথকত্ব থেকেই যায়৷ দু’টি আম ও আরও দুটি আম যোগ করে চারটি আম পেলুম৷ কিন্তু পৃথক ভাবে চারটি আমের অস্তিত্ব থেকেই যাচ্ছে৷

যোগের এই দু’টি derivation ছাড়াও অন্যান্য সংজ্ঞাও আছে৷ মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’ অর্থাৎ মনের সমস্ত বৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে নিরুদ্ধ করে দেওয়াই হচ্ছে যোগ৷ মানুষের মনে আছে পঞ্চাশটি বৃত্তি৷ যদি কোনো বিশেষ উপায়ে এই বৃত্তিগুলোকে নিরুদ্ধ করা যায়, তাদের অভিব্যক্তিকে বা ক্রিয়াশীলতাকে যদি আটকে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে মন কাজ করা বন্ধ করে দেবে৷ মনের এই নিরুদ্ধাবস্থাই হচ্ছে যোগ৷ কিন্তু আমরা ওপরে যোগের যে ব্যাখ্যা পেয়েছি তা হচ্ছে সংযোগ৷ বৃত্তি–নিরোধ বললে কোনো অর্থেই বৃত্তিগুলির সংযুক্তিকরণ হতে পারে না৷ বৃত্তি নিরুদ্ধ হওয়ার ফল–স্বরূপ অণুমনের ভূমামনের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটে না৷ এই ব্যাখ্যায় কার সঙ্গে কার সংযুক্তিকরণ হচ্ছে তা স্পষ্ট হয় না৷ তাই এই সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য নয়৷

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে–‘‘সর্বচিন্তা পরিত্যাগো নিশ্চিন্তো যোগ উচ্চতে’’৷ এর অর্থ যখন মন সমস্ত রকমের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকে সেই অবস্থাই হচ্ছে যোগ৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে মন চিন্তা থেকে মুক্ত হলেও তার ফলে মহত্তর কোন সংযুক্তিকরণ হয় না৷ যখন মানুষ গভীর নিদ্রায় থাকে, কোনো স্বপ্ণও সে দেখছে না, মন চিন্তামুক্ত অবস্থায় আছে বা অচেতন অবস্থায় আছে, সেই অবস্থাটাকে কি যোগ বলব? –না, যোগ বলব না৷

ভগবান সদাশিব প্রদত্ত আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে–‘সংযোগো যোগ ইত্যুক্তো জীবাত্মা–পরমাত্মনঃ৷’ এর অর্থ ব্যষ্টি–আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা যখন ভূমাসত্তা তথা পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে, সেটাই হচ্ছে যথার্থ যোগ৷ এটাই হচ্ছে যোগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞান–সম্মত ব্যাখ্যা৷

এখন ‘তন্ত্র’ কী তা দেখা যাক্৷ সংস্কৃত মূল ধাতু ‘তন্’–এর অর্থ হচ্ছে বিস্তারিত হওয়া৷ এই ‘তন্’ ধাতু থেকেই আমরা ‘তনু’ শব্দটি পাচ্ছি যার অর্থ যে দেহ ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হচ্ছে৷ একটি শিশুর দেহকে সংস্কৃতে বলে ‘তনু’৷ কেননা এটি ঊনচল্লিশ বছর পর্যন্ত বিকশিত হতে থাকে৷ তাই ঊনচল্লিশ বছর পর্যন্ত মানবদেহকে বলতে পারি ‘তনু’৷ কিন্তু তার পরে মানবদেহকে বলব শরীর, কেন না তার ক্ষয় হচ্ছে ও তা ক্রমশঃ শীর্ণ হচ্ছে বা সঙ্কুচিত হচ্ছে৷ তাই শিশুর দেহকে যেমন শরীর বলতে পারি না তেমনি একজন বৃদ্ধের শরীরকেও তনু বলতে পারি না৷

তন্  ত্রৈ  ড করে ‘তন্ত্র’ শব্দ পাচ্ছি, যার অর্থ যা মুক্তি আনয়ন করে৷ তাই তন্ত্র হচ্ছে সেই বিজ্ঞান যা মানসাধ্যাত্মিক বিস্তারের যে অনুশীলন তার মাধ্যমে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে৷ তাই তন্ত্রের সার কথা হচ্ছে এই বিস্তারিত ঙ্মজীবনের সর্ব ক্ষেত্রেক্ষ হয়ে চলা৷

তন্ত্রের আর একটি ব্যঞ্জনা হচ্ছে নিম্নরূপ ঃ–

ইন্দোভারতীয় বর্ণমালায় আছে পঞ্চাশটি বর্ণ যার মধ্যে ‘অ’ হচ্ছে প্রথম বর্ণ আর ‘ক্ষ’ হচ্ছে শেষ বর্ণ৷ এখন মুখ্য বৃত্তিগুলির সংখ্যাও হচ্ছে পঞ্চাশ৷ কিন্তু প্রতিটি বৃত্তির আবার কয়েকটি করে উপবৃত্তি আছে কেন না প্রতিটি বৃত্তির কোনো–না–কোনো faculty  আছে৷ এই ভাবে বৃত্তিগুলি দশটি দিশায় আর আন্তরিক ও বাহ্যিক দুই ভাবেই অভিব্যক্ত হয়৷ তাই শেষ পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে বৃত্তির সংখ্যা দাঁড়ায়–পঞ্চাশটি বৃত্তি  দশ দিক  আন্তরিক ও বাহ্যিক = এক হাজার৷ তাই মুখ্যতঃ বৃত্তির সংখ্যা পঞ্চাশ হলেও গৌণতঃ তারা এক হাজার৷ সহস্রার চক্রস্থিত সহস্রার গ্রন্থি থেকে এই এক হাজার বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়৷

