যোগের তান্ত্রিক সংজ্ঞা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

যোগ কী? তোমারা জান যে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের প্রায় প্রতিটি শব্দের দু’টো করে মানে হয়৷ একটি হ’ল ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃতে যাকে বলা হয় ভাবরূরার্থ, দ্বিতীয়টি হ’ল সাধারণ প্রচলিত অর্থ অর্থাৎ লোকে যে অর্থে শব্দটাকে সচরাচর ব্যবহার বা প্রয়োগ করে থাকে৷ এটির সংস্কৃত নাম যোগরূরার্থ৷

উদাহরণস্বরূপ, ধর, ‘পঞ্চানন’ শব্দটি৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অর্থাৎ ভাবরূরার্থ হচ্ছে ‘যার পাঁচটা মুখ আছে’৷ যোগরূরার্থ হচ্ছে শিব৷ দেশে পঞ্চানন নামে কত শত ভদ্রলোক আছেন৷ এখানে আসল অর্থটা হ’ল এমন কেউ বা এমন কিছু যার পাঁচটা মুখ আছে৷

‘যোগ’ শব্দেরও চারটে ব্যাখ্যা আছে৷ ‘যুজ্’ ধাতুর উত্তর ‘ঘঞ্’ প্রত্যয় করে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়৷ এখানে ‘যোগ’ মানে addition, যেমন ২ + ২ = ৪৷ এটা যোগ৷

সংস্কৃত বর্ণমালার বর্ণগুলোর ঠিক ঠিক উচ্চারণ তোমাদের ভাল ভাবে জানা উচিত৷ আর্য–ভারতীয় বর্ণমালায় চারটে বর্ণ আছে যাদের বলা হয় অন্তঃস্থ বর্ণ –য, র, ল, ব৷ এই বর্ণগুলি স্বাধীন বা মৌলিক ধ্বনি নয়৷ এরা অন্তঃস্থ বর্ণ অর্থাৎ শব্দের আদিতে বসলে তাদের এক বিশেষ ধরনের ধ্বনি হয়, আবার যখন শব্দের আদিতে না বসে মধ্যে বা অন্তে বসে তখন আর এক ধরনের ধ্বনি হয়৷ যেমন ‘য’ ঞ্চ ই  অ, দু’টোই স্বরবর্ণ৷ এই ‘য’ যখন শব্দের আদিতে বসে তখন এর উচ্চারণ হবে ‘জ’ এর মত (যেমন ইংরেজী ‘Jump’ শব্দটির ‘J’–এর মত)৷ তাই ‘যোগ’ উচ্চারণ করতে হবে ‘জোগ’–এর মত, ‘ইয়োগ’–এর মত নয়৷ আবার শব্দের মধ্যে বা শেষে বসলে এর উচ্চারণ হবে ‘য়’–এর মত–‘জ’–এর মত নয়৷ যেমন ‘বিয়োগ’–‘বিজোগ’ নয়  ‘সময়’–‘সমজ’ নয়৷

‘র’ ধ্বনিটা যখন শব্দের আদিতে থাকে তখন তার পুরো উচ্চারণ হবে (যেমন ‘রথ’), নতুবা এর উচ্চারণ হবে হ্রস্ব, যেমন ঋ = অর্৷ অনুরূপভাবে ‘ল’ যদি শব্দের প্রথম অক্ষর হয় তাহলে এর পুরো উচ্চারণ হয় যেমন ‘লতা’, কিন্তু অন্তঃস্থ ‘ল’–এর উচ্চারণ ‘ল্র’ (lra)৷ উদাহরণস্বরূপ, ‘ফল’ শব্দের উচ্চারণ ‘ফল্র’৷ গ্রাম্য লোকেরা বলে ‘ফড়’, এটাই ঠিক উচ্চারণ, ‘ফল’ ঠিক নয়৷

‘ব’ অক্ষরটা শব্দের আদিতে থাকলে এর উচ্চারণ হবে ইংরেজী ‘’ অক্ষরটার মত, যদি আদ্যক্ষর না হয় তবে উচ্চারণ হবে ‘ভ্র’ অক্ষরটির মত৷

তাহলে ‘যোগ’ শব্দের উচ্চারণ দাঁড়াচ্ছে ‘জোগ’ শব্দের মত, কারণ ‘য’ এখানে শব্দের আদ্যক্ষর৷ যেখানে মূল ধাতুটা হ’ল ‘যুজ্’ সেখানে ‘যোগ’ মানে addition (যেমন দু’য়ে দু’য়ে চার)৷ সেক্ষেত্রে সত্তাদ্বয়ের পৃথক পৃথক অস্তিত্ব বজায় থাকবে৷ কিন্তু যেখানে ‘যোগ’ শব্দটা ‘যুন্জ্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন সেখানে ‘যোগ’ (যুন্জ্  ঘএ = যোগ) মানে unification৷ যেমন জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ যেখানে ব্ভুন্ন্দ্রন্ন্তুত্রব্ধন্প্ অর্থ হয় সেখানে একাধিক সত্তার পৃথক অস্তিত্ব বজায় থাকে না৷ যেমন ধর, চীনী ও জলের মিশ্রণ৷ দু’য়ে মিলে সরবৎ তৈরী হ’ল৷ এক্ষেত্রে চীনী ও জল দু’য়ের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রইল কি? তাই দর্শন শাস্ত্রে বা তন্ত্র শাস্ত্রে আমরা যে ‘যোগ’ শব্দটা জানি তা কিন্তু ‘যুজ্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়নি, তা নিষ্পন্ন হয়েছে এই ‘যুন্জ্’ ধাতু থেকে৷ অর্থাৎ এই যোগের অর্থ হ’ল unification৷ জীবাত্মা যখন পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত হয় তখন জীবাত্মার আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না৷

‘যোগ’ শব্দের তৃতীয় অর্থটা মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের ওপর আধারিত৷ সেখানে ‘যোগ’ শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, /যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্*৷ মানুষের মধ্যে অনেকানেক বৃত্তি রয়েছে যা পশুর মধ্যে নেই৷ মুখ্যতঃ মানব মনে বৃত্তির সংখ্যা পঞ্চাশটি৷ এই পঞ্চাশটি বৃত্তি মানুষের মনের ভেতরেও কাজ করে, বাইরেও কাজ করে আর তারা কাজ করে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে৷ কাজেই বৃত্তির সংখ্যা সর্বসাকুল্যে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে এক হাজারে৷ তাহলে এই মৌলিক পঞ্চাশটি বৃত্তির অভিব্যক্তি ঘটছে হাজার রকমে৷ সংস্কৃতে এদের বলা হয় চিত্তবৃত্তি৷ এই হাজার বৃত্তির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রকে সংস্কৃতে বলা হয় সহস্রার চক্র৷ একে সহস্রদল কমলও বলা হয়৷ ইংরেজীতে বলা হয় Pineal gland or pineal body.

‘চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’৷ এই যে হাজার দিকে ধাবমান বৃত্তিসমূহ, এদের অভিব্যক্তিগুলোকে যখন সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ‘চিত্তবৃত্তিনিরোধ’৷ যদি এই মানসিক বৃত্তিগুলোকে নিরুদ্ধ করে ফেলা হয় তখন মানব সংরচনার বাকী সব কাজও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে৷ মহর্ষি পতঞ্জলির মতে এটাই যোগের চরম অবস্থা৷

সংস্কৃত ‘নিরোধ’ শব্দের মানে স্তম্ভন–suspension৷ নি–রুধ্  ঘঞ্ প্রত্যয় করে ‘নিরোধ’ শব্দ নিষ্পন্ন৷ কিন্তু মহর্ষি পতঞ্জলির যোগ সম্পর্কিত এই সংজ্ঞা তন্ত্র স্বীকার করে না৷ তন্ত্রের মতে যোগের পরিভাষা হ’ল /সংযোগঃ যোগ ইত্যুক্তঃ জীবাত্মা পরমাত্মনঃ*৷ অর্থাৎ তন্ত্রের মতে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগকে বলে ‘যোগ’৷ এখানে তন্ত্র প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে আর এক ধাপ এগিয়ে গেছে৷ পতঞ্জলির মতে যোগ মানে মানসবৃত্তির নিরুদ্ধাবস্থা৷ তোমরা জান যে মানসবৃত্তিগুলোকে যখন বাইরের জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নিরুদ্ধ করা হয়, সেক্ষেত্রে সেই নিরুদ্ধ বৃত্তিকে যদি কোন বিশেষ লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা না হয়, তাহলে তারা তো মনের বিভিন্ন কোণে চঞ্চলতা সৃষ্টি করবে৷ যদি বাইরের জগতে কোন অভিব্যক্তি না ঘটে থাকে, মনের ভেতরে তো তারা বিঘ্ণ সৃষ্টি করবেই৷ যেমন কেউ হয়তো বাইরের জগতে কোন জিনিস চুরি করল না, কিন্তু মনে মনে চুরি তো করতেই পারে৷

তন্ত্র যোগের এই সংজ্ঞা স্বীকার করে না৷ তন্ত্র মতে যোগের পরিভাষা হ’ল পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মহামিলন৷ মানস বৃত্তিকে অবাঞ্ছিত বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সেগুলোকে পরমপুরুষের দিকে চালিয়ে দিতে হবে, তবে প্রত্যাহার যোগের কাজটা পুরো হবে৷ এই প্রত্যাহৃত মানস বৃত্তিগুলোকে পরম চৈতন্যের দিকে পরিচালনার মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগ সম্ভব হবে৷ এই হ’ল যোগ৷

(পটনা, ২রা সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)