এই প্রতিটি বৃত্তির নিজস্ব তরঙ্গ আছে, তাই তার নিজস্ব বর্ণও আছে৷ যখন কেউ ক্রোধবৃত্তির বশীভূত হয় তখন তার শরীরে এক রকমের স্পন্দনের সৃষ্টি হয় যার ফলে শরীর কাঁপতে থাকে ও মুখের রঙ পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ গৌর বর্ণের মানুষ (মুখ) লাল রঙের হয়ে যায়৷ কৃষ্ণ বর্ণের মানুষ হয়ে যায় বেগুনী রঙের৷ এইভাবে তোমরা দেখলে যে প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব তরঙ্গ আছে আবার রঙও আছে৷

এই যে কোন কর্মের বা কোন বস্তুর স্পন্দন, তার আবার শব্দাত্মক বা ধ্বনিগত বীজও আছে৷ কেউ একজন ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে ধরনের কথাবার্তা বলবে সেই মানুষটিই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় অন্যভাবে কথা বলবে৷ ক্রোধী মানুষের কণ্ঠস্বরও স্বাভাবিক মানুষের কণ্ঠস্বরের থেকে অস্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ সেইরকম প্রতিটি বৃত্তির নিজস্ব স্পন্দন আছে, সেই অনুযায়ী পৃথক বর্ণ ও ধ্বনিও আছে৷ পঞ্চাশটি বৃত্তির যে ধ্বনি তাই হচ্ছে আমাদের বর্ণমালা৷ অ, আ, ক, খ–এগুলি হচ্ছে ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তি৷ প্রতিটি বৃত্তির নিজস্ব রঙ (বর্ণ) আছে, আর এই পঞ্চাশটি ধ্বনি তথা বর্ণের সমাহার বলেই আমরা ইংরেজী alphabet– সংস্কৃতে ‘বর্ণমালা’ বলি৷ বর্ণ বা letter –যেমন স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ–আক্ষরিক অর্থেও বর্ণ মানে রঙ৷ এইভাবে পঞ্চাশটি মুখ্য ধ্বনি বা বর্ণ আর গৌণতঃ এক হাজার ধ্বনি বা বর্ণ আছে৷ আমি আগেই বলেছি প্রতিটি বৃত্তির বিশেষ বিশেষ বর্ণ আছে৷ যেমন, সত্ত্বগুণের রঙ হচ্ছে শাদা, রজোগুণের হলুদ আর তমোগুণের রঙ হচ্ছে কালো৷

আবার ‘শ’ হচ্ছে রজোগুণের ধ্বন্যাত্মক প্রতিভূ৷ এই ধ্বনিমূলক অভিব্যক্তিরই ঙ্মসাধনাগতক্ষ নাম হচ্ছে বীজমন্ত্র, ইংরেজীতে acoustic roots৷ ‘শ’ রজোগুণের বীজমন্ত্র, ‘স’ সত্ত্বগুণের বীজমন্ত্র আর ‘ষ’ তমোগুণের বীজমন্ত্র৷ কেউ একজন যখন চলছে তখন খট্–খট্–খট্ শব্দ উত্থিত হচ্ছে৷ তাই চলমানতা বা গতির বীজমন্ত্র হচ্ছে খট্–খট্–খট্৷ সমস্ত কর্ম বা অস্তিত্বের পেছনেই কোনো–না–কোনো ধ্বনিমূলক অভিব্যক্তি আছে–তাকেই বলে বীজমন্ত্র৷ প্রাচীনকালে রক্ষণশীল মানুষ চামড়ার জুতো পরতে চাইতেন না৷ তাঁরা কাষ্ঠনির্মিত জুতো বা খড়ম ব্যবহার করতেন৷ এই ধরনের খড়ম পরিধান করে তাঁরা যখন চলতেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই ঠক্–ঠক্–ঠক্ শব্দ তৈরী হত৷ তাই এক শ্রেণীর মানুষ যাঁরা চলার সময় ঠক্–ঠক্–ঠক্ শব্দ সৃষ্টি করতেন তাঁদের নাম হয়ে গেল ‘ঠক্কর’–ঠক্কম্ ঠক্কম্ করোতি যঃ সঃ ঠক্কর৷ ঠক্কর থেকে হয়ে গেল ‘ঠাকুর’৷

তাই স্পষ্টতঃ দেখা গেল প্রতিটি বর্ণ বা অস্তিত্বের পেছনে কোনো–না–কোনো বীজমন্ত্র আছেই৷ যেমন ‘শ’ রজোগুণের বীজমন্ত্র, তেমনি ‘র’ হচ্ছে শক্তির বা ন্দ্বুন্দ্বব্জন্ধম্ভ–র বীজমন্ত্র৷ শ  র ঞ্চ ‘শ্র’–এর অর্থ শক্তিসমন্বিত (সমস্ত রকমের শক্তি) রজোগুণের অভিপ্রকাশ৷ এখন ‘শ্র’–এর সঙ্গে স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হলে হয়ে যাবে ‘শ্রী’৷ এর অর্থ যার মধ্যে রজোগুণ আছে ও শক্তিও আছে৷ তাই ‘শ্রী’ শব্দের অন্তিম অর্থ হয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য–সুষমা বা Charm৷ বাস্তব জীবনের প্রতিটি মানুষই Charm–কে চায়৷ এই কারণেই প্রাচীনকাল থেকেই এই নিয়ম বা ব্যবস্থা চলে আসছে যে মানুষের নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দ যুক্ত করা ঙ্মশ্রীযুক্তক্ষ৷   (ক্রমশঃ)